রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৪২

নতুন বিশ্বব্যবস্থার সন্ধিক্ষণে : চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অবস্থান

ড. আজিজুল আম্বিয়া
নতুন বিশ্বব্যবস্থার সন্ধিক্ষণে : চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অবস্থান

একবিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক রাজনীতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। একসময় যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন একধুর্ত্ব বিশ্বব্যবস্থা আজ চ্যালেঞ্জের মুখে, যেখানে চীন তার অর্থনৈতিক শক্তি ও সামরিক প্রদর্শনের মাধ্যমে বহুধুর্ত্ব (Multipolar) বিশ্ব গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করছে। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের মহাসামরিক কুচকাওয়াজ কেবল শক্তি প্রদর্শন নয়, বরং একটি নতুন বৈশ্বিক ভারসাম্যের ঘোষণা।

এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কৌশলগত অবস্থান আরও গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সুযোগ খুঁজছে, ভারত একদিকে সীমান্ত নিরাপত্তা ও পশ্চিমা জোটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস চালাচ্ছে, আর পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন পেয়ে আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখার চেষ্টা করছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চীন সফর, যা বিশ্বকে বার্তা দিয়েছে—ভারত কোনো একক শিবিরে আবদ্ধ নয়, বরং নিজস্ব কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখে বহুমুখী কূটনীতি অনুসরণ করছে। এর ফলে বৈশ্বিক রাজনীতি নতুন করে গঠিত হচ্ছে, যেখানে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা একসাথে বিদ্যমান।

চীনের মহাসামরিক প্রদর্শনী ও বহুধুর্ত্ব (Multipolar World Order) প্রত্যয়কে কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যায়।

আমেরিকান আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ: প্রদর্শনীতে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, স্টেলথ ড্রোন, এবং উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তুলে ধরে চীন স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রযুক্তির বিকল্প কেন্দ্র হয়ে উঠছে।

রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সমর্থন : ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং উনের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে চীন নিজেকে মার্কিন-জোটভুক্ত ব্লকের বাইরে একটি নতুন শক্তিশালী অক্ষ গঠনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছে।

Unipolar থেকে Multipolar : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকা-কেন্দ্রিক একধুর্ত্ব বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে চীন 'বহুধুর্ত্ব' (যেখানে একাধিক শক্তি ভারসাম্য বজায় রাখবে) মডেলকে প্রচার করছে।

'Global South' নেতৃত্ব : চীন আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোর কাছে বিকল্প সহযোগী শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে, যা পশ্চিমা প্রভাবকে দুর্বল করতে পারে।

প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রদর্শন : চীনের প্রদর্শনীতে কেবল প্রতিরক্ষামূলক নয়, আক্রমণাত্মক সামর্থ্যও তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিরোধমূলক কৌশল : দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান প্রণালী এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সম্ভাব্য সংঘাতের প্রেক্ষাপটে এই প্রদর্শনী যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্যে সতর্কবার্তা।

অর্থনীতির সাথে সামরিক শক্তি সমন্বয় : বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর মাধ্যমে চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করছে। সামরিক প্রদর্শনী সেই অর্থনৈতিক শক্তিকে নিরাপত্তা ছাতা দেওয়ার ইঙ্গিত।

কূটনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি : সামরিক শক্তি দেখিয়ে চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আশ্বস্ত করছে যে, তারা মার্কিন চাপমুক্ত নিরাপত্তা সহযোগিতা দিতে সক্ষম।

যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের প্রতিক্রিয়া : যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত প্রমুখ দেশ চীনের এই অবস্থানকে হুমকি হিসেবে দেখবে এবং Quad ও AUKUS-এর মত জোটকে আরও সক্রিয় করতে পারে।

নতুন শীতল যুদ্ধের আশঙ্কা : বিশ্বব্যবস্থা ক্রমশ 'পশ্চিমা ব্লক বনাম চীন-রাশিয়া ব্লক'-এ বিভক্ত হতে পারে।

অঞ্চলভিত্তিক অস্থিতিশীলতা : দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

এ ছাড়া চীনের এই মহাসামরিক প্রদর্শনীকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও স্বার্থ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখছে। নিচে অঞ্চলভিত্তিক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো :

প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশসমূহ এটাকে কিভাবে দেখছে আলোচনা করছি ।

হুমকি হিসেবে দেখা : যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এই প্রদর্শনীকে সরাসরি শক্তির প্রদর্শন এবং পশ্চিমা প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে।

নতুন সামরিক জোট জোরদার : AUKUS (আমেরিকা-যুক্তরাজ্য-অস্ট্রেলিয়া) ও NATO ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কার্যক্রম বাড়াতে পারে।

অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কৌশল : পশ্চিমা দেশগুলো সাপ্লাই চেইনকে 'চীন-নির্ভরতা' থেকে সরাতে আরও উদ্যোগী হতে পারে।

তারপর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে কথা বলছি,

ভারত : চীনের উত্থানকে আঞ্চলিক হুমকি মনে করছে। Quad (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত) জোটকে আরও শক্তিশালী করার পক্ষে থাকবে।

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া : তাইওয়ান প্রণালী ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা মার্কিন ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বাড়াবে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (ASEAN) : বিভক্ত প্রতিক্রিয়া। ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন উদ্বিগ্ন, কিন্তু কম্বোডিয়া ও লাওস চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় এটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছে।

এখন বলছি রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার কথা।

উদ্দীপনা ও সমর্থন : রাশিয়া মনে করছে চীন তাদের কৌশলগত মিত্র এবং পশ্চিমা অবরোধ ভাঙ্গতে সহায়তা করছে এবং উত্তর কোরিয়া চীনকে নিরাপত্তা গ্যারান্টার মনে করে, তাই এ ধরনের প্রদর্শনী তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে।

মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে এখন আলোচনা করছি , ইরান : ইতিবাচকভাবে দেখছে। তারা চীনের সাথে সামরিক ও জ্বালানি সহযোগিতা বাড়াতে চায়।

সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলো : দ্বৈত কৌশল নিচ্ছে। একদিকে মার্কিন জোটের সদস্য, অন্যদিকে চীনের সাথে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বজায় রাখতে আগ্রহী। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কথা বলছি এখন।

সমর্থনমূলক মনোভাব : চীন দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামো বিনিয়োগ ও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে এই অঞ্চলগুলোতে প্রভাব বাড়িয়েছে। সামরিক শক্তি প্রদর্শন তাদের কাছে চীনকে আরও নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে তুলে ধরে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প : আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ মার্কিন শর্তযুক্ত সহযোগিতার বদলে চীনের রাজনৈতিকভাবে কম হস্তক্ষেপমূলক সহযোগিতা পছন্দ করছে।

বার্তা : চীন স্পষ্ট করে জানাচ্ছে যে, সে শুধু অর্থনৈতিক নয়, নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও বৈশ্বিক শক্তি। বাংলাদেশের জন্যে এটি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ভারসাম্য দ্রুত বদলাচ্ছে। এর সম্ভাব্য সুবিধা : অর্থনৈতিক সহযোগিতা : বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর আওতায় অবকাঠামো বিনিয়োগ আরও বাড়তে পারে।

সামরিক প্রযুক্তি : বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই চীনা প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ক্রেতা। আধুনিক প্রযুক্তি পাওয়ার সুযোগ বাড়তে পারে।

কূটনৈতিক ভারসাম্য : বাংলাদেশ চীন ও ভারতের মাঝে একটি সেতুবন্ধন হিসেবে কৌশলগত সুবিধা নিতে পারে। বার্তা : চীন দেখাতে চাইছে যে, তারা শুধু অর্থনৈতিক নয়, নিরাপত্তা ও সামরিক শক্তিতেও শক্তিশালী। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উপস্থিতি (বিশেষত বন্দর, অবকাঠামো ও প্রতিরক্ষা) আরও দৃঢ় হবে।

এর সম্ভাব্য সুবিধা : অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো সহযোগিতা : বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর অংশ হিসেবে বন্দর, রেল, সড়ক ইত্যাদি উন্নয়নে চীনের অর্থায়ন অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে।

সামরিক প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম : বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে চীনের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনে আসছে। নতুন প্রযুক্তি প্রদর্শনী বাংলাদেশকে চীনা অস্ত্রের উপর আরও নির্ভরশীল করতে পারে।

ভারসাম্য রক্ষা : চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে এ বার্তা চীন স্পষ্ট করছে যে, তার লক্ষ্য শুধু আঞ্চলিক নেতৃত্ব নয়, বৈশ্বিক নেতৃত্ব। ভারতের জন্যে এটি সরাসরি নিরাপত্তা উদ্বেগ, বিশেষত সীমান্ত সংঘাত (লাদাখ, অরুণাচল প্রদেশ) এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীনা উপস্থিতি বৃদ্ধির কারণে।

এর সম্ভাব্য সুবিধা : আঞ্চলিক কূটনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা : ভারত Quad ও পশ্চিমা জোটের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারে।প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়ন : চীনের সামরিক প্রদর্শনী ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট ও দেশীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদন (Make in India) বাড়ানোর চাপ তৈরি করবে। কৌশলগত নেতৃত্ব : দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে ছোট দেশগুলো ভারতের নিরাপত্তা ছাতার প্রতি আরও ঝুঁকতে পারে।উভয় দিক থেকে সুবিধা নিতে পারে। বার্তা : চীন স্পষ্টভাবে ভারতকে জানাচ্ছে যে, তাদের সামরিক সক্ষমতা এখন আঞ্চলিকভাবে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে ভারতকে আরও সতর্ক হতে হবে।

এর সম্ভাব্য সুবিধা : সরাসরি সুবিধার চেয়ে চাপ বেশি। তবে চীনের উত্থান ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া-Quad) আরও শক্তিশালী করার সুযোগ তৈরি করে। ভারত প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে সামরিক শিল্প উন্নত করার চাপের মধ্যে পড়বে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্থানীয় প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। পাকিস্তানের কাছে এটি একটি আশ্বাস—চীন শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামরিকভাবেও নির্ভরযোগ্য অংশীদার।ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পাকিস্তান তার অবস্থানকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগাতে পারবে। এর সম্ভাব্য সুবিধা : সামরিক সহায়তা : চীন-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা সহযোগিতা (যেমন JF-17 যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা) আরও শক্তিশালী হতে পারে।অর্থনৈতিক সুবিধা : চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)-এর মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়তে পারে, যা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে কিছুটা স্থিতিশীল করবে।কূটনৈতিক সমর্থন : ভারতবিরোধী আন্তর্জাতিক আলোচনায় চীন পাকিস্তানকে আরও জোরালোভাবে সমর্থন দিতে পারে। পাকিস্তানের জন্যে এটি ইতিবাচক বার্তা—'চীন তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টর'। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)-এর নিরাপত্তা সুরক্ষায় চীনের সামরিক শক্তি এক ধরনের আশ্বাস দিচ্ছে। এর সম্ভাব্য সুবিধা : সামরিক সহযোগিতা : পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে চীনের কাছ থেকে ফাইটার জেট, ড্রোন, নৌ সরঞ্জাম ইত্যাদি পেয়ে আসছে। নতুন প্রযুক্তি তাদের হাতে দ্রুত পৌঁছাতে পারে। ভারতের বিপরীতে ভারসাম্য : চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক আরও গভীর হলে ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিমুখী চাপের মুখে পড়তে হবে। অর্থনৈতিক বিনিয়োগ : CPEC-এর নিরাপত্তা জোরদার হওয়ায় পাকিস্তান নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে। আসুন এবার গণমাধ্যম সূত্রে জেনে নেই বিশ্বের কাছে মোদির চীন সফরের বার্তা কতখানি ও কী ইঙ্গিত বহন করে--

১. কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন (Strategic Autonomy)

মোদি এবং শি জিনপিং 'পার্টনার, নট রাইভালস'—এই ধারণা উভয় পক্ষেরই বিবৃতিতে উঠে এসেছে, যা ভারতের দূরদর্শী কূটনীতি তুলে ধরে ReutersThe Indian Express।

ভারত স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে—তৃতীয় কোনো দেশের প্রভাব ছাড়াই তার সম্পর্ক নির্ধারিত হবে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে।

২. পশ্চিমের জন্যে বিকল্প কূটনীতি

মোদি-চীনের এই ঘনিষ্ঠতা 'নন-ওয়েস্টার্ন অ্যালায়েন্স' গঠনের লক্ষ্যে এক শক্তিশালী সম্মতি হিসেবে দেখা হচ্ছে The GuardianAxios।

মোদি-শি-পুতিনের ট্রাইমোচর (troika) মৈত্রীতে প্রদর্শিত ঐক্য মার্কিন নীতিমালার বিরুদ্ধে একটি গুণবহুল প্রতিবাদ। The Sun,The Wall Street Journal, The Times of India।

৩. কোনো আড়াল নয়—পরীক্ষিত সীমান্ত শান্তি প্রয়োজন

সীমান্তে 'শান্তি ও স্থিতিশীলতা' বজায় রাখা দুই দেশের জন্যেও প্রাধান্য ছিলো। Reuters, The Economic Times।

এটি গ্রন্থিত করেছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের 'এছাড়া পরিস্থিতি' থেকে মুক্তির পরিপ্রেক্ষিত।

৪. অর্থনৈতিক নতুন সূচনা

মোদি এবং শি দুইদিকে বাণিজ্য অর্গানাইজেশনে সমন্বয় বাড়িয়ে, ভারতের বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি এবং মার্কিন ট্যারিফে সৃষ্ট চাপ কমানোর সূচনা করেছেন। ReutersThe Economic Times+1।

৫. ধর্মনিরপেক্ষ কূটনীতি ও শক্তির ব্যালান্স

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, মোদি টেকনিক্যাল 'রিক (RIC) ত্রয়ী' গড়ার পথ খুলছে—যেখানে ভারত, চীন ও রাশিয়া একটি আকস্মিক শক্তি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতে পারে, পশ্চিমা আধিপত্যের বিকল্প হিসেবে Sputnik India।

তবে, ET মতামত অনুযায়ী—শান্তির পরিপ্রেক্ষিতে এটা বড় 'থাও' নয়, বরং ভারতীয় 'realpolitik' বা বাস্তববাদের কূটনীতির প্রয়োগ The Economic Times।

৬. সামরিক ও প্রতিরক্ষায় সক্রিয় ভারসাম্য

সোভিয়াম্প্রকাশ, মোদি-শি-পুতিনের মৈত্রী শুধু বিন্দুমাত্র অস্বস্তি নয়, এটি পশ্চিমা হিমশীতলতায় এক চ্যালেঞ্জ। The SunAxiosThe Wall Street Journal।

এর ফলে ভারত তার প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক সম্ভাবনাকে আরও বহুমাত্রিক করে তুলছে।

৭. অনুমাপক বার্তা—পাকিস্তানকে সতর্কতা

SCO-তে পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের উপস্থিতিতে মোদি জোরালো বার্তা প্রদান করেছেন—"যেসব দেশ সন্ত্রাসকে সমর্থন করে, তাদের অগ্রাধিকার নেই" The Economic Times,The Times of India।

এটি ভারতীয়ত্বকে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ নীতি মোতায়েনের দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছিল।

চীনের মহাসামরিক প্রদর্শনী ও বহুধুর্ত্ব বিশ্বব্যবস্থার প্রত্যয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নতুন এক বাস্তবতায় দাঁড় করিয়েছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়া, চীন, ভারতসহ উদীয়মান শক্তিগুলো নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট। এর ফলে বিশ্বব্যবস্থা ক্রমশ বহুমুখী হলেও তা একইসাথে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্যে এই পরিস্থিতি একদিকে সুযোগ, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার নতুন দিগন্ত খুলতে পারে, ভারত তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখে দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে চাইছে, আর পাকিস্তান চীনের ঘনিষ্ঠতায় নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে সহায়তা পাচ্ছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চীন সফর এ বার্তাই দেয় যে, ভারত বৈশ্বিক রাজনীতিতে নিজের অবস্থানকে স্বাধীনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চায় এবং পশ্চিমা বা চীন-কেন্দ্রিক কোনো একক ব্লকের সাথে সম্পূর্ণ আবদ্ধ নয়।

সব মিলিয়ে বলা যায়, বর্তমান বিশ্ব এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। বহুধুর্ত্বের পথে এগোনো যদি পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে হয়, তবে তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু যদি প্রতিযোগিতা ও সামরিকীকরণের দিকেই ঝুঁকে পড়ে, তবে তা নতুন এক শীতল যুদ্ধের আকার ধারণ করতে পারে, যা বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যে গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

ড. আজিজুল আম্বিয়া : কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়