প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:৩৭
সিএইচসিপিরা নিজেদের মত করে ক্লিনিকে আসা-যাওয়া করেন
চিকিৎসা বঞ্চিত রায়পুরে মেঘনার চরের লক্ষাধিক মানুষের দুঃখ

মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা গুরুত্বপূর্ণ । তবে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা তিন ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ। এ চরের অন্তত দরিদ্র অসহায় মানুষের জন্যে নেই কোনো হাসপাতাল। নেই কোনো চিকিৎসক। একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও তা তালাবদ্ধ থাকে প্রায় সময়। সর্বরোগের জন্যে কয়েকটি ফার্মেসি একমাত্র ভরসা। ফলে প্রায়ই বিনা চিকিৎসায় মারা যান রোগীরা।
|আরো খবর
রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর ওপারে ৩টি ইউনিয়নে ১১টি কমিউনিটি ক্লিনিক আর ২টি সাব সেন্টার রয়েছে। একটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্স চরাঞ্চল থেকে রোগীদের দ্রুত নদী পারাপারের জন্যে সাবেক জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলেও আজও তা ফাইলেই চাপা পড়ে রয়েছে।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, রায়পুরের মেঘনা নদী সংলগ্ন তিনটি ইউনিয়নের জন্যে ১১টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রতিদিন সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও অসহায় গরীব মানুষগুলো সেবা পান না বলে অভিযোগ রয়েছে। দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ডে দায়িত্বে থাকা কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার ফারজানা, হনুফা, আবদুল মান্নানকে সময়মত খুঁজে পাওয়া যায়না। একই অবস্থা উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের ৪টি ওয়ার্ডের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো।
এ বিষয়ে সিএইচসিপি ফারজানা আক্তার, হনুফা আক্তার ও আবদুর রহমান বলেন, বিভিন্ন সময় সরকারি হাসপাতালে যাওয়াসহ বিভিন্ন কাজ থাকে। আমরা নোটিস ঝুলিয়ে রেখে যাওয়া উচিত ছিলো। গরীব মানুষ হয়রানি হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করছি। আর ভুল হবে না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আবদুর রহমান ও মহসীন মাঝে মাঝে আসেন কমিউনিটি ক্লিনিকে। বেশিরভাগ সময় তারা ফার্মেসিতেই থাকেন। নারীসহ সকল সিএইচসিপি নিজেদের ইচ্ছেমত ক্লিনিকে আসা যাওয়া করে থাকেন।
এদিকে মিয়ারহাট বাজার, চান্দারকাল ও হাজিমারা স্লুইস গেইটের সামনে দেখা যায়, কয়েকটি ইঞ্জিন চালিত ও বৈঠাযুক্ত নৌকা। ভেতরে রোগী একাধিক এবং রোগীর স্বজনদের বসার জায়গাও নেই। অনেক কষ্ট করে ১৫ কিলোমিটার দূরুত্বে রায়পুর ও সদর হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বছরের পর বছর একটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করেও লাভ হয়নি। চরাঞ্চলের মানুষ মিয়ারহাট, আলতাফ মাস্টারের খেয়াঘাট, হাজিমারা, পানিরঘাট, চান্দারখাল ও হায়দরগঞ্জের সাজু মোল্লার ঘাটে ট্রলারে পারাপার হয়ে থাকে। রাতে কারও চিকিৎসা বা অন্য জরুরি প্রয়োজনে ঘাটের মাঝিদের ফোন দিলে তারাই পার করে তাদের।
তিনটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কী, সেটিই জানেন না এই মেঘনা চরের অধিকাংশ নারী। গর্ভকালীন সময়ে করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কেও নেই তাদের প্রয়োজনীয় ধারণা। বংশ পরম্পরায় দাদি-নানিদের কাছ থেকে যা জেনেছেন তা নিয়েই চলছে এই চরের নারীদের জীবন। সকল প্রকার রোগের চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসা এলাকার ফার্মেসিগুলো। অসুস্থ হয়ে পড়লে পাড়ি দিতে হয় দুর্গম পথ ও খেয়া নৌকায় পার হতে হয় ভয়াবহ মেঘনা নদী। কেউ কেউ নদীতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন অধিক সময় লাগার কারণে। তাও আবার সন্ধ্যা ৬টার পর বন্ধ হয়ে যায় সেই খেয়া পারাপার।
দক্ষিণনচরবংশী ইউনিয়নের মিয়ারহাট এলাকার খতেজা বেগমের কাছে এক বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘আঁর হোলার বউ গর্ভবতী আছিল, পরে ওপার নেওয়ার সময় মাঝ নদীত মারা গেছে।’
চরাঞ্চলের বাসিন্দা বিউটি আক্তার এক বাচ্চার মা। তিনি বলেন, ‘চরে নাই হাসপাতাল। কোনো গাইনি ডাক্তার নেই। মেয়েদের গর্ভকালীন অবস্থায় অনেক সমস্যা হয়। ওই অবস্থায় কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না। আমাদের দেশগ্রামে চাউনি (দাই) আছে, কিন্তু তারা অতকিছু বোঝে না। তাদের কাছেতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কোনো কিছু থাকে না। তারা যতোটুকু পারে, চেষ্টা করে। ডাক্তার না থাকার কারণে অনেক সময় বাচ্চা মারা যায়, নয়তো মা মারা যায়।’
স্থানীয় চাঁন মিয়া বলেন, ‘আমার এক আত্নীয়ের ছয় মাস চলে। আমাদের চরাঞ্চলে কোনো হাসপাতাল নাই, কোনো ডাক্তার নাই। কোনো জায়গায় নিতে হলে আমাদের চরাঞ্চল থেকে অনেক কষ্ট যাতায়াত করা। নদীপথে যেতে হলেও সময়মতো নৌকা পাওয়া যায় না। সময়মতো না যেতে পারার কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। হাজিমারা সুইসগেইট এলাকা ৩কিলোমিটার রিকশা দিয়ে চরলক্ষি ক্লিনিকে যেতে হয়। আমাদের চরে যদি একটা ক্লিনিক বা হাসপাতাল থাকতো, যদি ডাক্তার থাকতো, আমাদের জন্য ভালো হতো।’
রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগনিয়ন্ত্রক ডা. মাহির হোসেন বলেন, রায়পুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের (উত্তর চরবংশী, দক্ষিণ চরবংশী ও দক্ষিণ চরআবাবিল) মেঘনার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। সেখানে ১১টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও দুটি সাবসেন্টার রয়েছে ( খাসেরহাট বাজার ও হায়দরগঞ্জ বাজারে)। আরেকটি সাব সেন্টার ছিলো, তা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চরাঞ্চলবাসীর জন্যে একটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্স খুব প্রয়োজন। গত দু বছর আগে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করেছিলেন সাবেক জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান ও জেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আশফাকুর রহমান মামুনুর রশিদ । আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছিলাম।
রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরান খান বলেন, মেঘনার ওপারের চরাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি আমরা আইনশৃংখলা কমিটির সভায় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানিয়েছি। একটা নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দেয়ার জন্য চেষ্টা করবো। ইউনিয়ন কমিউনিটি ক্লিনিকের বিষয়ে খবর নিয়ে দেখবো। কেউ যদি দায়িত্বে অবহেলা করেন বা করছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।