সোমবার, ২০ মে, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ

প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

কুড়িয়ে পাওয়া দিনগুলো

সরকার আবদুল মান্নান
কুড়িয়ে পাওয়া দিনগুলো

মেয়েটির নাম রাবেয়া বেগম নাকি রাহেলা বেগম ঠিক মনে নেই। ফোর পর্যন্ত আমার সঙ্গে পড়েছে। হাতে-পায়ে বেশ লম্বা, বড় বড় ডাগর চোখ, পিঠ পর্যন্ত লম্বা রাজ্যের চুল। চুলের জন্য অনেক সময় ওকে দেখাই যেত না। সেই চুলে কোনো দিন তেল পড়েছে কি না সন্দেহ। সাবান দিয়ে পরিষ্কার করার মতো সামর্থ্যও ওদের ছিল না।

রাবেয়া স্কুলে আসত নামমাত্র, কালেভদ্রে। তিন-চারটা ছাগল নিয়ে সারক্ষণ মাঠে-ঘাটে, খালের ধারে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতন ওকে। ধান কাটার দিনগুলোতে ঝড়া ধান টোকানো কিংবা ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান উদ্ধার করা- এই সব ছিল রাবেয়ার সব চেয়ে জরুরি কাজ।

বর্ষার দিনে কৃষকরা পানিতে ডুব দিয়ে দিয়ে সারাক্ষণ পাট কাটত। তাদের শরীরের উত্তাপ যখন কমে যেত, যখন ঠাণ্ডায় কাঁপন ধরত শরীর জুড়ে, তখন জয়নাগাজী বলত, ও রাবেয়া, তামক বানাইছস? বানা বানা, তামক বানা এক ছিলিম।

তারপর নৌকায় ওঠে বসত জয়নাগাজী। রাবেয়া অবাক হয়ে যেত। বলত, ও কাকু, কাকু? আমনের কি কোনো শোধবোধ নাই। শইল ভরা তো জোঁক। রক্ত খাইয়া ঢোল অইয়া আছে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে ডুবালে শরীরে কোনো অনুভূতি থাকে না। জয়নাগাজী টেরই পেত না যে আট-দশটি জোঁক তার শরীর থেকে রক্ত চুষে নিচ্ছে। রাবেয়া কাচি দিয়ে ছেচে ছেচে জোঁকগুলো শরীর থেকে আলাদা করে ফেলত। কিন্তু কাজটি সহজ ছিল না মোটেই। যারা রক্ত খেয়ে ঢোল হয়ে আছে, তাদের ছাড়াতে কষ্ট হতো না। কিন্তু যারা মাত্র রক্ত খেতে শুরু করেছে, তাদের ছাড়ানো কঠিন ছিল। রাবেয়া এই কঠিন কাজটি করত। জোঁকগুলো যখন সব ছাড়ানো শেষ হতো, তখন জয়নাগাজী হুকায় দম দিত আর রাবেয়া জোঁকগুলোকে একত্র করে তাদের উপর লবণ ছিটিয়ে দিত।

জোঁকের শত্রু লবণ। লবণ মুখে গেলে ওদের পেটের রক্ত সব বেরিয়ে আসে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জোঁকগুলো মারা যায়। রক্তচোষা জোকগুলোকে আনন্দের সঙ্গে মারত রাবেয়া। আর জয়নাগাজীকে জিজ্ঞাসা করত, কাকু, অ কাকুণ্ড আল্লায় জোঁক বানাইছে কিলিগা? জোঁক বানানোর দরকারটা কী?

জয়নাগাজীর মধ্যে তখন আধ্যাত্মিক ভাব জেগে উঠে। গভীর একটি নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, বোঝা দায় গো মা, বোঝা দায়। আল্লার কুদরত কি কেউ বুঝতে পারে?

জয়নাগাজীর কথা রাবেয়া কিছুই বোঝে না। কিন্তু কাকুকে যে ভাবুক করা গেল এবং ভাবনার একটা আনন্দ যে কাকুর মধ্যে তৈরি হয়েছে, সেই আনন্দে রাবেয়াও ভিতরে ভিতরে আনন্দিত হয়ে ওঠে। ভরশা পেয়ে তাই জয়নাগাজীকে বলে, আচ্ছা কাকু, আমনের এই ধুয়া খাইয়া লাভটা কী, কন? পেট ভরে ধুয়ায়? চাউল ভাজা আনছি, মডর ভাজা আনছি। সিম ভাজা আনছি। তা খাইবেন না- খাইবেন ধুয়া।

রাবেয়ার কথায় জয়না গাজী মজা পায়। হাসে। বলে, পেট ভরে না রে মা। পেট ভরে না। শইলডা গরম অয় একটু। কপট রাগ করে তখন রাবেয়া বলে, হ, অনেক গরম করছেন শইল। এখন চাউল ভাজা খান। গুড় দিয়া চাউল ভাজা।

রাবেয়া বাবাকে দেখেনি। মায়ের কোনো স্মৃতিও নেই। চাচার সংসারে আছে। চাচা-চাচির হতদরিদ্র সংসারে ওর আদরের অভাব নেই। অভাব তিন বেলা পেট ভরে খাওয়ার আর জামা-কাপড়ের। রাবেয়া এ সবকে পাত্তা দেয় না। ও থাকে সারাক্ষণ আনন্দে। শুধু কারো কষ্ট দেখলে ও যে কেন এত কষ্ট পায় তা বোঝা মুশকিল।

প্রতিবেশী সাহিদা ওর সারাক্ষণের সঙ্গী। সেই সাহিদার ছোট ভাই অন্তু হাঁটতে শিখেছে। হেঁটে হেঁটে সে পড়ল গিয়ে ছাইয়ের স্তূপে। পা ঢুকে গেল ছাইচাপা আগুনের মধ্যে। দুই পা আর দুই হাত পুড় গেল অন্তুর। ডাক্তার কবিরাজ হচ্ছে। কিন্তু রাবেয়ার মন পুরে না কিছুতেই।

খালা, খালা গো, অন্তুরে ঢাহায় নেওন যায় না। ঢাহায় অনেক বড় বড় ডাক্তর থায়ে। মরা মানুষ জিন্দা করতে পারে। অন্তুরে ঢাহা লইয়া যান খালা।

সাহিদার মার কান জালাপালা করে ফেলে রাবেয়া । বিরক্ত হয়ে সাহিদার মা বলে, টেহা পামু কই ক? তুই দিবি টেহা? পানু ডাক্তর টেহা চায়। দিতে পারি না। কয় দিন অসুধ দিব বাহি? ক?

রাবেয়া দমে যায় না। বলে, খালা আমার তিনডা ছাগল আছে। একটা বেইচ্যা দিলে অইব না। পঞ্চাশ টেহা বেচন যাইব।

সাহিদার মা খুব ভিতর থেকে কেমন একটা মায়া অনুভব করে। চোখ ভিজে যায় জলে। রাবেয়াকে কাছে টেনে নেয়।

হ, মা, অইব। তোর ছাগল বেচন লাগব না। পানু ডাক্তর কইছে বালা অইয়া যাইব। ঢাহা নিতে অইব না।

রাবেয়া আর আমি এক ক্লাসেই পড়ি। ক্লাস ফোরে। রাবেয়া কী যেন খাচ্ছিল। আমি বললাম, অ রাবেয়া, কী খাছ, ছাগলের লাদি?

পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেলাম। মহা বিরক্ত হয়ে রাবেয়া এক মুঠি বালি ছিটিয়ে দিল আমর চোখে। আমি আর কিছুই দেখছিলাম না। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পুকুর-ঘাটে যেতে চাইলাম। কিন্তু তাও ঠিক মতো ঠাওর করতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে চোখের কোণ খুলে পুকুর ঘাটে গিয়ে অনেক্ষণ পানি দিলাম। যন্ত্রণা লাগব হলো। কিন্তু চোখ রক্তজবা হয়ে উঠল। ফুলেও গেল কিছুটা। গ্রামীণ জীবনে এই সব ঘটনা-দুঘর্টনা ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। এর জন্য ডাক্তার-কবিরাজ করা তো দূরের কথা- মা-বাবা ও বড় ভাই-বোনকেও জানানো হতো না কখনো। কিল খেয়ে কিল হজম করার মতো অনেক দুঘর্টনাই আমরা হজম করতাম।

পরের ক্লাসে আমি পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। কারণ বৃদ্ধ সিরাজ স্যার কী বলতে কী বলবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। নোংরা ভাষায় গালাগাল দেওয়া, অকথ্য নির্যাতন করার জন্য তিনি খুবই কুখ্যাত শিক্ষক ছিলেন। আমার চোখ রক্ত জবার মতো লাল দেখলে তিনি হয় তো বলবেন, কি রে হাইক্কার পুত, গাজা খাইছস কয় ছিলিম? আমি হয় তো জানিই না যে গাজা কী জিনিস।

একবার ফোরের এক ছাত্র ওই ক্লাসেরই এক ছাত্রীকে ধাক্কা দিয়েছিল। সিরাজ স্যার দেখে বললেন, কিরে আইল্যার বাচ্চা, ছেমডিরে বিয়া করবি তুই?

কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলে তাকে ধাক্কা দিতে হয় তা আজও দেখিনি। বরং চড়চাপড় খাওয়ার কথা শুনেছি।

রক্তজবা চোখ নিয়ে পিছনের বেঞ্চে বসেও খুব সুবিধা করতে পারলাম না। পড়াশোনায় একটু ভালো হলে এই হলো মুশকিল। সিরাজ স্যার ক্লাসে ঢুকে যখন দেখলেন, আমি পিছনের বেঞ্চে বসা, তখন চিৎকার করে উঠলেন। বললেন, ওই হাইক্কার পুত, পিছনে গিয়া বইছস কিলিগা? শয়তানে কামড়ায়?

আমি মাথা নিচু করে সামনে এসে বসলাম। তেড়া চাহনি দিয়ে দেখছিলাম, রাবেয়া হাসে। মেজাজটা যারপর নেই খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, রাবেয়া, কঠিন শাস্তি দেব তোকে।

যেমন প্রতিজ্ঞা তেমনি কাজ। সিরাজ স্যারে ক্লাস শেষ হওয়ার পরেই এক দৌড়ে চলে গেলাম স্কুলের পিছনে খালের পাড়ে ঘাগরা বনে। দুই-তিন মুঠ ঘাগরা পকেটে পুরে মুহূর্তের মধ্যে চলে আসলাম স্কুলে আর তক্কে তক্কে থাকলাম সুযোগের। যখনই সুযোগ পবো তখনই রাবেয়ার পাখির বাসার মতো উসকো-খুশকো চুলে লাগিয়ে দেবো ঘাগরার বিচি। চুল না-কেটে উপায় থাকবে না ওর।

সুযোগ পাওয়া গেল। দুই মুঠো ঘাগরার বিচি খুব ভালো করে লাগিয়ে দেওয়া গেল রাবেয়ার পিঠ অবদি নেমে পড়া শুষ্ক চুলগুলোর মধ্যে। ভেবেছিলাম চিৎকার-চেচামিচি আর গালাগাল দিয়ে রাবেয়া সোজা বাড়িতে চলে যাবে। ওর যা স্বভাব তাতে আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি রাবেয়া সোজা আমাকে পাঠিয়ে দেবে জমের কাছে।

ক্লাস নিয়ে সিরাজ স্যার তখন স্টাফ রুমে গিয়ে বসেছেন। সিদ্দিক স্যার আর অরুণ স্যার ক্লাসে গিয়েছেন। এই সময় রাবেয়া ওর বিপর্যস্ত চুলের করুণ পরিণতি নিয়ে বিচার দেয় সিরাজ স্যারের কাছে।

সিরাজ স্যার মুহূর্তের মধ্যে আমাকে ধরে ফেলেন। টেনে নিয়ে যান স্টাফ রুমে। আমার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে বলেন, ওই হাইক্কার পুত, ছেমড়ির মাতায় ঘাগরার বিচি দিছস কিলিগ্যা? অয় কি তোর বউ?

বউ-এর চুলে কেউ ঘারার বিচি দিয়েছে কি না জানি না। শ্যালিকার চুলে কোনো রসিক দুলা ভাই দিতে পারে। আমি কেন দিয়েছি তার কার্যকারণের ধারে-কাছে না-গিয়ে শাস্তি বিধান করে ফেললেন সিরাজ স্যার।

দে। কাউট্টা চেঙ্গি দেয়। পাছা উপ্রে তোল।

আমি পশ্চাৎদেশ যতটা সম্ভব উপরে তুলে দুই পায়ের নিচে দিয়ে হাত এনে কান ধরলাম। আমার পশ্চাৎদেশ কিছুটা নিচু আন্দাজ করে সপাৎ সপাৎ দুই ঘা লাগিয়ে সিরাজ স্যার চলে গেলেন প্রতিবেশী বাড়িতে পান খেতে।

আমি তো কাউট্টা চেঙ্গি দিয়েই আছি। আমার প্রতি শাস্তি দেখার জন্য রাবেয়া কাছে-পিঠেই ছিল। কয়েক মিনিট শাস্তিটা ওর কাছে আনন্দদায়কই মনে হয়েছে। কিন্তু তার পরেই সে বুঝতে পারল ঘটনাটা নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে। রাবেয়া স্টাফ রুমে ঢুকে বলল, এই চঞ্চল, স্যারে নাই। লতাগ বাইত পান খাইতে গেছে। ছাইড়া দে। কাউট্টা চেঙ্গি ছাইড়া দেয়।

কউট্টা চেঙ্গি আমি যখন আর ছাড়ছি না, তখন রাবেয়া এক দৌড়ে চলে যায় লতাদের বাড়িতে। সিরাজ স্যারকে বলে, অ স্যার, চঞ্চল ত মইরা যাইতেছে। অর চৌখ দিয়া রক্ত পড়তাছে।

পড়ি কি মরি করে যখন সিরাজ স্যার স্কুলে এসে পৌঁছান ততক্ষণে সিদ্দিক স্যার আমাকে উদ্ধার করে পুকুর ঘটে নিয়ে মাথায় পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। আর সিরাজ স্যারকে বলছেন, সিরাজ সাহেব, আমনে কি বুড়া অইছেন বাতাসে? ছেমড়ারে কাউট্টা চেঙ্গি দিয়া আমনে গেছেন পান খাইতে। আমনের কোনো বোধশোধ আছে বইল্যা তো মনে অয়না। খারাপ কিছু অইয়া গেলে বুঝতেন কত ধানে কত চাউল।

সন্ধ্যায় রাবেয়া আমাকে খুঁজতে আসে। পেয়েও যায় কাচারি ঘরের সামনে। রাবেয়া বলে,

কষ্ট পাইছস খুব?

পাইলে পাইছি। জিগাইয়া তোর কাম কী?

আমাগ বাইত যাবি? চাচি তোর লইগ্যা দুহি পিডা বানাইছে।

তোগ দুহি পিডা খাই না।

এই দ্যাক। বিদ্যা ছুঁইয়া কই। আর এমন অইত না। আয়। আমার লগে আয়। চাচি তোর লইগ্যা বইয়া রইছে। আমিও খাই নাই। তোরে লইয়া খামু।

রাবেয়া আর আমি যখন বাপা পিঠা খাচ্ছিলাম তখন রাবেয়া যতনা খাচ্ছিল তার চেয়ে বেশি আমার খাওয়া দেখছিল আর আশ্চর্য এক আনন্দ অনুভব করছিল। ওর গোপন হাসি এখনো আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে।

পিঠা খেয়ে আমি যখন বাড়ি ফিরছিলাম রাবেয়া তখন একটি পিঠার কিছু অংশ আমার প্যান্টের পকেটে পুরে দেয়। ওর হাতের স্পর্শ এখনো আমি অনুভব করি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়