প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১০:৫৪
একলা মা

চারদিকে ঘোর অন্ধকার আর গভীর নিরবতা। নিঃশব্দ রাতের বুক চিরে হঠাৎ করেই ভেসে এলো তীব্র বাক্যবিনিময়ের আওয়াজ। কৌতূহল আর অজানা টানেই আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। একটা ছোট বাসার দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম—স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া চলছে। দুজনেই উত্তেজিত, চোখ-মুখে রাগ, কণ্ঠে বিষ। আর সেই তীব্র ঝগড়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছে এক চার বছরের ছোট্ট ছেলে। তার ছোট চোখদুটোতে ভয়, মুখে অসহায়তা, আর বুকভরা কান্না যেন পাথরের মতো ভারি হয়ে জমে আছে।
ঝগড়ার শব্দ থেমে গেল কিছুক্ষণ পর। কিন্তু শিশুটির চোখের জল থামল না।
কয়েকদিনের মধ্যেই এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো খবর—ওদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে। মনটা কেমন যেন ভার হয়ে এলো। আমার মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল ‘এই ছোট্ট শিশুটি এখন কার সঙ্গে থাকবে?’ জানতে চাইলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, আদালতের রায়ে বাচ্চার হেফাজত গেছে মায়ের কাছে।
কিন্তু এটুকুতে মন শান্ত হলো না। আরও জানতে ইচ্ছে হলো ‘মা কি সন্তানের দায়িত্ব নেবে ঠিকভাবে? নাকি নতুন জীবনের খোঁজে তাকে অবহেলা করবে?’ তখনকার সমাজব্যবস্থায় অনেক সময় দেখা যায়, সন্তান পিতামাতার ঝগড়ার বলি হয়ে পড়ে, একা থেকে যায়, বা হয়তো বড় হয় অবহেলায়।
কিছুদিন পর জানলাম, সেই নারী দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। বরং একটি ছোট বেসরকারি সংস্থায় সামান্য বেতনের চাকরি নিয়েছেন। সমাজের নানা চাপ, আত্মীয়স্বজনের কথাবার্তা, আর একাকিত্বের দুঃসহ জীবনস্রোতের মাঝেও তিনি নিজের সন্তানকে নিয়েই জীবন কাটাচ্ছেন। কোনো অভিযোগ নেই, নেই কোনো অনুযোগ।
সময়ের ঢেউয়ে ঘটনাটি চাপা পড়ে গেল। জীবনের নানা ব্যস্ততায় আমি বিষয়টি ভুলেই গিয়েছিলাম।
চৌদ্দ বছর পর একদিন হঠাৎ শহরের এক কর্নারে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। প্রথমে চিনতে পারিনি। কিন্তু তার চোখদুটো চিনে ফেললাম—তখনকার সেই বেদনাভরা শান্ত চোখ। বললাম, ‘আপনি তো... সেই... আপনাকে অনেক বছর পর দেখছি। আপনার ছেলে কেমন আছে?’
হাসিমুখে বললেন, ‘ভালো আছে। এখন আঠারো বছর বয়স।’
বললাম, ‘আপনি তো আবার বিয়ে করেননি?’
তিনি হালকা হেসে মাথা নাড়লেন, ‘না, আর করিনি। জীবনটাকে আমি ওর জন্যই বাঁচিয়েছি।’
সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার বাবা... আপনার আগের স্বামী... তিনি কি ছেলের খোঁজখবর রাখেন?’
এক মুহূর্ত নীরব থাকলেন। তারপর ধীরে বললেন, ‘না। গত চৌদ্দ বছরে একবারও যোগাযোগ করেনি। এমনকি ছেলের সঙ্গে কথাও বলেনি। কোথায় আছেন, কী করছেন—আমার কোনো খবর নেই।’
আমি হতবাক হয়ে গেলাম। একজন বাবা, যার রক্ত বইছে ছেলের শরীরে, তিনি কীভাবে এমন নিষ্ঠুর হতে পারেন?
পরবর্তীতে জানলাম, সেই পুরুষ দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছেন। সুখে সংসার করছেন, দুটি সন্তান রয়েছে। সমাজে তাকে সফল পুরুষ হিসেবেই দেখা হয়।
একদিকে একজন নারী, যিনি স্বামী, সংসার, সামাজিক সম্মান হারিয়ে একমাত্র সন্তানকে আঁকড়ে ধরে জীবনের প্রতিটা দিন পার করেছেন; অন্যদিকে একজন পুরুষ, যিনি সহজেই পুরনো সম্পর্কের দায়িত্ব এড়িয়ে নতুন পরিবার গড়েছেন—দুই জীবন, দুই প্রান্ত।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, পৃথিবীতে এমন কত বাবা আছেন, যারা সন্তানের অস্তিত্ব ভুলে যান! কীভাবে পারেন? একজন মা সন্তান জন্ম দিলেই যেমন মা হন, একজন পুরুষ কি শুধুই জন্মদাতা হলে বাবার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়?
আর এই নারী! তিনি তো অনায়াসেই বিয়ে করে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন সন্তানের জন্য। বিনিময়ে কিছু চাননি। সমাজের চোখে তিনি হয়তো ‘পরিত্যক্তা’ নারী, কিন্তু সন্তানের চোখে তিনি পরিপূর্ণ একজন মা—আদর্শ, ভালোবাসা, আত্মত্যাগের জীবন্ত প্রতিমূর্তি।
ছেলেটা এখন কলেজে পড়ে, পড়াশোনায় ভালো। দেখলে বোঝা যায়, সে ভালোবাসায় বড় হয়েছে। বাবার অভাব সে হয়তো অনুভব করেছে, কিন্তু কোনোদিন মায়ের ভালোবাসার ঘাটতি পায়নি।
এই দুনিয়ায় কেউ সব হারিয়ে হয়ে ওঠে মহান, আবার কেউ সব পেয়ে ছোট হয়ে যায়।
আমার মনে পড়ে সেই শেষ প্রশ্ন
‘বিধাতার এ কেমন ইচ্ছে?’
এই প্রশ্নের উত্তর আজও আমি খুঁজে ফিরি।