রবিবার, ০৪ মে, ২০২৫  |   ২৬ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

মানবতাবোধ ও প্রেম
অনলাইন ডেস্ক

আসমা একজন গার্মেন্টস্ কর্মী। সকাল ৮টা হতে রাত ১০টা পর্যন্ত সে গার্মেন্টসে কাজ করে। পরিশ্রমের উপার্জন দিয়ে সে নিজের খরচ বহন করে; বাকি টাকা বাড়িতে পাঠায়। বাড়িতে তার দুরারোগ্য বাবা, পঙ্গু মা আর ছোট দুইটা ভাই আছে। এক ভাই পড়ে ক্লাস ফাইভ, অন্য ভাই থ্রিতে। তার উপার্জিত টাকায়ই ভাইদের লেখাপড়াসহ সংসারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ হয়। ৮ম শ্রেণি পাস ১৫ বছরের আসমা টাকা উপার্জনের তাগিদে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। মাসশেষে বেতন পেলে আসমা বাবার কাছে টাকা পাঠায়।

এক বছর পর আসমার পরিচয় হয় পলাশ নামে এক মেডিকেলপড়ুয়া ছাত্রের সাথে। পলাশ টিউশনি করে রাতে বাসায় যাওয়ার পথে প্রতিদিনই আসমার সাথে টেম্পুতে দেখা হয়। আসমা দেখতে খুব রূপসী এবং তার চোখে-মুখে তাকালে কেমন যেনো একটা মায়া কাজ করে। টেম্পুযোগে প্রায় আট-দশ দিন তারা একই সময় গন্তব্যে আসে। প্রতিদিন আসমাকে দেখতে দেখতে কথা বলার আগ্রহ জাগে পলাশের। তাই পলাশ আসমার সাথে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করে। একদিন টেম্পুর জন্যে দুজনই অপেক্ষমান। পলাশ নিজ থেকেই জানতে চায় আসমার পরিচয়। বলে, তোমাকে প্রতিদিনই এখান থেকে যেতে দেখি, কোথায় যাবা? মেয়েটি ইতস্তবোধ করলো! পলাশ তা বুঝতে পারে এবং বলে দেখো আমি মেডিকেলের ছাত্র। সন্ধ্যায় টিউশনি করি, তাই ফেরার পথেই বেশ ক’দিন একই টেম্পুতে যাওয়া পরে। তোমাকে দেখে মনে হয় কোনো শিক্ষিত পরিবারের সন্তান। কিন্তু প্রতিদিন তোমাকে এ সময়েই এখান থেকে একা যেতে দেখি। তোমার বাবা-মা বা বোন সাথে আসে না? আসমা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে ওঠলো দেখুন ভাইয়া আমি গার্মেন্টসে চাকুরি করি, আর আমার বাবা-মা এবং দুইটা ছোট ভাই গ্রামে থাকে। এরই মধ্যে টেম্পু চলে আসে। তারা রওনা দেয় গন্তব্যে। টেম্পুর গাধাগাধির কারণে তাদের আর কথা হয় না। পলাশ নেমে যায়। পরের স্টেশন নামবে আসমা।

পলাশ রাতে আসমাকে নিয়ে ভাবে। গ্রামের মেয়ে, পরিবারের সবাই গ্রামে থাকে। অথচ এই অল্প বয়সের একটা মেয়ে গার্মেন্টসে চাকুরি করে! যেখানে তার এখন স্কুলে পড়ার কথা। আবার মেয়েটাও কতো সুন্দর। তার কথা-বার্তাও খুব স্মার্ট। নিশ্চয়ই মেয়েটা বিপদে পরেই গার্মেন্টসে চাকুরি করতে এসেছে! এমন অনেক প্রশ্ন পলাশের মনে জাগে। আবার মেয়েটার জন্যে পলাশের মায়াও লাগে। এভাবেই পলাশের রাত কেটে যায়।

পরের দিন যথারীতি একই যায়গায় টেম্পুর জন্যে অপেক্ষা দুজনের। পলাশ জানতে চায় কেমন আছো? জি ভালো, আপনি? পলাশ উত্তর না দিয়ে বলে আচ্ছা তোমার বাবা কী কাজ করেন জানতে পারি? কেনই-বা তুমি এই অল্প বয়সে গার্মেন্টসে চাকুরি করতে এলে? আসমার সুরটা একটু নেমে আসলো। বললো, আমার বাবা দুরারোগ্য রোগী, মা বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় এক পা হারান। আমাদের যা ছিলো বাবা-মায়ের চিকিৎসায় সবশেষ। এরপর আসমার চোখে পানি চলে আসে। তারপরই বড় সন্তান হিসেবে তুমি পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়োছো, বলে পলাশ। আসমা তার জীবন ইতিহাস সব পলাশকে বলে। আসমা এ-ও বলে যে, সে খুব ভালো ছাত্রী ছিলো। ৫ম ও ৮ম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও পেয়েছিলো। পরিবারের উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় সে নিজেই উপার্জনের পথ বেঁচে নিয়েছে। পলাশ আসমার কথা শুনে পড়াশোনা করার উৎসাহ দিলো। কিন্তু আসমার যে উপার্জন ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নাই! পলাশ আসমাকে বললো আমি যদি তোমার পড়ালেখা করার ব্যবস্থা করি তুমি পড়ালেখা করবে? আসমা উত্তর দিলো আমার পরিবারের ভরনপোষণ আগে; তারপর পড়াশোনা। পলাশ বিষয়টা বুঝতে পারলো এবং আসমাকে বললো দেখি কি করা যায় এই বলেই দুজনে টেম্পুতে উঠলো এবং যে যায় গন্তব্যে চলে গেলো। পলাশ বাসায় গিয়ে ভাবলো আমি যে বাসায় টিউশনি করি ওই বাসার বৃদ্ধ মহিলাকে দেখাশোনা করার জন্যে ওরা একজন বিশ্বস্ত লোক খুঁজছে। ওই বাসায় যদি আসমাকে দেয়া যায় তবে আসমার উপকার হবে। ওরা খুব বড়লোক। যে বেতন দিবে আসমা হয়তো গার্মেন্টসের বেতন থেকেও বেশি পাবে। পাশাপাশি এখানে থাকলে আসমার পড়াশোনাটাও হবে। পলাশ পরের দিন টিউশনিতে গিয়ে আসমার চাকুরিটা পাকা করে ফেলে। এই পরিবারকে পলাশ আসমার বিষয়টি খুলে বলে। বৃদ্ধ মহিলা অত্যন্ত খুশি হয় এবং পলাশের সাথে কথা দেয় যে তারা আসমাকে পড়াশোনার সুযোগ দিবে। পলাশ রাতে বাসায় যাওয়ার পথেই আসমার সাথে দেখা। আসমাকে কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়েই পলাশ বলে তুমি কাল থেকে আর গার্মেন্টস্ যাচ্ছো না এবং কাল তোমার বিছানাপত্র যা আছে সব নিয়ে আমার সাথে নতুন চাকুরিতে যাবা। পলাশের সাথে দুদিনের কথায় আসমা পলাশকে খুব বিশ্বস্ত মনে করলো এবং পলাশের কথায় রাজি হয়ে গেলো। আসমাও কোনো প্রশ্ন না করেই পর দিন পলাশের সাথে নতুন চাকুরিতে গেলো। বৃদ্ধ মহিলা আসমাকে পেয়ে যেনো তার জাপানী নাতনীকে কাছে পেলো। মাসে দশ হাজার টাকা বেতন ও থাকা-খাওয়া ফ্রিতে আসমা কাজ শুরু করে দিলো। তার তেমন কোনো কাজ ছিলো না। শুধু বৃদ্ধ মহিলার সেবা-যত্ন করাই তার দায়িত্ব ছিলো। এভাবেই চলতে থাকলো আসমার নতুন কর্মস্থল।

পলাশ কিছুদিন পর বৃদ্ধ মহিলার পরামর্শে আসমাকে মহল্লার একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করে দিলো। স্কুলের প্রধান শিক্ষককে পলাশ আসমার বিষয়টি খুলে বলে এবং পড়াশোনার সুযোগ দেয়ার জন্যে অনুরোধ করেন। পলাশ প্রধান শিক্ষককে আশ্বস্ত করে আসমা ভালো ফলাফল করতে পারবে, এর জন্যে পলাশ আসমার পড়ালেখার প্রতি নজর রাখবে। আসমা বৃদ্ধ মহিলার সেবা-যতেœর পাশাপাশি পড়াশোনা করতো। পলাশ প্রায়ই আসমাকে বিভিন্ন বিষয়ের উপদেশ দিয়ে যেতো এবং যে বিষয়টা সে কম বুঝতো সে বিষয়ে পলাশকে বললেই পলাশ তা বুঝিয়ে দিতো। বৃদ্ধ মহিলাও আসমার পড়াশোনায় উৎসাহ যোগাতো। আসমার প্রতি মহিলার ভালোবাসা দৃঢ় হলো। আসমাকে মাঝেমাঝে স্কুলে ক্লাস করতেও পাঠাতো। বাসায় নিয়মিত পড়ে আসমা জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করে বৃদ্ধ মহিলা ও পলাশের মুখ উজ্জ্বল করলো। তারা খুশি হয় একই স্কুলের কলেজ শাখায় আসমাকে ভর্তি করে দিলো। আসমা যেনো বৃদ্ধ মহিলার পরিবারেরই একজন সদস্য। বৃদ্ধ মহিলা নাতনির মতো আদর করে আসমাকে। আসমা এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করে এবং মেডিকেলে সুযোগ পায়। পলাশ পাশে থেকেই আসমাকে উৎসাহ ও সহযোগিতা করে গেলো। আসমা চিকিৎসক হয়ে বের হলো। বৃদ্ধ মহিলা পলাশকে প্রস্তাব করলো আসমাকে বিয়ে করার। পলাশ দ্বিমত না করে রাজি হয়ে গেলো। বৃদ্ধ মহিলা আসমা ও পলাশের পরিবারকে বাসায় এনে তাদের বিয়ে দিয়ে দিলো। আসমা ও পলাশ দুজনেরই ইতোমধ্যে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে চাকুরি হলো। কিন্তু বৃদ্ধ মহিলা তা করতে দিলো না। তিনি তার ট্রাস্টের সমস্ত টাকা দিয়ে আসমার গ্রামে আধুনিক হাসপাতাল করে দিলেন এবং পলাশ ও আসমার নামে তা লিখে দিয়ে বললেন, এই হাসপাতালে আসমার বাবা-মায়ের চিকিৎসা হবে এবং যতোদিন তোমরা বেঁচে থাকবে ততোদিন যেনো এ হাসপাতাল থেকে কেউ অর্থের অভাবে সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়।

* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ই-মেইল

[email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়