প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:৫৭
একশত চার বছর পরও ‘বিদ্রোহী’ প্রাসঙ্গিক—হাদীর আবৃত্তি ও আমাদের সময়ের অস্বস্তিকর সত্য
বিদ্রোহী কণ্ঠ থামিয়ে দেওয়া যায়, চেতনাকে নয়
হাদীর মৃত্যু, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ ও রাষ্ট্রের বিবেকের কাঠগড়া
শতাব্দীর অগ্নিবীণা ও একবিংশর বিদ্রোহী
|আরো খবর
১৯২১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম যখন 'বিদ্রোহী' রচনা করেন, সেটি কেবল ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে কোনো পঙক্তিমালা ছিল না; সেটি ছিল শৃঙ্খলিত মানুষের আত্মার আর্তচিৎকার। আজ একশ চার বছর পর, দমনের অবয়ব বদলেছে কিন্তু প্রেক্ষাপট বদলায়নি। এই সময়ে দাঁড়িয়ে তরুণ আবৃত্তিকার হাদীর কণ্ঠে নজরুলের সেই অবিনাশী শব্দগুলো যখন নতুন প্রাণ পায়, তখন তা নিছক শিল্প থাকে না—তা হয়ে ওঠে সমকালীন অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক জীবন্ত ইশতেহার।
হাদীর উচ্চারণে 'বিদ্রোহী' ছিল ক্ষুরধার ও সংবিৎ-জাগানিয়া। তিনি যখন বলতেন, "আমি চির-উন্নত শির", তখন তা কেবল কবিতার অংশ মনে হতো না; মনে হতো একবিংশ শতাব্দীর এক তরুণের আত্মমর্যাদার ঘোষণা। হাদী আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, বিদ্রোহ মানে বিশৃঙ্খলা নয়—বিদ্রোহ মানে শোষণের কাঠামোর সামনে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সাহস।
একটি আয়না এবং রাষ্ট্রের অস্বস্তি
কিন্তু আজ সেই দ্রোহী কণ্ঠ নীরব। হাদীর আকস্মিক প্রস্থান কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়; এটি রাষ্ট্র ও সমাজের বর্তমান অবস্থার ওপর এক নিষ্ঠুর আয়না। যে কণ্ঠটি ভয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করে সত্য উচ্চারণ করেছিল, তার পরিণতি আজ নাগরিক সমাজের সামনে এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে: "এই জনপদে সত্যের মূল্য কি তবে জীবন দিয়ে পরিশোধ করতে হবে?"
হাদীর আবৃত্তি কোনো বিমূর্ত সাহিত্যচর্চা ছিল না, বরং তা ছিল নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রতিবাদের এক রাজনৈতিক দলিল। আজ যখন তার সেই ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সংবাদপত্রের পাতায় ভেসে ওঠে, তখন তা কেবল স্মৃতিচারণ নয়—তা হয়ে দাঁড়ায় আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার এক নাগরিক সাক্ষ্য।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও নৈতিক দেউলিয়াপনা
রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ যদি নাগরিকের বাকস্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তবে সেই রাষ্ট্র তার নৈতিক কর্তৃত্ব হারায়। হাদীর মৃত্যু নিয়ে রাষ্ট্রের দীর্ঘ নীরবতা কিংবা তদন্তের ধীরগতি আসলে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’এর এক নগ্ন প্রকাশ। আমরা কি তবে এমন এক সমাজে বাস করছি যেখানে প্রশ্ন করা বারণ, আর প্রতিবাদ মানেই বিপন্ন হওয়া?
নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা আমাদের শিখিয়েছিল—অন্যায়কে ধ্রুব বলে মেনে নিলেই পরাজয় নিশ্চিত। হাদী সেই শিক্ষার ধারক ছিলেন। তার এই প্রস্থান আমাদের এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়েছে। এই নীরবতা ভাঙা আজ অপরিহার্য। একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা ছাড়া এই ক্ষতের নিরাময় অসম্ভব।
উপসংহার: দায় এড়ানোর সুযোগ নেই
নজরুলের 'বিদ্রোহী' আজও আমাদের প্রশ্ন করে—আমরা কি বিদ্রোহকে কেবল কাগজের পৃষ্ঠায় বা জলসার মঞ্চে বন্দি রাখব, নাকি বাস্তবে তার আদর্শের মর্যাদা দেব? হাদীর কণ্ঠ সাময়িকভাবে স্তব্ধ করে দেওয়া সম্ভব হলেও, তার রেখে যাওয়া প্রশ্নগুলো আজ আমাদের প্রত্যেকের দরজায় কড়া নাড়ছে।
হাদীর এই নীরবতা আসলে এক প্রচণ্ড চিৎকার। এই হাহাকার উপেক্ষা করা মানেই চলমান অন্যায়কে পরোক্ষভাবে বৈধতা দেওয়া। মনে রাখা প্রয়োজন, সময়ের প্রয়োজনে সত্য না বলাও এক প্রকার অপরাধ। হাদী তার কাজ করে গেছেন; এবার উত্তর দেওয়ার পালা আমাদের।








