রবিবার, ০৬ জুলাই, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচের জয়ে সিরিজে সমতা আনলো বাংলাদেশ

প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৫, ০৯:৫৭

যে কথাটি কারবালার অন্যতম মূল তাৎপর্য

সফিক মোজাদ্দেদী
যে কথাটি কারবালার অন্যতম মূল তাৎপর্য

৬১ হিজরির ১০ মহররম কারবালার প্রান্তরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের পূর্বে ইমাম হোসাইন (রাদ্বি.) ইয়াজিদের ২২ হাজার মতান্তরে ৩০ হাজার সৈন্যের সামনে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। অনেক কথায় বলেন ইমাম পাক; মনে করিয়ে দেন কে কে পত্র লিখে ও দূত পাঠিয়ে তঁাকে কুফায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। স্মরণ করিয়ে দেনÑতিনি কে, কি তঁার পরিচয়, কোথায় তঁার স্থান এবং কি তঁার শান, মান ও মর্যাদা। সবশেষ তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেনÑ‘‘আলাম্ তাস মা-ও? আলাইসা ফি কুম মুসলিমুন!’’

ভাষণের এই একটি উক্তিই মূলত কারবালার অন্যতম শিক্ষা। যা কিয়ামত পর্যন্ত উম্মতে মোহাম্মদীকে লাইট হাউজের মতো পথপ্রদর্শন বা দিকনির্দেশনা দিয়ে যাবে।

ইয়াজিদ বাহিনীর সবাই নামাজি ছিল, কুরআন পড়তো, দঁাড়ি-পাগড়ি ছিল, ইসলামি লেবাস ছিল তথাপি ইমাম পাক কেন এমন প্রশ্ন করেছিলেন ! আজ তা চিন্তা ও গবেষণার বিষয়।

মূলত সেদিন সেই ভাষণের মাধ্যমে হজরত ইমাম হুসাইন (রাদি.) আসল এবং নকলের ভাগটা পরিষ্কার করে দেখিয়ে গেছেন। কারণ, ইয়াজিদের সৈন্য বাহিনীতে একজনও হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান অথবা অন্য কোন ধর্মের লোক ছিল না। সবাই ছিল মুসলমান দাবিদার। অথচ ইমাম পাক কি ভয়ংকর শব্দ উচ্চারণ করলেনÑতোমাদের মাঝে কি একজন মুসলমানও নাই?

ইমাম পাক বললেন, দেখ আমি সেই ইমাম হোসাইন ইবনে আলী, আমার নানাজান দুজাহানের বাদশা, আমার আম্মাজান উনার কলিজার টুকরা ফাতিমা জান্নাতে নারীদের সরদার, আমার আব্বাজান যিনি সব থেকে কমবয়সী ইসলাম কবুলকারী, রাসুলের চির সাথি, খোলাফায়ে রাশেদীন আমিরুল মোমিনীন, আল্লাহর সিংহ আলী ইবনে আবি তালিব। আমার মাথায় দয়াল নানাজান রাসুলের শিরস্ত্রাণ, হাতে আব্বাজানের জুলফিকার। আমার নানাজানের সেই হাদিস কি তোমরা শুনোনিÑ‘হোসাইন আমার থেকে আমি হোসাইন থেকে’। সেই হাদিস শুনিনি ‘ যে আমার হোসাইনকে কষ্ট দিলো, সে যেন আমি রাসুলকে কষ্ট দিলো। সেই হাদিস শুনানি ‘ হাসান ও হোসাইন জান্নাতে যুবকদের সরদার। তারপরও তোমরা নবি বংশকে হত্যার জন্য এসেছ। তোমরা জানোনা, আমার ভাই ইমাম হাসান এবং আমি হোসাইন কাল হাশরে নানাজানের উম্মতকে হাউজে কাউসার পান করাবো। আজ আমাকে হত্যা করে, কাল কিয়ামতের ময়দানে কিভাবে নানাজানের সামনে মুখ দেখাবে? আজ আমার পরিবার ও সাথীদের পানি না দিয়ে কাল হাশরে কীভাবে আমাদের থেকে হাউজে কাউসার আশা করো?

এই জ্বালাময়ী, হৃদয়বিদীর্ণ করা ভাষণ পাপাত্মা লোকগুলোর অন্তরে পেঁৗছায়নি। কাজ হবেনা তা ইমাম হোসাইন (রাদ্বি.) ভালো করেই জানতেন। তবু বলেছেন, আমাদের জন্য শিক্ষা রেখে গেলেন। নামাজ-কুরআন পড়লেই, দঁাড়ি-পাগড়ি, ইসলামি লেবাস থাকলেই মুসলমান হয়না। যে নামাজে এই ইমাম হোসাইন (রাদ্বি.)কে সালাম না দিলে নামাজই হবে না, সে ইমাম হোসাইন (রাদ্বি.) কে যারা সপরিবারে নির্মমভাবে নির্যাতন ও শহীদ করলো তারা কেমন মুসলমান? সেসব নামধারী, লেবাসী মুসলমান আজো আছে, নবীর দুশমন, আহলে বাইতদের দুশমন, পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের বংশধর। এরা লেবাসি-নামধারী মুসলমান মাত্র। দ্বীনের সাথে, রেসালতের সাথে এদের কোন সম্পর্ক নাই। এরাই পথভ্রষ্ট ও দুনিয়াদার দল। কিন্তু ইয়াজিদের ২২ হাজার মতান্তরে ৩০ হাজার সৈন্যের মধ্যে একজনের হৃদয়ে ইমাম পাকের কথাগুলো তীরের মতো বিদ্ধ হয়েছিলো, কম্পন সৃষ্টি করেছিলো..!

ইমাম পাকের সেই মর্মস্পর্শী ভাষণে ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি হুর বিন ইয়াযিদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করলো। সেনাপতি হুরের মন ব্যাকুল হয়ে উঠল, শিহরিত হলো। তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। অবস্থা দৃষ্টে পাশের একজন বলে উঠলো-এই হুর! তোর কী হয়েছে? তোকে কখনো এমন পেরেশান হতে দেখিনি! তোকে তো আমি সবসময় বীর হিসেবেই দেখেছি। হুর বললোÑদোযখ এবং বেহেশতের মধ্য থেকে যে কোন একটি নির্বাচন করা উচিত। সেই নির্বাচনের মোক্ষম সময় এখন। এই বলেই চিৎকার করে উঠলো সেÑখোদার শপথ! আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেললেও বেহেশত ছাড়া অন্য কিছুই আমি বেছে নেবো না। এ বলেই কুফার সেই মহাবীর কঁাপতে কঁাপতে ইমাম হোসাইন (রাদ্বি.) এঁর দিকে এগিয়ে যান। অশ্রুসিক্ত চোখে, করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নম্রকণ্ঠে ইমাম পাকের সামনে গিয়ে বললোÑ‘হে রাসুলে খোদার সন্তান ! আপনার জন্যে আমার জীবন উৎসর্গ হোক৷ ইমাম হোসাইন (রাদ্বি.) হুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে হুরÑতুমি কি জানো তুমি কি করছ? ঐদিকে ইয়াজিদের বিশাল সৈন্য বাহিনী আর আমার দলে মাত্র ৭১ জন। এই যুদ্ধে আমাদের শাহাদাত নিশ্চিত। তুমি আমার দলে আসার পরিণতি বুঝতে পারছ কি? আমার দলে আসা আর মৃত্যুকে বরণ করা শুধু সময়ের ব্যবধান মাত্র।

ইমাম পাকের এমন কথা শুনে সেনাপতি হুর জবাব দিলোÑতা আমি জানি হে আওলাদে রাসূল। আপনার দলে থাকলে আমার আর মৃত্যুর মাঝে শুধু সময়ের ব্যবধান মাত্র। সেই সাথে আমি এটাও বুঝে গেছি যে, আমার আর জান্নাতের মাঝেও এখন শুধু মৃত্যুটাই ব্যবধান মাত্র।

সেনাপতি হুর ইমাম পাকের অনুমতির জন্য বললো, ময়দানে সর্বপ্রথম আমাকে যাবার অনুমতি দিন হে আমার মহান ইমাম। ইমাম হোসাইন (রাদ্বি.) তাকে তার ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিলেন। হুর বীরবিক্রমে ইয়াজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে থাকেন। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে অবশেষে শাহাদতের অমৃত সুধা পান করেন।

[বীর হুর বিন ইয়াযিদ উম্মতে মুহাম্মাদিকে জানান দিয়ে গেলেন যে, ইমাম হোসাইনের দল মানেই জান্নাতী আর বাকী সব জাহান্নামি ]

কারবালার প্রসঙ্গ আসলে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা না করলেই নয়। তা হলো ইয়াজিদ কি মুসলমান ছিলো? ইয়াজিদী মুসলমান বলে কি কিছু আছে?

ইয়াজিদ কোন অবস্থাতেই মুসলমান ছিলোনা, এটা ইমামগণ, আকাবীরগণ স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ইসলামের সহীহ আকিদা বা সুন্নি জামাতের সকল হক্কানি আলেম ও আকাবীরগণের মত এই যে, ইয়াজিদ কাফের, ফাসেক ও জালেম ছিলো।

* তাফসিরের ২৭ জন ইমামগণের মতে ইয়াজিদ ‘কাফের’ ছিলো।

* ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে ইয়াজিদ ‘ফাসেক’ ছিলো।

* বিশিষ্ট তাবেঈ ইমাম মুজাহিদ (র).-এঁর মতে ইয়াজিদ ‘মুনাফিক’ ছিলো।

তার মানে কোন অবস্থাতেই ইয়াজিদ মুসলমান ছিলো না।

আর স্বয়ং ইমাম হোসাইন রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু ইয়াজিদ বাহিনীকে অমুসলিম ঘোষণা দিয়েছেন। কারবালার ময়দানে তিনি ইয়াজিদ বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আলাম্ তাস মা-ও? আলাইসা ফি কুম মুসলিমুন!

‘আমার কথা কি শুনতে পাও? তোমাদের মধ্যে কি একজনও মুসলমান নেই!’ সেমতে, ইয়াজিদের গুণকীর্তন করা, তাকে তাবীঈ বা মুসলমান মনে করা লোকগুলোকেই ইয়াজিদী মুসলমান বলা হয়ে থাকে।

ইয়াজিদের প্রতি লানত দেওয়া বৈধ কিনা?

আহলে সুন্নাহর মুহাদ্দিস ও বুখারির বিখ্যাত শারাহর লেখক ইবনে হাজর আস্কালানী (রহঃ)’র লেখা আল ইমতা বিল আরবাইনের পৃষ্ঠা নং ৯৬ থেকে তুলে ধরা হল : ‘তাকে (ইয়াজিদকে) ভালবাসা ও তার বড়োত্ব একজন অধার্মিক ও মানবশূন্য ব্যক্তি ছাড়া কেউ প্রকাশ করে না। কারণ ইয়াজিদ এমন চরিত্রের লোক যে, তার প্রেমিকরা ইমান শূন্য হতে বাধ্য, কারণ আল্লাহর জন্য ভালবাসা ও ঘৃণা ইমানের লক্ষণ।’ সুতরাং এই ফতোয়া অনুযায়ী যে ইয়াজিদকে ভালোবাসে সে মানহীন।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাদ্বি.) তঁার বিভিন্ন ভাষণে ইয়াজিদ সম্পর্কে বলতেন, সে একজন জালিয়াত, মদ্যপ, নামাজ তরককারী ও গায়িকা (ভ্রষ্টা) নারীদের সাহচর্যে অবস্থানকারী ব্যক্তি। [ইবনে কাসীর : আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৮ : ২৭৯]

ইয়াজিদের পুত্র নিজেই তার বাবার কৃতকর্মকে তুলে ধরেছেন। “যখন ইয়াজিদের উত্তরসূরি হয়ে তার পুত্র মুয়াবিয়া দ্বিতীয় সিংহাসনে বসলো, সে তার প্রথম খুৎবায় বললো ‘আমরা ইয়াজিদের খারাপ কাজের ব্যাপারে সব জানি, সে রাসুলের (সা.) পরিবারকে হত্যা করেছে, মদকে হালাল মনে করতো এবং খানায়ে ক্লাবকে ব্যথিত করেছিল।” [হায়াত আল হাইয়ান, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৮]

ইয়াজিদের পুত্র দ্বিতীয় মুয়াবিয়াহ খোৎবায় আরও বলেন, ইয়াজিদের দুষ্র্কম ও ইসলাম-বিদ্বেষের প্রমাণ বহন করে। তিনি বলেন, ‘‘অতঃপর আমার পিতাকে রাজকীয় পোশাক পরানো হয়। সে অনুপযুক্ত ছিলো। রাসুলে আকরামের দৌহিত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। ফলে তার জীবন হ্রাস পেয়েছে, বংশ নিপাত গেছে, সে তার কবরে তার পাপরাশির শাস্তিতে গ্রেফতার হয়ে আছে।’’ তারপর তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন, আমাদের সবার জন্য অতি আফসোস ও মনঃকষ্টের ব্যাপার হলো তার মন্দ মৃত্যু ও মন্দ ঠিকানা (পরিণাম)। সে তো রাসুলের সম্মানকে ভূ-লুণ্ঠিত করেছে। মদকে হালাল করেছে, কা’বা শরীফ ধ্বংস করেছে। [সাওয়া-ইক্ব-ই মুহরিক্বাহ: পৃ-১৩৪]

উল্লেখ্যÑইয়াজিদ নবি পরিবারের সাথে দুশমনি ও ইসলাম বিদ্বেষী হওয়ায় তার ছেলে ইয়াজিদের সিংহাসনে থুথু নিক্ষেপ করে ক্ষমতা ছেড়ে দেন এবং দ্বীনের পথে অটল থাকেন।

ইবনে আসীর নিজ ‘তারিখ আল-কামিল’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ৪৫০ পৃষ্ঠায় মুনযির ইবনে যাবীর থেকে বর্ণনা করেন : ‘‘এটি সত্য যে ইয়াজিদ আমাকে ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) দিরহাম দিয়েছিল, কিন্তু এটি তার প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করা হতে আমাকে রুখবে না। আল্লাহর কসম, সে একজন মাতাল।”

সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে যোবাইর (রাদ্বি.) বলতেন : ইয়াজিদ এক প্রতারক, মাতাল ও সত্যপথ পরিত্যাগকারী এবং এমন এক ব্যক্তি যে গায়িকা নারীদের সঙ্গে থাকে। [বিদায়া ও নিহায়া,৮ম খণ্ড,পৃ: ২৭৯]

ইয়াজিদের সমসাময়িক হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে হানযালাহ্ গসীলুল মালাইকাহ্, ইয়াজিদ সম্পর্কে বলেছেন-‘‘সে উম্মে ওয়ালা, কন্যা ও বোনদের সাথে বিবাহের প্রচলনদাতা, মদ্যপায়ী ও নামাজ বর্জনকারী। [তারীখুল খোলাফা: পৃ-১৪৬]

ইয়াজিদ (লা’নতুল্লাহি আলাইহি); পবিত্র ইসলামে অনেক খারাপ কাজ করেছে। সে তার রাজত্বের শেষদিকে হাররার দিনে মদীনা শরীফের অধিবাসী সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, সাহাবায়ে কেরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমদের মধ্যে অবশিষ্টদের শহিদ করে। পবিত্র মসজিদুল হারামে ইবনে যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ঘেরাও করে। সে পবিত্র কা’বা শরীফ ও ইসলামের সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করে। আর এ সময়ের মধ্যে আল্লাহ পাক তার মৃত্যু দেয়।” [জামহারাত আনসাব আল আরব ১১২ পৃষ্ঠা; লেখক: ইবনে হাজম; প্রকাশনা : দারুল মা’রিফা, মিশর]

ইয়াজিদ সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল : ইমাম হাইসামি ও আল বারাজানি লিখেছেন, ইমাম আহমদকে তার ছেলে আবদুল্লাহ ইয়াজিদের প্রতি অভিশাপ দেয়ার যুক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান: পবিত্র কুরআনের সুরা মুহাম্মাদের ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতের আলোকে ইয়াজিদকে অভিশাপ দেয়া বৈধ।

ইয়াজিদের চেয়ে বড় অনর্থ বা নৈরাজ্য পৃথিবীতে আর কে সৃষ্টি করেছিল? [ইমাম আলুসির তাফসির গ্রন্থ রুহুল মায়ানি, ৯ম খণ্ড, সুরা মুহাম্মাদ : ২২-২৩]

ইবনুল ইমাদ হাম্বালী রাহিমাহুল্লাহ ও আল্লামা ইয়াফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুকে শহিদ করেছে অথবা তার নির্দেশ দিয়েছে সে কাফের।Ñশাযারাতুয যাহাবি : ১/৬৮।

ইয়াজিদ বাহিনী মানুষ হত্যা, সম্পদ লুণ্ঠন এবং নারী ধর্ষণসহ সব কিছুই করেছিল। জালিম ইয়াজিদের নির্দেশে তার বাহিনী কর্তৃক পবিত্র মদিনায় জুলুমÑঅত্যাচারের বিবরণ নিম্নলিখিত কিতাবগুলোতে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছেÑ

* আৎ তাবারী-৫/৪৮৪

* আল্ কামিল : ৪/১১২ কৃত: ইবনে আসীর

* আল্ বিদায়া ওয়ান নেহায়া : ৮/২১৮; কৃত: ইমাম ইবনে কাছির।

যখন ইয়াজিদের নির্দেশে মদীনা মুনাওয়ারা আক্রমণ করা হয়েছিল। এ সময় তার নির্দেশে মদীনাতে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ সব কিছু সংঘটিত করেছিল ইয়াজিদের বাহিনী। অনেক সাহাবীদেরকে এ সময় শহীদ করা হয়েছিল। মুসলমানদের রক্তে মদীনার রাস্তাগুলো লাল হয়েছিল। রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে প্রিয় নবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এঁর রওজা মোবারক পর্যন্ত পেঁৗছেছিল। মসজিদে নববী রক্তে ভরে গিয়েছিল। ১০ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। [আত তাযকিরাহ ইমাম ইবনুল জাওযী : পৃ: ৬৩,১৬৩] [আৎ তাযকিরাহ্ : কৃত ইমাম আবদুর রহমান ইবনুল জাওযী।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফে আক্রমণকারীর উপর লা’নত দিয়েছেন। সহীহ হাদিস তার প্রমাণ। ইতিহাসবিদগণ ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন, ইয়াজিদের নির্দেশে মদীনা শরিফে হত্যা, লুঠ, ধর্ষণ হয়েছে। তাই এই পাপিষ্ঠ লা’নত পাবার উপযুক্ত।”

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: “মদীনাবাসীকে যে কেউ (সন্ত্রাসের মাধ্যমে) হয়রানি বা ভীত-সন্ত্রস্ত করল আল্লাহও তাকে অনুরূপ প্রতিদান দেবেন এবং তার ওপর আল্লাহর লা’নত, ফেরেশতাকুল ও মানব জাতির (মো’মেনদের) লানত” (মুসলিম শরীফ)।

ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ইয়াজিদ সম্পর্কে হজরত আবদুল্লাহ্ বিন হানজলাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেনÑইয়াজিদ এমন দুষ্ট ও লম্পট প্রকৃতির লোক ছিল যে, ইসলামি শরিয়তে যেসব নারী বিবাহ করা হারাম এসব মুহরিমাতকে বিবাহ করত, শরাব পান করত এবং নামাজ ছেড়ে দিত। [তারিখুল খোলাফা (আরবি): ১৭৪ পৃষ্ঠা]

হজরত শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী লিখেছেনÑ‘‘ইয়াযীদ-ই ছিলো ফাসিক্বÑফাজির (পাপাচারী), খোদাদ্রোহী, লুণ্ঠনকারী ইত্যাদি। এসব বিষয়ের পক্ষে অকাট্য প্রমাণাদি রয়েছে।’’ ইমাম হোসাঈন-এর বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়ে তঁাকে শহীদ করার নেপথ্যে ইয়াজিদের হাত রয়েছে।

শায়খ মুহাক্বক্বিক্ব ‘আলাল ইত্বলাক্ব ‘জযবুল ক্বুলূব’-এ লিখেছেন, হজরত ইমাম আলী মাক্বামের শাহাদাতের পর সর্বাপেক্ষা মন্দ ও গর্হিত কাজ ও ঘটনা ইয়াজিদের শাসনামলে ঘটেছিলো, তা হচ্ছে ‘হাররার ঘটনা’। এ ঘটনায় ইয়াজিদ তার সেনাপতি মুসলিম ইবনে ওক্বাবাহকে বিরাট সেনাবাহিনীর সাথে মিলে মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পাঠিয়েছিলো। আর বলেছিলো,‘ ‘যদি তঁারা আনুগত্য স্বীকার না করেন, তাহলে তিনদিন যাবৎ এ ভূখণ্ডকে তোমার জন্য মুবাহ্ করা হলো।’’ (হত্যাযজ্ঞের অনুমতি দেওয়া হলো।) সিরীয় পশুগুলো হেরম-ই পাকে ঢুকে সেটার মর্যাদাকে পদদলিত করেছে। এক হাজার সাতশ’ মুহাজির ও আনসার সাহাবী ও তাবে‘ঈ আলিম, সাতশ’ হাফেয-ই কোরআন এবং দু’ হাজার জনসাধারণকে হত্যা করেছে। আর হাজার হাজার পর্দানশিন কুমারীর শ্লীলতা নষ্ট করেছে। মসজিদে নবভী শরীফে ঘোড়া দৌড়িয়েছে। রিয়াযুল জান্নাতে ঘোড়া বেঁধেছে। (সেগুলোর পায়খানা-প্রস্রাব দ্বারা সেটাকে নাপাক করেছে।) তিনদিন যাবৎ মসজিদে নবভী শরীফে আযান ও নামায হয়নি। হজরত আবূ সা‘ঈদ খুদরীরর দাড়ি মুবারক উপড়ে ফেলা হয়েছে।

ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইয়াজিদ ও ইবনে যিয়াদসহ ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকারীদের উপর আল্লাহর লা’নত পড়ুক। Ñতারীখুল খুলাফা : ২০৭

ইবনুল ইমাদ হাম্বালী রাহিমাহুল্লাহ ও আল্লামা ইয়াফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুকে শহিদ করেছে অথবা তার নির্দেশ দিয়েছে সে কাফের। Ñশাযারাতুয যাহাবিঃ১/৬৮

কোন মু’মিন ইয়াজিদকে মুহাব্বাত করতে পারে না; তাকে মুহাব্বাতকারী মু’মিন থাকতে পারে না।

উক্ত আয়াত শরীফ, হাদিস শরীফ ও ইমামগণের ভাষ্য দ্বারা ইয়াজিদের উপর লা’নত দেয়া জায়েয।

তাফসীর, হাদিস, আকীদা এবং ইতিহাস ও জীবনীর কিতাবগুলো থেকে যতদূর জানা যায়, তাতে দেখা যায় সালফে সালেহীনের নিকট গ্রহণযোগ্য এবং অনুকরণীয় কোন ইমামের কিতাবে ইয়াজিদের জন্য দোয়া করা বৈধ হওয়ার কথা আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।

প্রিয় পাঠকবৃন্দ! নিচে ইয়াজিদ রচিত কবিতাটি পড়ুন যা সে ইমাম হোসাইন রাঃ এঁর শির মুবারক সামনে নিয়ে গেয়েছিলঃ বিশেষ করে সর্বশেষ লাইনটি পড়ুন আর আপনিই বলুন সে কী কাফির ছিল না মুসলিমঃ

ইমাম হোসাইনের রাঃ মাথা মুবারক দামেস্কে আসার পর সারারাত ইয়াজিদ মদপান করে সকালে দরবারে উপস্থিত, মাতাল অবস্থায় মনের আসল কথা ও ঘৃণা প্রকাশ পায়, ইমাম হোসাইন রাঃ এঁর শির মুবারক সামনে নিয়ে সে বলছে, “বদর যুদ্ধে (আলী ও হামজা রাঃ কর্তৃক হত্যাকৃত) আমার মুরুব্বিরা যদি আজকের এই দৃশ্য দেখত, তাহলে তারা খুশি হয়ে বলত, হে ইয়াজিদ! তুই চালিয়ে যা, কখনো স্তব্ধ হয়োনা। আমি প্রতিশোধ স্বরূপ তাদের (রাসূল বংশের) বড় বড় ব্যক্তিদের হত্যা করেছি আর বদর যুদ্ধের বদলা নিয়েছি। বিশেষ করে আমি আলী থেকে বদলা নিয়েছি আর তার বাহাদুর সন্তানদের হত্যা করেছি, মোহাম্মদ যা আমাদের সাথে করেছে (বদর ও অন্য যুদ্ধে), আসলে বনী হাশিম (মোহাম্মদ) আমাদের সাথে রাজত্ব কেড়ে নেয়ার জন্য নাটক করেছিল, সে (মোহাম্মদ) কোনো নবি ছিল না আর কোন কিতাব বা ওহীও তার উপর নাজিল হয় নাই”।

তথ্যসূত্র

১. তারিখে ইবনে জারির তাবারি, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-১৮

২. তারিখে ইবনে জারির তাবারি, ১০ ম খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-৬০

৩. আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া, ইবনে কাসির, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা নং ৩৮১, ইমাম হোসাইন রা. এর শির মুবারক পরিচ্ছেদে সংক্ষেপে এনেছেন কবিতাটি। (বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত সংস্করণ দেখুন)

৪. হাফিয ইবনু আসাকির তার তারিখে দামেস্কে বিস্তারিত এনেছেন

৫. আল আওয়াসিমু মিনাল কাওয়াসিম, পৃষ্ঠা নং ২৩২.

শেষ লাইনগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ুন, এখানে প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার নবুয়াত, রেসালাত ও ওহিকে যে অস্বীকার করে সে মুসলমান হয় কোন ফিকহি মাজহাব মতে?

ইয়াজিদের নির্দেশনামায় কঠোর ভাষা ছিল নিম্নরূপ:

হুসাইন আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর এবং আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর কে এমনভাবে পাকড়াও করো তারা যেন বায়াত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি না পায়। ১০ম হিজরি শতকের মুজাদ্দিদ হজরত ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “অতঃপর ইয়াযীদ ইরাকের গভর্নর উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদের নিকট সাইয়্যিদুশ শুহাদা সাইয়্যিদুনা হজরত ইমাম হুসাইন (রাদ্বি.) কে শহীদ করার জন্য লিখিত ফরমান পাঠায়।” [তারীখুল খুলাফা ১৬৫ পৃষ্ঠা]। শুধু কারবালা ও কারবালা পরবর্তী নবী পরিবারের সদস্যদের সাথে আচরণই ইয়াজিদকে লানত ও অভিশাপ দেয়ার জন্য যথেষ্ট। বাকি শাসনামলের কথা তো আছেই। লানাতুল্লাহি আলাজ জালিমিন। জুলুমকারীর উপর আল্লাহর লানত। ইয়াজিদের সরাসরি হুকুমে মক্কা শরীফ ও মদিনা শরিফে অর্থাৎ হারামাইন শরিফাইনে আক্রমণ হয়েছিলো।

ইয়াজিদের উপর লানত দেয়া শুধু জায়জ-ই নয় বরং ইমানদার, মুমিন মুসলমানদের উপর ওয়াজিব। একই সাথে এদের মতো কিয়ামত পর্যন্ত যারা ইয়াজিদকে অনুসরণ করবে, তার দালালি করবেÑতারাও সমর্থনকারী হিসেবে ইয়াজিদের মতোই জুলুমকারী এবং তাদের উপরও আল্লাহর লানত। যার অন্তরে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তঁার আহলে বাইতদের মহব্বত নেই, তার ইমান নেই। নবিজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বংশÑনামাজের অংশ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়