প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:৩২
হৃদয়ের নীরব কান্না: বিশ্ব হার্ট দিবসে বৈশ্বিক সতর্কতা থেকে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ!
হৃদয়ের স্বাস্থ্যই জাতির কর্মক্ষমতা!

মানবদেহের প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি স্পন্দন নির্ভর করে হৃদয়ের উপর। প্রতি মিনিটে প্রায় ৭০–৭৫ বার স্পন্দিত হয়ে এটি রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে দেহের প্রতিটি অঙ্গকে জীবনীশক্তি জোগায়।
|আরো খবর
একটি সুস্থ হৃদপিণ্ড দিনে প্রায় এক লক্ষ বার স্পন্দিত হয় এবং প্রায় ২০০০ গ্যালন রক্ত পাম্প করে।
অথচ এই অত্যাবশ্যক অঙ্গটি নিয়ে আমাদের সচেতনতার অভাব বিস্ময়কর।অনেকেই মনে করেন হৃদরোগ শুধুমাত্র বৃদ্ধ বয়সীদের রোগ। বাস্তবে, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে এটি সব বয়সের মানুষের জন্য সমান ঝুঁকিপূর্ণ, যা নীরবে আমাদের জীবনীশক্তি কেড়ে নিচ্ছে।
বিশ্ব হার্ট দিবসের তাৎপর্য: যৌথ অঙ্গীকারের ডাক
২০০০ সালে বিশ্ব হার্ট ফেডারেশন (World Heart Federation) হৃদরোগ প্রতিরোধে বৈশ্বিক সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ২৯ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব হার্ট দিবস ঘোষণা করে।
এটি কেবল একটি প্রতীকী দিন নয়, বরং হৃদয়ের যত্নের জন্য বৈশ্বিক শপথের দিন।
২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য: "My Heart, Your Heart: Let’s Protect Together" (আমার হৃদয়, তোমার হৃদয়: আসুন একসাথে রক্ষা করি)।
এই প্রতিপাদ্য স্পষ্ট করে দেয় যে হৃদরোগ প্রতিরোধ শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়; বরং পারিবারিক, সামাজিক এবং বৈশ্বিক এক যৌথ অঙ্গীকার। হৃদরোগের প্রভাব কোনো একার জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না।
প্রতি ৩২% মৃত্যু হৃদরোগে: উন্নত বিশ্ব থেকে বাংলাদেশের ভয়াবহ চিত্র
বৈশ্বিক স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান অত্যন্ত উদ্বেগের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ হৃদরোগে মারা যায়।
এটি বিশ্বের মোট মৃত্যুর প্রায় ৩২%।উন্নত দেশগুলোতে উন্নত চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও ফাস্ট ফুড, কাজের চাপ ও মানসিক অস্থিরতার কারণে ঝুঁকি বেশি।
অন্যদিকে, বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অবস্থা আরও ভয়াবহ। এখানে সচেতনতার অভাব ও দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার কারণে মৃত্যুহার প্রায়শই প্রতিরোধযোগ্য থেকেও বেশি।
একটি কর্মক্ষম মানুষের অকাল মৃত্যু একটি পুরো পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়।বাংলাদেশের বাস্তবতা: কেন কর্মক্ষম বয়সে হার্ট অ্যাটাক?
বাংলাদেশে হৃদরোগ এখন মহামারীর আকার ধারণ করেছে, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ মানুষ হৃদরোগে মারা যায়।
সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, কর্মক্ষম বয়সী (৩০–৫০) মানুষের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
এই বয়সে মৃত্যু কেবল ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটি দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, লাগামহীন মানসিক চাপ এবং অনিয়মিত জীবনযাত্রাই এর প্রধান কারণ।
হৃদরোগের কারণ: ছয় নীরব ঘাতকের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
আমাদের জীবনযাত্রার ভুলভ্রান্তিই মূলত হৃদরোগের ছয়টি প্রধান কারণকে ডেকে আনে। এই কারণগুলো সম্মিলিতভাবে হৃদপিণ্ডের ক্ষতি করে:
১. উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): ধমনীতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে হৃদপিণ্ডকে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে।
২. ডায়াবেটিস: রক্তনালীর প্রাচীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং করোনারি আর্টারি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
৩. অতিরিক্ত কোলেস্টেরল: 'LDL' বা খারাপ কোলেস্টেরল ধমনীতে চর্বি জমে ব্লক তৈরি করে।
৪. ধূমপান ও মদ্যপান: রক্তনালীগুলিকে সংকুচিত করে, রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।
৫. মানসিক চাপ (Stress): স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে যা হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপকে দীর্ঘমেয়াদে অস্বাভাবিক করে দেয়।
৬. শারীরিক অনিয়ম: ব্যায়ামের অভাবে স্থূলতা বাড়ে, যা হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত কাজের চাপ সৃষ্টি করে।
সচেতনতার অভাব: নীরব ঘাতক ও 'গোল্ডেন আওয়ার' মিস করা
বাংলাদেশে অনেক মানুষ হৃদরোগের প্রাথমিক লক্ষণ—যেমন বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট, অস্বাভাবিক ক্লান্তি, হঠাৎ মাথা ঘোরা—এগুলিকে গ্যাসের সমস্যা বা সাধারণ দুর্বলতা মনে করে গুরুত্ব দেন না।
উপসর্গ দেখা দিলেও তারা চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে স্থানীয় ভেষজ বা অনভিজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান।
এর ফলে 'গোল্ডেন আওয়ার' (প্রথম এক ঘণ্টা) মিস হয়ে যায়, যখন জরুরি চিকিৎসা জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে কার্যকর।সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেক প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুও এড়ানো যায় না।
বাস্তব অভিজ্ঞতা ও উদাহরণ: একটি পরিবারের নীরব কান্না
শহরের একটি অফিসে কর্মরত ৪০ বছর বয়সী মিস্টার করিম গত কয়েক মাস ধরে প্রায়ই বুক ধড়ফড় করা এবং ক্লান্তিবোধ করতেন।
তিনি এটিকে 'কাজের চাপ' মনে করে এড়িয়ে গেছেন এবং অ্যান্টাসিড খেয়েছেন।
হঠাৎ একদিন ভোরে তীব্র বুকে ব্যথা নিয়ে তিনি হাসপাতালে আসেন।
ততক্ষণে হৃদপিণ্ডের পেশীর বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে।সময়মতো চিকিৎসকের কাছে না যাওয়ার এই সিদ্ধান্তটি একটি কর্মক্ষম মানুষকে অচল করে দিল, যার ফল ভুগতে হলো তার পুরো পরিবারকে।
এই ধরনের হাজারো 'করিম'-এর গল্প আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে।
প্রতিরোধ: হৃদয়ের সুরক্ষায় পাঁচ আঙুলের সহজ কৌশল
১. দৈনিক হাঁটা: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা বা শারীরিক পরিশ্রম করা।
২. সুষম খাদ্য: ফলমূল, শাকসবজি এবং আঁশযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া।
৩. লবণ, তেল নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত লবণ, চিনি ও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা।
৪. নেশা বর্জন: ধূমপান-মদ্যপান পুরোপুরি বাদ দেওয়া।
৫. ঘুম ও বিশ্রাম: মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা এবং রাতে পর্যাপ্ত (৭-৮ ঘণ্টা) ঘুমানো।
আন্তর্জাতিক পাঠ: বিশ্ব থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের করণীয়
উন্নত দেশগুলোর মডেল অনুসরণ করে আমাদেরও পদক্ষেপ নিতে হবে:
- স্কুলে স্বাস্থ্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
- প্যাকেজজাত খাদ্যে চর্বি, চিনি ও লবণের সীমা কঠোরভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া।
- পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ আইনকে আরও শক্তিশালীভাবে প্রয়োগ করা।
- কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও মানসিক চাপ কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বার্তা: ফাস্ট ফুডের বদলে সুস্থ হৃদয়ের শপথ
আজকের শিশু আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়বে। শৈশব থেকেই ফাস্ট ফুড, কোল্ড ড্রিংকস ও বসে বসে মোবাইল খেলার অভ্যাসে অভ্যস্ত হলে, তাদের জীবন শুরুর আগেই হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়বে।
তাই পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রকে এখনই একসাথে এগিয়ে আসতে হবে।
শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস গড়তে হবে এবং প্রযুক্তির আসক্তি থেকে দূরে রাখতে হবে।
হৃদয়ের সুস্থতা নিশ্চিত করাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমাদের সবচেয়ে বড় দায়বদ্ধতা।উপসংহার: বিশ্ব হার্ট দিবসে আমাদের যৌথ অঙ্গীকার

বিশ্ব হার্ট দিবস শুধু একটি স্মরণ দিবস নয়, এটি আমাদের জন্য জীবন বাঁচানোর সতর্কবার্তা।
হৃদয় সুস্থ রাখা মানে একটি পরিবারকে বাঁচানো, একটি সমাজকে টিকিয়ে রাখা এবং একটি জাতিকে কর্মক্ষম রাখা। আজ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি—"আমার হৃদয়, তোমার হৃদয়—আমরা একসাথে রক্ষা করবো।"
লেখক পরিচিতি:
অধ্যাপক মোঃ জাকির হোসেন
সাধারণ সম্পাদক
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, চাঁদপুর জেলা শাখা।
ডিসিকে/এমজেডএইচ