প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৭
ধারাবাহিক উপন্যাস-১৩
নিকুঞ্জ নিকেতন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৯.
বেশ উৎফুল্লতা নিয়ে আমার ভোরটা শুরু হয়েছে। রাজীব আসছে, এটা আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। অনেক বেশি রকমের খুশি আমি কিন্তু কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না এমন কী রাজীবকেও না। কতগুলো বছর পর তাকে দেখব ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। কাকাবাবুকে বলে রেখেছি রাত যতই হোক না কেন আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যেতে। তিনি বললেন এত রাতে এয়ারপোর্টে যাওয়ার কী দরকার? বাসায় এলে তো দেখতে পাবি! আমি নাছোড়বান্দা এয়ারপোর্টে আমাকে নিতেই হবে। অবশেষে বাবা-মা আর দ্বিমত করতে পারলেন না। আমরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি রাত তখন দশটারও বেশি। একটার পর একটা ফ্লাইট আসছে আর যাচ্ছে অথচ তার দেখা নেই। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তার দেখা মিলল। বড় একটা লাগেজ ও একটা ব্যাগ ট্রলিতে করে নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। আমার খুবই ইচ্ছে হচ্ছে দৌঁড়ে গিয়ে ঝাঁপটে ধরি। মনের আকাক্সক্ষা বাতাসে ভর করে ডানা মেলতে চাইলেও লোক লজ্জার ভয়ে সেটাকে গুটিয়ে নিয়েছি। ব্যকুলতাকে দমিয়ে রেখে মুখে একটা মৃদু হাসিভাব রাখলাম। ও জোর কদমে হেঁটে আমাদের কাছে আসল। কাকাবাবুকে বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে বাপ-ছেলের অনুভূতিটা প্রকাশ করল, আমি পাশে দাঁড়িয়ে। তাদের অনুভূতি দেখে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলাম না। একমাত্র সন্তান বলে কথা, না চাইতেও চোখের আঁড়াল করেছিলেন আর আজ কতগুলো বছর পার করে এসেছে দেশের মাটিতে আপনজনদের কাছে। একটু আবেগী হওয়াটা স্বাভাবিক। অবশেষে আমার দিকে নজর দিয়ে কাছে এসে তার হাতে আমার হাতটা তুলে ধরল আমি কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছি আবার খুব ইচ্ছে হচ্ছে এ হাত যেন কভুও না ছাড়ে। লোক লজ্জায় আমি বেশিক্ষণ হাত ধরে থাকিনি, আলতো করে ছাড়িয়ে নিয়েছি। তারপর ক্যাব নিয়ে সোজা বাসায় চলে আসি। পথে যদিও বাবা-ছেলের বেশ আলাপ হয়েছিল কিন্তু আমি ছিলাম নীরব। আমার কোনো কথা নেই বলার, নেই জানার শুধু আছে অপলক তাকে দেখতে থাকা। রাতে তেমন কোনো আলোচনা না হলেও ভোর হতেই আমি ছুটে যাই তাদের বাসায়। কাকাবাবু সবে মাত্র পার্ক থেকে হেঁটে এসে বাগানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে আর নজর খবরের কাগজে। এখনকার ইন্টারনেটের সময়ে খবরের কাগজগুলো হয়তো উনাদের মতো লোকের জন্যই বিক্রি হচ্ছে। যেখানে সকালে ঘটে যাওয়া সংবাদ আধঘণ্টার মধ্যেই জাতি জানতে পারে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেখানে আজকের খবর আগামী কাল পড়ার কোনো যুক্তি আছে বলে আমার মনে হয় না। বাগানে বসে উনার সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর দেখি রাজীব ঘুম থেকে উঠে এদিকে এগিয়ে আসছে। তার সাথে আড্ডা দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে যদিও এখানে আসা তারপরও মনে কেমন যেন দ্বিধা কাজ করছে। আমার মনের অনুভূতিগুলো কভু প্রকাশ না পায় সেদিকে সর্বদা সচেতন থাকতে হচ্ছে। তাকে আসতে দেখে কাকাবাবু বলে উঠলÑ
‘এত বেলায় তোমার ঘুম ভাঙল। তোমরা বসে গল্প কর আমি বাজারে গেলাম। মনমোহনকে বলছি তোমাদের নাশতা এখানে দিয়ে যেতে।’
কাকাবাবু চলে গেলে আমি অপ্রস্তুতভাবে এদিক-ওদিক দেখছি। গা ছাড়াভাবে এসে আমার সামনে সে বসে পড়ল। আমি একটু মুচকি হেসে সম্মতি জানালাম। ছোটবেলার বন্ধু অথচ কেমন যেন সংকোচ বোধ আমার মধ্যে যেন আমি আর সে দুটো ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ।
‘এভাবে আচরণ কেন করছিস বলতে পারিস?’
‘এভাবে আচরণ বলতে?’
‘আমি কালকেও লক্ষ্য করেছি তুই কেমন যেন হয়ে গেছিস। আমার সাথে একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলছিস। কেন?’
‘না বিষয়টা ঠিক সেরকম না। অনেকদিন পর এলে তো তাই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না।’
‘স্বাভাবিক হতে না পারার কারণ কী জানতে পারি?’
‘ব্যপারটা হলো এতদিন পর তুমি দেশে ফিরলে,
তোমার সেখানকার পরিবেশ আর এখানকার পরিবেশ এই দুটোর মাঝে তুমি কীভাবে রিয়েক্ট করবে সেজন্যই এমন হয়তো। তুমি তো আর আগের মতো নেই।’
‘তাই বুঝি। তা তুই কখন থেকে সবজান্তা হয়েছিস এবার বল তো? আসলাম গতকাল রাতে অথচ তোর এমনটা কেন মনে হলো আমাকে বলতে হবে।’
‘তুমি এভাবে জেরা করলে কিন্তু আমি চলে যাব।’
‘যাবি আর কোথায়। মোল্লার দৌঁড় মসজিদ অবদি, তুই না হয় বাসায় দৌঁড় দিবি। আমি সেখানে গিয়েও উপস্থিত হব।’
‘বাবু তোমাদের নাশতাটা।’
‘এখানে রেখে দাও কাকা আমরা নিয়ে নিব।’
‘এবার কী কী প্ল্যান করে এসেছ?’
‘না তেমন কোনো প্ল্যান করিনি। তবে সকলের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়ে গতবার ঘুরতে পারিনি এবার আর সেটা করতে চাইছি না। বাপিকে সময় দিব আর তার আড্ডা পার্টির সাথে দেখা করব। আচ্ছা তুই কী ওই লোকগুলো সম্পর্কে কিছু জানিস?’
‘জানার কী আছে। উনারা সকলেই চাকরি শেষে অবসরের দিন গুনছে। প্রত্যেকের অবস্থা একই রকমের। উনাদের জীবন ধারা একই ধরনের হওয়ায় হয়তো তাদের বন্ধুত্বটা গড়ে উঠেছে। কাকাবাবু আমার সাথে একবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। দেখলাম বেশ মজার মানুষ। তাদের একজন সারোয়ার চাচা উনি আসলে সকলে হৈ হুল্লোরে মেতে উঠেন দেখি। আড্ডাবাজি হয় ক্যারাম নয়তো দাবায়।’
‘জানিস বাপিকে ছেড়ে যাওয়ার পর মন কোনো কিছুতেই সায় দিত না। সর্বক্ষণ উনার জন্য চিন্তা থাকত আর সেজন্যই তোকে কল দিয়ে বাপির খোঁজখবর নিতাম। উনার এই সার্কেল তৈরি হওয়ায় অন্তত তিনি একাকিত্বে ভুগবেন না আর আমিও কিছুটা চিন্তা মুক্ত থাকতে পারব। আমি গতবারের মতো এবারও আশা নিয়ে এসেছি যে তুই বাপিকে আমার সাথে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে চেষ্টা করবি।’
‘আমি কেন, যদি বল আমার বাবা-মা মিলে উনাকে বলবে তারপরও তিনি রাজি হবেন না। কারণ এই বাড়িটাকে তিনি ছাড়তে পারবেন না। তিনি একদিন আমার সাথে শেয়ার করেছেন যে এখানে এখনো তোমার আর কাকিমুনির অবস্থান তিনি অনুভব করেন। আমি প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম বুঝতে পারিনি বলে পরে তিনি বুঝালেন আমায়। দেখ, কাকাবাবু পুরানো সময়গুলোতে বাঁধা রয়েছেন তাকে সেভাবেই থাকতে দাও। তুমি সেখানে নিয়ে গেলেও তাকে এমন প্রাণোজ্বল দেখতে পাবে না যেটা এখন তিনি এখানে রয়েছেন। তারচেয়ে উনাকে উনার মতো করে থাকতে দাও।’
‘তুই জানিস না উনাকে ছাড়া আমার কেমন যেন অসহায় মনে হয়। মাঝে মাঝে মন খুব কাঁদে যে বাপির কাছে ছুটে চলে আসি কিন্তু পারি না।’
‘ভালোবাসাগুলো এমনি হয়। দূরে থাকলে বোধ হয় সেগুলো আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।’
সময়গুলো যাচ্ছে আর আমাদের ঘোরাফেরাও হচ্ছে বেশ। শহরের মাঝ দিয়ে যাওয়ার পথে একটা স্কুল মাঠ পড়ে যেখানে একপাশে বটগাছ রয়েছে। গাছটার নিচের বেদিটা বেশ প্রশস্ত ও গোলাকার হওয়ায় পহেলা বৈশাখে এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো হয় আবার এই স্কুল মাঠেই বৈশাখী মেলা বসে। ছোটবেলায় এই বটতলায় অনেক ছুটোছুটি করেছি তাকে নিয়ে। আজ সেই বটতলায় এসে বসেছি। সময়ের বদলে এই শহরটারও পরিবর্তন হয়েছে বেশ। কিছু জিনিস তারপরও অপরিবর্তীত রয়ে গেছে। এই বটতলা আজও সেরকমই রয়ে গেছে যেমনটা দেখেছিলাম ছোটবেলায়। টিনেজাররা বসে আড্ডা দিচ্ছে আবার তাদের ঘিরে বসেছে ফুচকা চটপটির অস্থায়ী দোকানগুলো। এদেশে যে কেউ চাইলেই এখানে সেখানে বসে ব্যবসা করতে পারে কোনো বিধিনিষেধ নেই অথচ উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় সেটা অসম্ভব। সিটি কর্পোরেশনের একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকবে স্ট্রিট শপিংয়ের জন্য তাছাড়া তাদের পে করতে হয় সিটি কর্পোরেশনকে অথচ এখানে সেটা করে বলে আমার মনে হয় না। দেশটা এমন হবে কবে সেটা প্রশ্নবোধকেই থেকে গেল আদৌ সেটা সম্ভব কী না তাও জানি না। আমরা দুজনে বসে বেশ কিছুক্ষণ গল্প জুড়ে দিয়েছি। কিছুটা স্মৃতিচারণ, কিছু অভিজ্ঞতার বুলি, কিছুটা অন্যদের বিষয়ে আলোকপাত কিন্তু নিজেদের আজ কিছুই বলছি না। আমি আসার পর থেকে প্রথম দু দিন বিশাখাকে কেমন যেন আলাদাভাবে পেয়েছি। তার স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছিল কিন্তু আমার সামনে তার অস্বাভাবিক হওয়াটা আমাকে আজও ভাবায়। বাপিকে নিয়ে এবার বেশি একটা আড্ডা দেওয়া হয়নি আমার। তিনি তার দুনিয়াতেই মশগুল আর তার আড্ডাপার্টির সকলেই ভালো ও আন্তরিক দেখলাম। আমার দুশ্চিন্তা কিছুটা কমলো বাপিকে নিয়ে। এখন আর তার পৃথিবীটা শূন্য নয়। আমি যাওয়ার আগে সকলকে একটা ট্রিট দিতে চেয়েছিলাম যেটা গতকাল সম্ভব হয়েছিল। আমার নিমন্ত্রণে বিশাখাও আমন্ত্রিত ছিল। সকলের সাথে একটা সন্ধ্যা কাটাতে পেরে আমি ছিলাম মুগ্ধ কারণ বাপির বন্ধুমহল সম্পর্কে জানার বিষয়ে এর চাইতে ভালো কোনো উৎস আমার জানা নেই। খাবার টেবিলে তাদের কথাবার্তা ও বন্ধুসুলভ আচরণটা আমায় বেশ স্পর্শ করেছিল আর বিশাখা তার বিষয়ে কী বলব। এতদিন ধরে তাকে দেখেছি, জেনেছি কিন্তু কভুও ভিন্নভাবে দেখা হয়নি যা কাল দেখতে পেয়েছিলাম। বরাবরের মতো সেলোয়ার কামিজে নয় কাল এসেছিল শাড়িতে একটু ভিন্ন রূপে। আমার চিরচেনা বিশাখা মেয়েটিও যে এতটা সুন্দরী তা আগে কখনো জানতে পারিনি। আজকে তাকে নিয়ে বের হয়েছি কেন সেটা জানি না তবে তার কাছে আমার কিছু বলার আছে কিন্তু কী সেটাই খুঁজে পাচ্ছি না।
‘আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে খাবি নাকি?’
‘মন্দ বলনি, চল খাওয়া যাক।’
‘সময়গুলো কীভাবে চলে গেল বুঝতেই পারিনি। যাওয়ার সময়টা ঘনিয়ে এল, মন সায় দিচ্ছে না তবু যেতে হবে।’
‘কবে যাবে?’
‘আগামী বুধবারের টিকেট কনফার্ম করা।’
‘কাকাবাবুকে জানিয়েছ যাওয়ার কথা।’
‘না...তবে তিনি জানেন কারণ আমি আসার পরপরই যাওয়ার তারিখটা বলে রেখেছিলাম আর উনিও সেটা ক্যালেন্ডারে টুকে রেখেছেন।’
‘তুমি আসবে আসবে করে এসে এখন যাওয়ার সময় হয়ে গেল। অদ্ভুত আমাদের এ জীবন তাই না?’
‘বলতে পারিস।’
আমরা সেদিনের পর বেশি একটা ঘোরাফেরা করতে পারিনি। ওর আত্মীয়দের বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকায় তারা ব্যস্ত হয়ে যায়। বুধবার রাতের ফ্লাইট ছিল আমরা সকলেই এয়ারপোর্টে এসেছিলাম। আমার বাবা-মাও সেদিন তাকে বিদায় জানানোর জন্য এয়ারপোর্টে এসেছিলেন। খানিকটা দূরে এসে ওয়েটিং কর্ণারের বেঞ্চিটায় আমি বসে আছি। এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে, সে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে আমাকে খুঁজছে। ইচ্ছে হচ্ছে না তাকে বিদায় জানাই হয়তো নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারব না তাই শেষ বেলায় তার কাছে আসতে ভয়। হঠাৎ পাশে এসে বসে আমাকে বলছেÑ
‘বিদায় দিতে না পারলে এয়ারপোর্টে এসেছিস কেন?’
‘না সেরকম কিছু না অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম তো তাই ক্লান্ত লাগছে।’
‘আমার যাওয়ার সময় হয়েছে এনাউন্সমেন্ট হয়ে গেছে।’
‘ও তাই। আবার কবে আসবে?’
‘জানি না। তবে সুযোগ হলেই দেশে ফিরে আসব।’
‘তুমি ভালো থেক আর নিজের দিকে খেয়াল রেখ।’
‘আমি ভালো থাকব যখন তোরা ভালো থাকবি। বাপির দিকে খেয়াল রাখিস। উনাকে তোর ভরসায় রেখে গেলাম। আমি কী সে ভরসাটুকু করতে পারি?’
‘অবশ্যি।’
ইচ্ছে হচ্ছে ঝাপটে ধরে বলিÑযেও না। যাওয়ার সময় হাতটা তার হাতে নিয়ে চেপে ধরল কিছুক্ষণ তারপর ছেড়ে দিয়ে জোর কদমে হেঁটে চলে গেল। যাওয়ার সময় একটি বারের জন্যও ফিরে তাকায়নি। শুনেছি যারা পিছু ফিরে তাকায় তারা আর ছেড়ে যেতে চায় না।
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় দেখুন]








