প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৫, ০৮:৪৬
স্মৃতির ঘর, শূন্য উঠোন

এটা সত্যি, আগের দিনের ভাইবোনের সম্পর্কগুলোতে যেমন আন্তরিকতা, নির্ভরতা আর একে অপরের প্রতি টান ছিলো, আজকের দিনে সেটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। জীবনের নানা ব্যস্ততা, সামাজিক প্রতিযোগিতা, পারিবারিক বিভাজন আর প্রযুক্তির একাকীত্ব আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দায়িত্ব বাড়ে, চিন্তা বাড়ে, কিন্তু ভালোবাসা কেন কমে যায়? ছোটবেলার সেই এক টুকরো চকোলেট ভাগ করে খাওয়া, মায়ের বকুনি থেকে পালিয়ে একসাথে লুকানো, রাত জেগে গল্প করার দিনগুলো আজ স্মৃতির পাতায় বন্দী। এখন সবাই যার যার পরিবার, ক্যারিয়ার, চাপ, দায়িত্বে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবুও সম্পর্কের প্রাণ থাকে যত্নে একটু ফোন কল, একটু খোঁজখবর, একটু ছোট দেখা আবার আগের সেই টান ফিরিয়ে দিতে পারে। ভাইবোনের সম্পর্ক এমন এক সম্পদ, যা সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে গেলে ফেরত পাওয়া কঠিন। তাই যতোটা সম্ভব আগলে রাখা উচিত। কারণ এ বন্ধন শুধু রক্তের নয়, হৃদয়েরও। সময়ের সাথে মানুষ নিজের জীবন, পরিবার, ক্যারিয়ার, দায়িত্ব সবকিছুর মধ্যে এমনভাবে গেঁথে যায় যে, কাছের মানুষগুলো ধীরে ধীরে ‘অগ্রাধিকার তালিকা’ থেকে সরে যায়।
একসময় যাদের সাথে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভাগ করে নিয়েছি, আজ তারা অনেকটাই ব্যস্ত, দূরে কিংবা চুপচাপ। কেউ হয়তো ভেবেই নেয়’ও ভালো আছে, ব্যস্ত থাকবে, আর ফোন না করলেও চলে।’ এই ভেবে ভেবেই আমরা সবাই নিজেদের গুটিয়ে ফেলি। আর তাতে দূরত্বটা শুধু সময় বা দূরত্বের কারণে হয় না, হয় অনুভবের অভাবে। কিন্তু সম্পর্ক তো চর্চার বিষয়। যত্ন না নিলে বন্ধন নষ্ট হয়। আর সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, যখন সবাই উপলব্ধি করে‘সময় তো ছিল, শুধু একটু আন্তরিকতা দরকার ছিলো।’ তবু আশার কথা, যত দেরি হোক না কেন, একটি ফোন, একটি বার্তা, একটি দেখা সবকিছু বদলে দিতে পারে। চাই শুধু সত্যিকারের ইচ্ছা। রক্তের সম্পর্ক ভোলা যায় না, ভোলা উচিতও নয়। সংসারে মান-অভিমান, মতবিরোধ, ঝগড়া সবই স্বাভাবিক। কারণ আমরা মানুষ, আমাদের আবেগ আছে, মতভেদ আছে। কিন্তু এই ভিন্নতা সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণ হতে পারে না। রক্তের সম্পর্ক মানে শুধু জন্মসূত্র নয়-এটা শেকড়, এটা আত্মিক টান, যেটা সময়ের ক্ষণে ক্ষণে ধুলো পড়লেও একটুখানি ভালোবাসা, ক্ষমা আর আন্তরিকতা দিয়ে ঝেড়ে ফেলা যায়। ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ক্ষমা করাটা সম্পর্কের আসল সৌন্দর্য। যে পরিবারে মান থাকে, সেখানে মায়া থাকলে সম্পর্ক ভাঙ্গে না-বরং আরও দৃঢ় হয়। রাগ-অভিমান হতেই পারে, কিন্তু একটিবার ভাবা দরকার, যাদের হারালে ফিরে পাওয়া যাবে না, তারা তো নিজেরাই। সম্পর্ক রক্ষা করাই শেষ পর্যন্ত আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
ঝামেলা তো সর্বত্রই। দেশের সঙ্গে দেশের, দলের সঙ্গে দলের, মতের সঙ্গে মতের, ধর্মের সঙ্গে ধর্মের-সবখানেই মতবিরোধ, টানাপোড়েন। মানুষের স্বার্থ, ক্ষমতা, অহং-এই সবই দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঝামেলাগুলো কি অনিবার্য? না কি এগুলোকে আমরা আরো জটিল করে ফেলি নিজেদের সীমাবদ্ধ মানসিকতা, সহনশীলতার অভাব আর আধিপত্যের লড়াইয়ে? একটু সহানুভূতি, সহনশীলতা, আর মানবতা যদি আমাদের ভেতরে থাকতো, তাহলে হয়তো ধর্ম হতো হৃদয়ের আর দল হতো দায়িত্বের। ঝগড়া-সংঘাত নয়, হতো সহাবস্থান।
সংসার মানেই হলো ভিন্ন ভিন্ন মন, মানসিকতা আর অভ্যাসের মানুষের একত্রে বসবাস। কেউ বই পড়ে চিন্তা করে, কেউ বাস্তবতাকে চোখের সামনে রাখে, কেউ আবার আবেগ দিয়ে সবকিছু মেপে দেখে। এই ভিন্নতা থেকেই আসে ভুল বোঝাবুঝি, মতানৈক্য, কখনও আঘাত। তবুও এটাই সংসারের সৌন্দর্য। সংসার টিকে থাকে ধৈর্য, সহনশীলতা, আর ভালোবাসার ওপর ভর করে। এখানে সবাইকে একটু ছাড় দিতে হয়। কখনো মুখ বুঁজে সহ্য করতে হয়, আবার কখনো একটু আলতোভাবে কথাটা বলে দিতে হয়। কারণ, সংসার মানেই একসাথে পথ চলা-চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, ভুলে গিয়ে ছোটখাটো দ্বন্দ্ব, আঁকড়ে ধরে সম্পর্কের শেকড়। আর এই মানিয়ে নেওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে শান্তির স্বপ্ন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন অনেক সংসারে এই মানসিকতাটাই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সবাই নিজের জায়গা থেকে ঠিক থাকতে চায়, কিন্তু অন্যকে বোঝার চেষ্টাটা কমে গেছে।
‘আমি কেন ছাড় দেব?’-এই প্রশ্নটাই জায়গা করে নিচ্ছে হৃদয়ের জায়গায়। ফলে ছোট বিষয়েও বড়ো হয়ে উঠছে দূরত্ব, কথা হচ্ছে না, সম্পর্ক শীতল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ তো প্রথম হতে হবে-প্রথমে কথা বলা, ক্ষমা চাওয়া বা বোঝার চেষ্টা। সেটা না করলে সংসার শুধু টিকে থাকে, বাঁচে না। পরিবার মানে তো একসাথে বেঁচে থাকা, শুধু দেয়াল ভাগ করে নয়-মন ভাগ করে, সময় ভাগ করে, আনন্দ দুঃখ ভাগ করে। যদি সবাই শুধু নিজের স্বার্থ দেখে, তাহলে তো সেটা শুধু একসাথে থাকা নয়, একটা মানসিক শূন্যতা। তবুও যারা বুঝতে পারে, অনুভব করতে পারে, তাদের দিয়েই কিছুটা হলেও সম্পর্কগুলো জীবিত থাকে।
এই জীবন ক্ষণস্থায়ী। জন্ম থেকে মৃত্যু-এই ছোট্ট ব্যবধানে আমরা কতো ঝামেলা, অভিমান, অহংকার জমিয়ে রাখি! অথচ শেষ পর্যন্ত সবই ফেলে রেখে চলে যেতে হয়, কেউ কিছু সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না। তাহলে কেন এতো বিবাদ? কেন ভাইয়ে ভাইয়ে দূরত্ব, বন্ধু হয়ে পর হয়ে যাওয়া, আত্মীয় হয়ে অপরিচিত হয়ে যাওয়া? জীবনটা আসলে ভালবাসা, ক্ষমা আর সহানুভূতির জন্যে। একটু হাসি, একটু ফোন, একটু আন্তরিকতা অনেক ভাঙ্গা সম্পর্ক জোড়া লাগাতে পারে। কিন্তু আমরা অনেকেই সেটা বুঝতে বুঝতেই দেরি করে ফেলি, হয়তো চিরতরের জন্যে। চেষ্টা করা উচিত, যতোটা পারি ততোটা আলো ছড়িয়ে যাওয়ার। কারণ আমরা সবাই একদিন চলে যাবো, থেকে যাবে শুধু আমাদের আচরণ, ভালোবাসা আর সম্পর্কের স্মৃতি। তাই এই মুহূর্তটাকে মূল্য দিই, মানুষকে জড়িয়ে ধরি, ক্ষমা করে দিই, আর যতোটা পারি ভালোবাসি। ছোট্ট এই জীবনে এটুকুই তো সত্য। গভীর বাস্তবতা এটাই। মা-বাবা যেন পরিবারের এক অদৃশ্য ছায়া, যার ছায়ায় সবাই একত্রিত থাকে, ঝগড়া-অভিমান হলেও আবার একসাথে বসে, কথা হয়, দেখা হয়। কিন্তু সেই ছায়া যখন সরে যায়, তখন যেন সবাই আলাদা হয়ে যায়, ধীরে ধীরে। একটা সময় ছিলো, সবাই মা-বাবার ঘরে এসে জড়ো হতো, একসাথে খাওয়া, হাসি, স্মৃতি ভাগ করে নেওয়া-সবই থাকতো। কিন্তু তাদের না-থাকা মানেই যেন সেই কেন্দ্রবিন্দুটা হারিয়ে ফেলা। সম্পর্ক থাকে, কিন্তু যোগাযোগ ফিকে হয়ে যায়, সময়ের ব্যবধানে আরও দূরত্ব বাড়ে। এটা দুঃখজনক হলেও অনেক পরিবারেই এমনটা হয়। তবু, যদি কেউ একজন চেষ্টাটা করে, সেই ভাঙ্গা সুতোটা আবার গাঁথা যায়। মা-বাবার জন্যে যেমন একসাথে হতে পারতাম, তাদের স্মৃতির জন্যেও তো হতে পারি। কারণ মা-বাবা চাইতেন সবাই একসাথে থাকুক-ভালবাসায়, শ্রদ্ধায়, সম্মিলনে। সেই চাওয়া রক্ষাটাও একধরনের শ্রদ্ধা তাঁদের প্রতি।
মা-বাবা চলে যাওয়ার পর সংসার যেন হয়ে যায় একটা খোলা জানালার ঘর, যেখানে আলো আসে, বাতাস আসে, কিন্তু একসাথে বসে গল্প করার মানুষগুলো আর থাকে না। ভাইবোনেরা ছড়িয়ে পড়ে যার যার ব্যস্ত জীবনে, দেখা হয় কদাচিৎ, কথা হয় তাও দায়সারা। অথচ একসময় এক উঠোনে পা ফেলে আমরা বড় হয়েছিলাম। এখন সেই উঠোন আছে, কিন্তু হেঁটে বেড়ানোর মতো সম্পর্কগুলো নেই। সময়ের স্রোতে ভালোবাসা হয়তো মুছে যায় না, কিন্তু তার প্রকাশ হারিয়ে যায়, শুধু থেকে যায় কিছু স্মৃতি, কিছু না বলা কথা, আর একটা দীর্ঘশ্বাস।