সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:৫৯

রামু ট্র্যাজেডি : এক যুগ পরেও ন্যায়বিচারের পথে আলো ক্ষীণ

অসীম বিকাশ বড়ুয়া
রামু ট্র্যাজেডি : এক যুগ পরেও ন্যায়বিচারের পথে আলো ক্ষীণ
ছবি : লেখক অসীম বিকাশ বড়ুয়া

আজ ২৯ সেপ্টেম্বর। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলো ১২টি বছর।

২০১২ সালের এই দিনে কক্সবাজারের রামুতে ঘটে যাওয়া বর্বরোচিত সহিংসতা কেবল বৌদ্ধ মন্দির আর বসতবাড়ির ধ্বংসযজ্ঞ ছিল না, এটি ছিলো বাংলাদেশের শত বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মর্মমূলে এক গভীর ফাটল। ফেসবুকে একটি মিথ্যা গুজবের রেশ ধরে একদল উন্মত্ত জনতা যে বর্বরতা চালিয়েছিলো, তার ক্ষত এখনও পুরোপুরি শুকায়নি—বিশেষ করে ন্যায়বিচারের প্রশ্নে।

ন্যায়বিচারের দীর্ঘ অন্ধকার পথ

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের রামু ট্র্যাজেডির ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফ থানায় মোট ১৯টি মামলা দায়ের হয়, যার মধ্যে আপসের ভিত্তিতে একটি মামলা প্রত্যাহার হলেও ১৮টি মামলা এখনও ঝুলে আছে। ১২ বছরেও একটি মামলারও নিষ্পত্তি না হওয়া কেবল দুঃখজনক নয়, এটি বিচারপ্রার্থীদের জন্যে চরম হতাশার। হতাশার প্রধান কারণ হচ্ছে : সাক্ষীদের অনীহা। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা (পিপি) বলছেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা সাক্ষ্য দিতে না আসায় মামলাগুলো স্থবির হয়ে আছে। দীর্ঘসূত্রিতা এবং হয়রানির ভয়ে অনেকে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী নন।

মামলার চার্জশিট নিয়ে বিতর্ক

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অভিযোগ, তদন্তে অনেক প্রকৃত দোষী মামলার আসামি নন। উল্টো স্থানীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি-জামায়াতসহ অনেক নিরীহ লোকজনকে আসামি করে হয়রানি করা হয়েছে। এই বিতর্কিত চার্জশিট এবং হয়রানির শিকার হওয়ার কারণেও সাক্ষীরা আস্থা হারিয়েছেন।

নিখোঁজ উত্তম বড়ুয়া

যার ফেসবুক পোস্টের গুজবকে কেন্দ্র করে এই সহিংসতা, সেই উত্তম বড়ুয়া ঘটনার পর থেকেই নিখোঁজ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনও তার অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। এটি মামলার মূল রহস্য উদঘাটনে একটি বড়ো বাধা। রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের পরিচালক শীলপ্রিয় থের-এর আক্ষেপ, "সেই সম্পদ ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। ঘটনাটি স্মরণ করলে এখনো চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।" বিচার প্রক্রিয়ার এমন অচলাবস্থা ক্ষতিগ্রস্তদের আক্ষেপকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

ফিরে আসা সম্প্রীতি, থেকে যাওয়া ক্ষত

১২ বছরের ব্যবধানে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে ধ্বংস হওয়া বৌদ্ধ স্থাপনাগুলো আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। নতুন মন্দিরগুলো এখন দৃষ্টিনন্দন এবং রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায় এখন ভালো আছেন বলে জানাচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের আবাসিক অধ্যক্ষ প্রজ্ঞানন্দ মহাথের বলেন, "যে ক্ষতের তৈরি হয়েছিলো, ১১ বছরে আমরা সবাই মিলে তা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি। এখন আমাদের সম্প্রীতিও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।" এই সম্প্রীতি ফিরে আসা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক, যা শত বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে রক্ষা করেছে। তবে, এই আপাত শান্তির নিচে চাপা পড়ে আছে ন্যায়বিচারের অভাবজনিত একটি চাপা কষ্ট।

ভবিষ্যৎ করণীয় : জিরো টলারেন্সের বিকল্প নেই

রামু ট্র্যাজেডির বিচার দীর্ঘসূত্রিতায় কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর পরবর্তী হামলাগুলোর ক্ষেত্রেও একটি ভুল বার্তা দিয়েছে। এই ধরনের সহিংসতা মোকাবিলায় 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ করা জরুরি।

পুনঃতদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করা

মামলার অভিযোগপত্রে অসংগতি থাকায় আদালত ইতোমধ্যে কয়েকটি মামলায় পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। বিতর্কিত ১৮টি মামলারই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পুনঃতদন্ত নিশ্চিত করে নিরীহদের হয়রানি থেকে মুক্তি দেওয়া এবং মূল হোতাদের চিহ্নিত করা আবশ্যক।

সাক্ষীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা

সাক্ষীদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য ভয়মুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রকে তাদের সুরক্ষা এবং আর্থিক বা অন্য কোনো হয়রানি থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে।

গুজব মোকাবিলায় গণসচেতনতা

ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় উসকানি দেওয়া এখন সহজ হয়ে গেছে। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বছরব্যাপী প্রচারণার পাশাপাশি গুজব রটনাকারীদের দ্রুত শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। রামু ট্র্যাজেডি ভুলে থাকার বিষয় নয়, এটি থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয়। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হলে অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে যাবে এবং সমাজে বিদ্বেষের বীজ বপন করতে সাহস পাবে।

১২ বছর পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রকে অবশ্যই এই ১৮টি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করে দেশের সব নাগরিকের জন্যে সমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এটাই হবে রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে দেওয়া সবচেয়ে বড় আশ্বাস।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও এক্স ভাইস-চেয়ারম্যান (কোরিয়া বাংলা-প্রেসক্লাব)

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়