প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৫, ০৯:১৩
মাসমাক দুর্গ : সৌদি রাষ্ট্রগঠনের এক নীরব সাক্ষী

রাজধানী রিয়াদের সরু গলিপথ আর আধুনিক আকাশছোঁয়া ভবনের ভিড়ে কিছু জায়গা ইতিহাসের মতোই অবিনশ্বর। ঠিক তেমনই একটি নাম ‘মাসমাক দুর্গ’, যা শুধু একটি দুর্গ নয়, বরং আরব মরুর বুকে জন্ম নেওয়া এক সংগ্রামী জাতির জেগে ওঠার প্রতীক। কিং আবদুল আজিজের বীরত্ব, শাসকের দূরদৃষ্টি আর মানুষের অটল সাহসের গল্প আজও এই দুর্গের ইট-কাদার গায়ে শোনা যায়।
১৯ শতকের মাঝামাঝি, রিয়াদ ছিল ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আর বিভিন্ন বংশের দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত। সেসময় রশিদ বংশের শাসক মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে রশিদ রাজধানী রিয়াদ পুনর্দখল করেন এবং তাঁর সেনাপতি আবদুল রহমান ইবনে সুলাইমান ইবনে দাবানকে দুর্গ নির্মাণের দায়িত্ব দেন। মাটির ইট, খেজুর কাঠ আর পাথরের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে যাওয়া মাসমাক (মানে আরবি ভাষায় ‘দৃঢ়, শক্ত ঘাঁটি’)। এটা কোনো রাজপ্রাসাদ ছিল নাÑছিল শাসকের প্রশাসনিক কেন্দ্র, অস্ত্রাগার, সৈন্যশিবির আর জনজীবনের নিরাপত্তা বেষ্টনী।
মাসমাক দুর্গের সবচেয়ে চমকপ্রদ দিকটি হলো এর প্রতিটি কোণেই লুকিয়ে আছে দক্ষ স্থাপত্যশিল্প আর কৌশলের ছাপ। দুর্গের প্রধান প্রাচীরটি গড়া হয়েছে পুরু মাটির দেয়ালে, যা একদিকে মরুর প্রখর তাপ শোষণ করে আরেকদিকে শত্রুর কামান বা পাথরের আঘাতকেও সহজে প্রতিহত করে। দুর্গের চারটি বৃত্তাকার টাওয়ার, প্রত্যেকটি প্রায় ১৮ মিটার উচ্চতার, সেখান থেকে এক নজরে পুরো শহর আর তার দিগন্ত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।
দুর্গটিতে আছে, ‘আল-খোখা’ গেট : মূল ফটকের ভেতরের ক্ষুদ্র দরজা, যা দিয়ে একবারে একজনের বেশি প্রবেশ করতে পারে নাÑএটি ছিল শত্রু সেনাকে একে একে বশ মানাতে কৌশলী প্রতিরোধ। ভিতরের পরিবেশের মধ্যে রয়েছে, মসজিদ, কূপ, গুদামঘর, অস্ত্রশালা ও বিশ্রামাগারÑসবই দুর্গের ভেতর ছিল যেন দীর্ঘ অবরোধেও খাদ্য আর পানি সরবরাহ স্থির থাকে।
রশিদ বংশের শাসনে সৌদ পরিবার বহু বছর নির্বাসিত অবস্থায় ছিল। তরুণ আবদুল আজিজ যখন কুয়েতে ছিলেন, তখন তাঁর মনেই ছিল পিতৃভূমি রিয়াদ পুনর্দখলের স্বপ্ন।
১৯০২ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি ৬৩ জন বিশ্বস্ত সঙ্গীকে নিয়ে গভীর রাতে রিয়াদের বুকে চুপিসারে প্রবেশ করেন। মাসমাক দুর্গের প্রহরী বাহিনীকে ছদ্মবেশে বিভ্রান্ত করে ভিতরে ঢুকে যান। ‘কথিত আছে, সেই অভিযানে কিং আবদুল আজিজ নিজ হাতে একটি বর্শা ছুঁড়েছিলেন দুর্গের প্রধান ফটকের দিকে। আজও সেই বর্শার ফলা কাঠের দরজায় অটলভাবে গেঁথে রয়েছেÑইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী হয়ে।’
মাসমাক দুর্গ কিং আবদুল আজিজের জীবনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু সফল অভিযানের কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকে সৌদ শাসনের পুনর্জাগরণ শুরু হয়, যা একসময় পুরো আরব উপদ্বীপকে ঐক্যবদ্ধ করে আজকের আধুনিক সৌদি আরবে রূপান্তরিত করে।
১৯৮০-এর দশকে রিয়াদ পৌরসভা মাসমাক দুর্গকে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৫ সালে এটিকে পূর্ণাঙ্গ ঐতিহাসিক যাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এখন দুর্গে রয়েছে, কিং আবদুল আজিজের ব্যবহার করা তরবারি, বর্শা, ঢাল, ঐতিহাসিক ছবি, যুদ্ধের মানচিত্র, প্রাচীন জীবনযাত্রার হস্তশিল্প, স্থানীয় পোশাক ও অস্ত্রশস্ত্রের রেপ্লিকা ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র ও লোকজ সামগ্রী।
প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক, শিক্ষার্থী ও গবেষক মাসমাক দুর্গ দেখতে আসেন। রিয়াদ শহরের ঐতিহ্যভিত্তিক পর্যটন শিল্পের অন্যতম কেন্দ্র এই দুর্গ।
পর্যটক গাইড, হস্তশিল্প বিক্রেতা, স্থানীয় খাবারের দোকানÑসবকিছুই স্থানীয় অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।
কিছু স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা মাসমাক দুর্গ নিয়ে গবেষণা করেনÑফরংংবৎঃধঃরড়হং থেকে ঠজ ট্যুর তৈরির মতো আধুনিক উদ্যোগও আছে।
এছাড়াও, অনেক প্রবীণ রিয়াদবাসীর কাছে মাসমাক দুর্গ শুধু একখণ্ড ইট-পাথরের নির্মাণ নয়Ñএটি তাঁদের পূর্বপুরুষের সাহস আর স্বাধীনতার গল্পের জীবন্ত স্মারক। অনেকে স্মৃতিচারণা করে বলেন, ছোটবেলায় তাঁরা এই দুর্গের ছায়ায় খেলাধুলা করতেন। তখন আজকের মতো সজ্জিত যাদুঘর ছিল না, ছিল মরুর বালির গন্ধ আর ইতিহাসের স্তূপ জমে থাকা ধুলো।
কালের পর কাল টিকে থাকা মাসমাক দুর্গ শুধু সৌদি আরবের নয়Ñআরব বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক নিদর্শন। মরুর ধুলো, আধুনিক গ্লাস টাওয়ার আর অর্থনৈতিক রূপান্তরের মাঝেও এটি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বলে যাচ্ছেÑ ‘একতা, বীরত্ব আর দূরদর্শিতা চিরকাল বেঁচে থাকে।