প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৩
প্রেস মালিকদের বিরুদ্ধে দুদকের সাঁড়াশি অভিযান: জালিয়াতি ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ!
ফেঁসে যাচ্ছেন তানভীর!
প্রেস মালিকদের বিরুদ্ধে দুদকের সাঁড়াশি অভিযান: জালিয়াতি ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

সরকারি টেন্ডার, পাঠ্যবই মুদ্রণ, নির্বাচনী সামগ্রী ও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজ পেতে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে দেশের ৩৬টি বড় প্রিন্টিং প্রেস মালিকের বিরুদ্ধে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে ‘অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জন’, ‘মিথ্যা তথ্য প্রদান’, ‘নথিপত্রে জালিয়াতি’ ও ‘টেন্ডার সিন্ডিকেট গঠন’-এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে।
তালিকাভুক্তদের মধ্যে রয়েছেন বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিক তানভীর আহমেদ, যিনি ‘আলিফ গ্রুপ’ ও ‘তানভীর প্রিন্টার্স’-এর কর্ণধার।
“প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে কাজ পেতে এরা ঘনিষ্ঠ মহল ও ঘুষের মাধ্যমে টেন্ডার জিতেছেন। কোটি কোটি টাকার কাজ হলেও আয়কর নথিতে তা গোপন করা হয়েছে।” — এক দুদক কর্মকর্তা।
কাদের বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ?
দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা দলীয় সূত্র, এনবিআর, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সরকারি ক্রয় অধিদপ্তর (সিপিটিইউ), বাংলাদেশ প্রিন্টিং করপোরেশনসহ বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অভিযোগগুলো চিহ্নিত করেছেন।
প্রাথমিকভাবে যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন:
- তানভীর আহমেদ (তানভীর প্রিন্টার্স ও আলিফ গ্রুপ)
- মাহবুব হোসেন (প্রো-গ্রাফিক্স)
- সাজ্জাদুল করিম (ক্রিয়েটিভ মিডিয়া প্রিন্টার্স)
- লিয়াকত হোসেন (লিয়াকত প্রেস)
- সালেহ জামান (টেক্সট প্রিন্টিং কর্পোরেশন)
- এবং আরো ৩১ জন প্রেস মালিক
কীভাবে চলে এই দুর্নীতির চক্র?
এই প্রেস মালিকদের অনেকে ভুয়া উৎপাদন সক্ষমতা দেখিয়ে সরকারের বড় টেন্ডার আদায় করেন। পরে নিম্নমানের কাগজ ও কালি ব্যবহার করে কিংবা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে প্রকৃত কাজ বাস্তবায়ন করে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেন।
এদের অনেকেই আয়কর নথিতে প্রকৃত আয়ের চেয়ে অনেক কম তথ্য দেখিয়েছেন, যাতে কর ফাঁকি দিতে পারেন।
তানভীরের অস্বাভাবিক সম্পদ
বিশেষভাবে নজরে এসেছেন তানভীর আহমেদ। গত দশ বছরে তার নামে ও পরিবারের নামে ঢাকার অভিজাত এলাকায় ৮টি ফ্ল্যাট, গুলশানে জমি, চট্টগ্রামে কন্টেইনার ডিপো ও দুবাইয়ে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।
“তিনি বার্ষিক আয় ৩০ লাখ টাকা দেখিয়ে শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক। ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের পরিমাণ তার ঘোষিত আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।” — দুদক সূত্র।
কর ফাঁকি ও এনবিআরের তদন্ত
দুদকের তথ্যমতে, ৩৬ জন প্রেস মালিকের মধ্যে অন্তত ২২ জনের আয়কর ফাইলে কোটি কোটি টাকার লেনদেন গোপন রয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ইতোমধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হাই ভ্যালু ট্রানজেকশন নোটিশ জারি করেছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
পরবর্তী পদক্ষেপ
দুদক চেয়ারম্যান মো. মুনীর চৌধুরী এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন,
“আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। প্রাথমিকভাবে ৩৬ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তবে অনুসন্ধান শেষে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।”
প্রেস মালিকদের পাল্টা বক্তব্য
তানভীর আহমেদসহ কয়েকজন প্রেস মালিক অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তারা নিয়ম মেনেই সরকারি কাজ পেয়েছেন।
একজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “দুদকের অনুসন্ধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সরকার বদলালে আমরা টার্গেট হই, এটা নতুন কিছু নয়।”
বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন,
“দুদকের এই পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। তবে অতীতে দেখা গেছে, কিছুদিন পর এসব অনুসন্ধান ঝিমিয়ে পড়ে। এবার যেন সেটা না হয়।”
এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন চলমান। পরবর্তী কিস্তিতে প্রকাশ পাবে প্রেস সিন্ডিকেটের রাজনৈতিক যোগাযোগ ও নিয়ন্ত্রণের গোপন চিত্র।
ডিসিকে/এমজেডএইচ