প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৫, ২১:০২
মেধাকে দমিয়ে কখনো রাখা যায় না
উল্লাস পালের স্বপ্ন পূরণ তার বড়ো প্রমাণ

শারীরিক প্রতিবন্ধীত্বকে জয় করে একের পর এক লক্ষ্য পূরণের পর প্রকৃত স্বপ্ন পূরণ হলো উল্লাস পালের। উল্লাস পালের লক্ষ্য ছিল বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার হওয়া। শুরু করেন কঠোর প্রস্তুতি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে উল্লাস পাল ৪০তম, ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসে অংশ নেন। ৪০তম বিসিএসে পাস করেও কোনো পদ পাননি, ৪১তম বিসিএসে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে সুপারিশ পান।
|আরো খবর
এর আগে ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নড়িয়া সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু উল্লাস যে স্বপ্ন বুনেছে, তা তাকে পূরণ করতেই হবে। কঠোর পরিশ্রম আর মেধার যোগ্যতায় ৪৪তম বিসিএসে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন উল্লাস পাল।
জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও উল্লাস পাল তার শিক্ষা জীবনে কখনো প্রতিবন্ধী কোটার সুবিধা নেননি। শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও উল্লাস পাল নিজেকে অন্য ১০ জনের মতো সুস্থ মনে করেন।
উল্লাস পাল শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার কার্তিকপুর ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামের উত্তম কুমার পালের ছেলে। তার বাবা পেশায় মৃৎশিল্পী। মা আন্না রানী পাল গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে উল্লাস পাল বড়। জন্ম থেকেই তার দুই হাত-পা বাঁকা। শিশুকালে স্বাভাবিকভাবে হাঁটা শেখেননি তিনি।শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলের সুস্থ জীবনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন বাবা উত্তম কুমার পাল ও মা আন্না রানী পাল। ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। চিকিৎসার মাধ্যমে পায়ের অপারেশন হলে কিছুটা হাঁটাচলার উপযোগী হয় উল্লাস। এরপর অধ্যাবসায় আর ইচ্ছেশক্তি দিয়ে শিক্ষা জীবনের প্রতিটি ধাপে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন উল্লাস পাল। জানা যায়, উল্লাস পালকে ১৯৯৯ সালে ভর্তি করা হয় কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বর্ষায় কাদামাটি মাড়িয়ে স্কুলে যাওয়া তার জন্য ছিল কষ্টসাধ্য। ছেলের কষ্ট দূর করতে বাবা তাকে কোলে তুলে নিয়ে স্কুলে যেতেন প্রতিদিন। ডান হাতে শক্তি না থাকার কারণে উল্লাস পাল লেখার জন্য ব্যবহার করত বাঁ হাত। শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে খেলাধুলায় অংশ নিতে না পারলেও খেলোয়াড়দের প্রতি তার চোখে থাকতো একরাশ স্বপ্ন আর আগ্রহ।
এরপর উল্লাস পাল ২০১০ সালে কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। ঢাকায় এসে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন ঢাকা নর্দান কলেজে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে ২০১২ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাক্রমে ৪৬৩তম স্থান অধিকার করেছিলেন। পরে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হয়ে ২০১৬ সালে বিবিএ এবং পরবর্তীতে এমবিএ সম্পন্ন করেন।
উল্লাস পাল জানান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরিক্ষেত্রে স্বাভাবিক ও সুস্থ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এতো দূর এসেছি। চিকিৎসকদের শত চেষ্টার পরও হাত-পা স্বাভাবিক হয়নি। তবে দেরিতে হাঁটতে শিখেছি। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারি না। বাড়ির পাশেই কার্তিকপুর পালপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় প্রতিবন্ধী কোটা নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু আমি সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছি। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, সাধারণ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারব। ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় টিকেছিলাম। মানসিকভাবে নিজেকে অন্য আর দশজনের মতো সুস্থ মনে করি আমি।
তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে আমার চ্যালেঞ্জ ছিল অন্যরকম। স্কুলে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বরাবরই মেধার পরিচয় রাখতে পেরেছিলাম। অবশ্য এসবের কারণ আমার মা-বাবা ও শিক্ষকগণ। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তুরের শিক্ষকরা আমরা আন্তরিকভাবে শিখিয়েছেন। আমার জীবনের সব শিক্ষকই সেরা। কিন্তু যদি বিশেষ করে বলতেই হয়, তবে আমি বলব কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হারুন অর রশিদ স্যার। আমার মা-বাবাও আমার প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কখনো কটূক্তি করেনি। বরং তারা সব সময় আমাকে সহযোগিতা করেছে। পড়াশোনার খরচের বিষয়ে কখনও কার্পন্য করেনি।
উল্লাস পালের প্রথম পছন্দ ছিল প্রশাসন ক্যাডার। ৪০তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে একজন পরীক্ষক তাকে নেতিবাচক প্রশ্ন করে বলেছিলেন, প্রশাসন ক্যাডারে অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। আপনার যেহেতু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তাই এসব কাজ করতে পারবেন বলে মনে হয়? এমন প্রশ্ন শুনে উল্লাস পালের মনে হয়েছিল শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে তিনি মনে হয় তার পছন্দের ক্যাডার প্রশাসন পাননি। উল্লাস পাল বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার ওপর কারও হাত নেই। কোনো শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নেতিবাচক কথা বলে তার মনোবল ছোট করা ঠিক নয়। আমরাও চাই আমাদের সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে বিকশিত হতে, আমাদের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে। ৪৪তম বিসিএসে এসে অবশেষে প্রথম পছন্দের প্রশাসন ক্যাডার পেলেন উল্লাস পাল। ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে পরীক্ষকেরা অনেক আন্তরিক ছিলেন। উল্লাস পালকে তারা খুব উৎসাহিত করেছিলেন।
সামনে যারা বিসিএসে অংশ নেবেন তাদের উদ্দেশ্যে উল্লাস পাল বলেন, অল্প সময়ে সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। যারা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান, তাদেরকে অন্তত ৫ বছর সময় হাতে নিয়ে পড়তে বসতে হবে। অন্যথায় লক্ষ্যে পৌঁছানো কষ্টকর হবে।
শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে উল্লাস পাল একেরপর এক সুখবর দিয়েছে প্রত্যন্ত গ্রাম পালপাড়াকে। বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে উল্লাস পাল সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছে জেনে উচ্ছ্বসিত পালপাড়া গ্রামবাসীও।
কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. হারুন অর রশিদ বলেন, শারীরিকভাবে একটু সমস্যা ছিল, কিন্তু মেধায় দুর্দান্ত সে। আমার ছাত্র সে। নিজের ছাত্রের এমন সাফল্যে কোনো শিক্ষক গর্ববোধ করে না বলুন! ওর এই সাফল্যে আমি খুবই আনন্দিত। ও আরও বড় হোক।
শরীয়তপুরের নড়িয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সাইদুর রহমান জানান, উল্লাস পালের এমন সাফল্যে নড়িয়া কলেজ পরিবার আনন্দ প্রকাশ করছে। তিনি অনেক মেধাবী ও চৌকস ব্যক্তি। তার পাঠদান শিক্ষার্থীরা অনেক আনন্দ সহকারে গ্রহণ করত। তার সাফল্যে আমার অন্যান্য শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ পুরো কলেজ পরিবার উচ্ছ্বসিত। তার জন্য দোয়া করি, যেন ভবিষ্যতে এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। সূত্র: ঢাকা পোস্ট