সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫  |   ৩০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ

প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং অকৃতজ্ঞতার হাওয়া

আমিনুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং অকৃতজ্ঞতার হাওয়া

সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ভালো মানুষের পাশাপাশি সমাজে চোর ডাকাত বাটপার লম্পট ধর্ষক ঘুষখোর খুনী মিথ্যুক ইত্যাদি নানাধরনের কিছু খারাপ মানুষও থাকে। তো খারাপ মানুষদের মধ্যে কোন্ ধরনের মানুষ নিকৃষ্টতম বা সবচেয়ে বেশি খারাপ? একথায় উত্তর : অকৃতজ্ঞরা। তারা উপকারীরকে অস্বীকার করতে পারে যেকোনো সময়। উপকারীর বদনামও করতে পারে। এমনকি উপকারীর ক্ষতিও করতে পারে। অবশ্য তখন বাংলাভাষায় তার নাম হয়ে যায় কৃতঘ্ন। আসলে কৃতঘ্ন হচ্ছে অকৃতজ্ঞেরই চরম রূপ। মানুষের চরিত্রের গভীরতম রূপগুলো চিত্রায়নে আজও বিশ্বে অদ্বিতীয় উইলিয়াম শেক্সপীয়ার। তিনি মানুষের অকৃতজ্ঞতার বয়ান দিতে গিয়ে গীতিকবিতার ভাষায় বলেছেন :

Blow, blow, thou winter wind

Thou are not so unkind

As manÕs ingratitude

Thy tooth is not so keen

Because thou art not seen

Although thy breath be rude.

অনুবাদ :

বয়ে যাও ওগো শীতের হাওয়া

বয়ে যাও বয়ে যাও

নরের অকৃতজ্ঞতার সমান

তুমি তো নির্মম নও;

দাঁত নয় তোমার ততটা ধারালো

যেহেতু যায় না দেখা

নিশ্বাস তোমার যদিও রচে

বর্বরতার রেখা।

একজন মানুষকে সবচেয়ে খারাপ এবং সকল বদগুণের আধার বলে এককথায় চিত্রিত করার একমাত্র বিশেষণটি হচ্ছে : অকৃতজ্ঞ। এই উপমহাদেশের মানুষের মাঝে অকৃতজ্ঞ লোক আগেও ছিল , এখনও আছে। অবশ্য ভবিষ্যতে না থাকলেই ভালো হয়। উপমহাদেশের মানুষ অকৃতজ্ঞ বলেই মহাত্মা গান্ধীর মতো শান্তিবাদী, স্বাধীনতার মূল স্থপতি এবং রাষ্ট্রক্ষমতার লোভ থেকে ১০০% ভাগ মুক্ত মানুষকেও খুন করতে পারে। তারা অস্বীকার করতে পারে স্বাধীনতার বীর যোদ্ধাদের সর্বোচ্চ অবদানকে। তারা মুছে ফেলতে পারে নিজেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম কারিগরদের নাম নিশানা। সেই অকৃতজ্ঞতার সাম্প্রতিকতম সংযোজন তৎকালীন পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ সহ একটি বড়ো অঞ্চল) এর মানুষের শিক্ষার সুব্যবস্থাকারী নবাব সলিমুল্লাহসহ অন্যন্যদের অবদানকে অস্বীকার করার অপতৎপরতা। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, এদেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম ও বিকাশ নবাব সলিমুল্লাহ, তাঁর পিতা নবাব আহসানুল্লাহ, তাদের বংশের লোকজন এবং অন্যান্য নবাবদের দানে ও অবদানে। নবাব সলিমুল্লাহর প্রধান ব্রেন চাইল্ড হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি কতখানি জমি দান করতে পেরেছিলেন কিংবা পারেননি, সেই প্রশ্ন তোলা আজ অবান্তর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার খলনায়ক স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উত্তরসূরিরাও এমন প্রশ্ন তুলবেন বলে মনে হয় না। জন্মদানের সময় কতবিঘা জমি রেখে গেছেন সেই প্রশ্ন তুলে পিতাকে কি অস্বীকার করতে চায় কোনো সন্তান? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নবাব সলিমুল্লাহর অবদান জন্মদাতার সমতুলপ্রায়। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতার কাজে নবাব সলিমুল্লাহর প্রধান পরামর্শদাতা, সহযোগী ও কর্মী-সেনাপতি ছিলেন নওয়াব আলী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নবাব সলিমুল্লাহর অবদান কী ছিল তার বিস্তারিত বিবরণ তো বহু বইয়েই আছে। একটি ঘটনা কেবল তুলে ধরছি। নবাব সলিমুল্লাহ মারা যান ১৯১৫ সালে। তাঁর মৃত্যুর ৬ বছর পরের ঘটনা।

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবক ও উদ্যোক্তা হিসেবে নবাব সলিমুল্লাহকেই যে ‘প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়, সে স্বীকৃতি সরকার এবং দ্ইু বাংলার হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টান প্রখ্যাত শিক্ষাবিদরাই দিয়ে গেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কোর্ট সভা (সিনেট) অনুষ্ঠিত হয় ১৭ আগস্ট চ্যান্সেলর ও বাংলার গভর্নর লরেন্স জন ল্যামলে ডানকানর্স, আর্ল অব রোনাল্ডসের সভাপতিত্বে। অধিকাংশ হিন্দু খ্যাতিমান শিক্ষাবিদসহ ১১৩ জন সদস্য সে সভায় উপস্থিত ছিলেন। শুরুতে নবাব সলিমুল্লাহর জন্য াড়ঃব ড়ভ ধঢ়ঢ়ৎবপরধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ংবৎারাব বিষয়ক একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন ফজলুল হক এবং নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা। প্রস্তাবে বলা হয় :

That on this solemn occasion of the inauguration of this University

this meeting of the court places on record its great appreciation of

the services of the late Nawab Sir Salimullah Bahadur, G.C.I.E, in

conception and initiation of the scheme of the founding of this

University.

|| Minutes of the First Court meeting, 17 August 1921

মামুলি প্রস্তাব গ্রহণ নয়, এই প্রস্তাব উত্থাপনের সময় গভর্নরসহ সমস্ত সদস্য এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে পরলোকগত নবাব বাহাদুরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন গভীর কৃতজ্ঞতায়।’’

(গ্রন্থ : নবাব সলিমুল্লাহ ও তাঁর সময়, লেখক : সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রকাশক : প্রথমা, ঢাকা)

আরও উল্লেখ্য, নবাব সলিমুল্লাহ অত্যন্ত দূরদর্শী ও উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করলে নবাব সলিমুল্লাহ খুশি হন। তিনি কবিকে অভিনন্দন জানিয়ে তারবার্তা পাঠান। ঢাকায় আয়োজন করা হয় কবি সংবর্ধনার। আয়োজনে ‘‘ঢাকা সাহিত্য পরিষদ’’। এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ। তিনি সেই অনুষ্ঠানের অংশিক ব্যয়ও বহন করেন।

মুসলামনদের সেই অন্ধকার সময়ে নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন “আধুনিক শিক্ষা’’-এর সমর্থক। সেজন্যই তিনি ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি বলেছিলেন :

“আমাদের পূর্বপুরুষেরা মনে করতেন, আরবি ফারসি শিক্ষা অন্য যেকোনো শিক্ষার চেয়ে কোনো দিক থেকে নিম্নমানের নয়। তাঁদের আরও ধারণা ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যাবে এবং তারা অধর্মের দিকে ধাবিত হবে। আমাদের পূর্বপুরুষদের এই ভ্রান্ত ধারণাই মুসলমান জাতিকে পাশ্চাত্যের আধুনিক চিন্তাধারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং তাদের অবনতির দিকে ঠেলে দেয়।’’ (পূর্বোক্ত)

নারীদের জন্য আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থাকরণ, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা, ঢাকাকে দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে গণ্য করার জন্য গভর্নরের কাছে প্রস্তাব প্রেরণ ইত্যাদি বিষয়ে নবাব সলিমুল্লাহর অবদান প্রথম স্থানীয়, অনন্য ও অতুলনীয়। তিনিবড়ো বড়ো জেলা শহরে মুসলমান ছাত্রদের জন্য হোস্টেল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আধুনিক শিক্ষার সমর্থক ছিলেন বলে সেইসময়ের গোঁড়া মুসলমানরা তাঁর বিপক্ষে ছিলো। তেমনি তিনি মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে নেয়ার কাজে অ্রগ্রণী ছিলেন বলে হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে অপপ্রচার চালাতেন। কিন্তু তিনি কোনো প্রতিকূলতার কাছে নতি স্বীকার করনেনি। তাঁর অবস্থা ছিলো অনকেটা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো।

প্রসঙ্গত উল্লেখ কার যায়, যেটার আজকের নাম বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ইটঊঞ), সেটির প্রতিষ্ঠাতাও নবাব আহসানুল্লাহ ও তাঁর ছেলে নবাব সলিমুল্লাহ। আগে এটি ছিলো একটি সার্ভে স্কুল। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৬ সালে। এটিকে প্রকৌশল শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার জন্য নবাব আহসানুল্লাহ তখন ১ লাখ ১২ হাজার টাকা দানের ঘোষণা দেন। তিনি অকালে মারা গেলে তাঁরই ছেলে নবাব সলিমুল্লাহ সেই দান প্রদান করেন। আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল নাম এটির নতুন যাত্রা শুরু ১৯০৮ সালে। চল্লিশের দশকে এটির নাম হয় আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৬২ সালে এটিকে বিশ্ববদ্যিালয়ে উন্নীত করা হয়। মুছে ফেলা হয় হয়েছে প্রতিষ্ঠাতাদের নাম। পাকিস্তান আমলেই ঘটেছিল। সেই অকৃজ্ঞতার সিলসিলা অব্যাহত রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, একটি প্রতিবেশি দেশে মুসলমানদের সুকীর্তির নিদর্শনাদি ও নামধাম মুছে ফেলা হচ্ছে এক এক করে। সেটা হচ্ছে প্রকাশ্যেই কোনো রাখঢাক না রেখে । সেটা একটি দলের ঘোষিত রাজনৈতিক লক্ষ্য। একসময় স্পেনেও একই ধরনের কাজ হয়েছিল। কিন্তু এদেশের অকৃতজ্ঞদের উৎসাহিত করছে কে? বৃটিশ ভারতে শিল্পপতিরা ছিল। জমিদাররা ছিল। তারা কিন্তু তাদের সম্পত্তি জনস্বার্থে বিলিয়ে দেননি। কিন্তু নবাব সলিমুল্লাহ গং প্রায় সকল সম্পত্তি ব্যয় করে গেছেন এদেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য। আজকের বঙ্গভবনটাও তাদের রেখে যাওয়া সেই ‘দিলকুশা’ প্রাসাদের নতুন নাম। শাহবাগ, ঢাকা ক্লাব ইত্যাদি তাঁদেরই সম্পত্তির পরিবর্তিত রূপ। নবাব সলিমুল্লাহ ধর্ম নির্বিশেষে অভাবী মানুষকে দান করতেন। তিনি সকল ধর্মের প্রতিষ্ঠানে ও আচার অনুষ্ঠানে সহায়তা দিতেন। তিনি শুধু পূর্ববঙ্গ নয়, সমগ্র বঙ্গ ভূখণ্ডের মঙ্গলকামী ছিলেন। তিনি ছিলেন আধুনিক ও উদার শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সমর্থক ও অনুরাগী।

নবাব সলিমুল্লাহ মৃত্যুবরণ করলে তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে শুধু মসুলমানরাই নয়, সেসময়ের প্রখ্যাত হিন্দু শিক্ষাবিদগণও উপস্থিত থেকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। তাঁর ঘোরতর প্রতিপক্ষ সুরেন্দ্র ব্যানার্জীর মতো লোকেরাও তাঁর গৌরবময় অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন উচ্ছ্বসিত ভাষায়। ইংরেজ গভর্নরের প্রতিনিধিরাও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অখণ্ড বাংলার বহু স্থানে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ভারত সরকার ও বঙ্গ প্রদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে তৎকালীন বঙ্গীয় আইন পরিষদে শোক প্রস্তাব গৃহীত যা উত্থাপন করেন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল। সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা থেকে জানা যায় যে-- ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত নবাব সলিমুল্লাহর জন্মদিন ও মুত্যুদিন পালন করা হতো তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববদ্যিালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে।

তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর তাঁকে নিয়ে কবি রচনা করেছিলেন কবিতা :

“যে আলো জ্বালাতে চেয়েছিলে তুমি আপন স্বার্থ ভুলি

নিভেনি সে আলো তোমার মরণে, নৌ চাঁদের ফালি--;

আজি সে রৌশনী দুকূল ছাপায়ে বিনাশে অন্ধকার

‘ইনভারসিটি’, ‘মুসলিম হল’ আল আজহার বাংলার।’

যে স্বপন পুষেছিলে মনে করতে বঙ্গ আলোকময়

এখান হ’তে ভাতিবে সে আলো সেদিন বড় দূরে নয়।

দূর ভবিষ্যত যতদূর চাহি এর প্রতি ইট পাথর খান

জাগরণ-গীতি গাহিছে সে তব তরুণ জাগার গান।‘’

আর এখন অস্বীকারের পাখি ডানা ঝাপটায় ডালে বসে মালীর বাগানে!

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়