প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ২০:১৪
আমেরিকা প্রবাসী স্থপতি সাখাওয়াত ইবনে আমীনের সাক্ষাৎকার
বিদেশে থেকেও দেশের জন্যে অনেক কিছু করা সম্ভব

সাখাওয়াত ইবনে আমীন। সহপাঠী, বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের কাছে তিনি 'প্রিন্স' নামেই বহুল পরিচিত। দেশের প্রথিতযশা লেখিকা ফাহমিদা আমিনের পুত্র এই প্রিন্স বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিটেকচার (স্থাপত্যবিদ্যা) বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আমেরিকার ওয়াশিংটনে স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স পড়তে যান। পড়ালেখা শেষ করে নিজ যোগ্যতায় চাকুরি পেয়ে আমেরিকার অলিম্পিয়া শহরে থেকে যান।
|আরো খবর
তাঁর সাথে চাঁদপুরের নৈকট্য আছে। তিনি চাঁদপুরের খ্যাতিমান চিকিৎসক, ভাষা সৈনিক মরহুম ডা. এম এ গফুরের কনিষ্ঠ পুত্র, বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগের ডীন প্রফেসর ড. শায়ের গফুরের বুয়েটে পড়াকালীন সহপাঠী এবং দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক, চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কাজী শাহাদাতের চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল জীবনের সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে সুবাদে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রবাসীকণ্ঠের পক্ষ থেকে অনলাইনে তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। এই সাক্ষাৎকারে তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বিদেশে থেকেও দেশের জন্যে অনেক কিছু করা সম্ভব। তিনি বলেছেন আরো কিছু কথা। তাঁর এসব কথা প্রবাসীকণ্ঠের পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রশ্নমালার জবাবে তিনি তুলে ধরেছেন। হুবহু সেটি পাঠকদের জন্যে নিচে পত্রস্থ হলো--
প্রবাসীকণ্ঠ : মাতৃভূমি ছেড়ে কতোদিন হলো আমেরিকা এসেছেন? কীভাবে এসেছেন? কোথায় থাকেন, কেমন আছেন? প্রবাস জীবন কেমন উপভোগ করছেন?
সাখাওয়াত ইবনে আমীন (প্রিন্স) : আসসালামু আলাইকুম। সবাইকে শুভেচ্ছা আর শুভ কামনা। আমার নাম সাখাওয়াত ইবনে আমীন। আমি প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই চাঁদপুর কণ্ঠ এবং তার সম্মানীয় প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত সাহেবকে আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্যে।
আমি থাকি আমেরিকার ওয়াশিংটন স্টেটের অলিম্পিয়া শহরে। আমি এসেছি আমেরিকাতে বেশ আগে, প্রায় ৩৫ বছর হতে চললো। ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে যখন আমি ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স প্রোগ্রামে স্কলারশিপ পাই, তখন আমাকে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ (Teaching Assistantship) করার অনুমতি দেয়।
এর আগে আমি বুয়েট থেকে স্থাপত্য বা আর্কিটেকচারের গ্র্যাজুয়েট করার পরে বাংলাদেশে একটা খ্যাতনামা আর্কিটেকচারাল ফার্মে কাজ করতাম। নাম ছিল বশিরুল হক এন্ড অ্যাসোসিয়েটস। ওখানে দেড় বছর কাজ করার পরে আমি মাস্টার্স করতে ওয়াশিংটন স্টেটে চলে আসি। মাস্টার্স করার পরে আমি ওয়াশিংটনের রাজধানী অলিম্পিয়া (Olympia) শহরে চলে আসি এবং প্রায় ৩২ বছর কাটিয়ে দিলাম এই শহরে।
এই অলিম্পিয়া শহরটা সিয়াটেল (Seattle) আর পোর্টল্যান্ড (Portland) এই দুটো শহরের মাঝখানে। শহরটা খুবই সুন্দর, খুবই সবুজ গাছে ঢাকা, পাশেই প্রশান্ত মহাসাগর। অনেক পাহাড়-পর্বত এবং উঁচু আগ্নেয়গিরি আছে আমাদের আশেপাশে।
অলিম্পিয়া শহর থেকে চার ঘন্টা উত্তরে আছে কানাডার ভ্যানকুভার শহর। আমরা আমেরিকার পশ্চিম তীরে, এটাকে বলে ওয়েস্ট কোস্ট (West Coast) অথবা পশ্চিম উপকূল।
আমেরিকাতে ওয়াশিংটন নামে অনেক জায়গা আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের (Federal Government) রাজধানী হচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসি, যেটা নিউ ইয়র্কের কাছে East Coast বা পূর্ব উপকূলে। আর আমাদের ওয়াশিংটন স্টেট হচ্ছে পশ্চিমে, এটা একটা state বা রাজ্য।
ওয়াশিংটন সম্বন্ধে একটু বলতে হয়। আমি যখন আসি ১৯৯১ সালে, এখানে তখন ছিলো বোয়িং প্লেনের বিশাল কারখানা, Boeing-এর হেড অফিস আর মাইক্রোসফট (Microsoft) বলে সফটওয়্যার কোম্পানির হেড অফিস। কিছুদিন পরে, ২০০০ সালের প্রথম দিকে এখানে অ্যামাজন (Amazon) বলে সবচেয়ে বিখ্যাত অনলাইন মার্কেটিং কোম্পানি গড়ে উঠে। তার সাথে ওয়াশিংটনে আছে প্রসিদ্ধ কফি কম্পানি, যার নাম হচ্ছে স্টারবক্স (Starbucks)। এখন ওয়াশিংটনে অনেক বড়ো বড়ো কোম্পানি গড়ে উঠেছে।
প্রবাসীকণ্ঠ : যে উদ্দেশ্যে আমেরিকা আসলেন, সে উদ্দেশ্য কি সাধন হয়েছে? আপনার পেশাগত জীবন সম্পর্কে একটু জানতে চাই।
সাখাওয়াত ইবনে আমীন : আমার উদ্দেশ্য ছিলো আমেরিকাতে মাস্টার্স করতে আসবো, আলহামদুলিল্লাহ আমি একটা স্কলারশিপ পেয়ে যাই। তারপরে মাস্টার ডিগ্রি শেষ করে অলিম্পিয়া শহরে চাকুরি নিয়ে চলে আসি। আমি আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জানাই, বাংলাদেশেও আমি একটা ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, যাদের কাজ ছিলো খুবই উঁচু মানের। যারা স্থাপত্যকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আমি খুবই খুশি যে, ভালো একজন স্থপতির সঙ্গে কাজ করার সুবিধা পেয়েছি। আমি একইভাবে আমেরিকাতে আসার পরে সুন্দরভাবে কাজ করেছি এবং নিজেও আর্কিটেকচার ফার্ম দিয়েছিলাম। আমি যে বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিতে ফোকাস করেছিলাম তা হচ্ছে এনার্জি কনজারভেশন ইন আর্কিটেকচার (Energy Conservation in Architecture)। বিভিন্ন বড়ো বড়ো বিল্ডিং বা ফ্যাসিলিটিতে কীভাবে কম খরচে বিদ্যুৎ, বাতি ও এয়ারকন্ডিশনিং খরচ কমানো যায় এবং এতে আবহাওয়ার উপর কী প্রভাব পড়ে সেটার ওপর আমার মাস্টার্স ডিগ্রিটা ছিলো। আমি এখনো যে চাকুরি করছি সেটা আর্কিটেকচার এবং এনার্জিকে কেন্দ্র করে।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি এবং আমার স্ত্রী মিসেস দিনা ফারজানা সাখাওয়াত, বেশ কিছু সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার চেষ্টা করি। আমাদের তিন ছেলে ছাত্রাবস্থায় বয়েজ স্কাউট (Boys Scout) করতো, তার ফলে আমরাও যুক্ত ছিলাম বয়েজ-স্কাউট প্রোগ্রামের সাথে।

ছবি :স্কাউটিং পরিবার : ২০১০ সালে আমাদের বড়ো ছেলে সারেক আমেরিকার সর্বোচ্চ স্কাউট র্যাংক ঈগল স্কাউট (Eagle Scout) অর্জন করে। সারেকের ছোট দু ভাই তখনো কাবস (Cubs)।

ছবি : ছোটবেলায় আমি বাংলাদেশে কাবস এবং স্কাউট প্রোগ্রামে যুক্ত ছিলাম। তাই তিন ছেলে যখন স্কাউটিং করলো আমেরিকাতে, আমিও স্কাউট লিডার হিসেবে যোগ দিলাম। ছবিটা ২০১৯ সালে দ্বিতীয় ছেলে সাজিদের Eagle Scout র্যাংক অনুষ্ঠানে, ক্যাপিটাল বিল্ডিং, অলিম্পিয়া, ওয়াশিংটন।
প্রবাসীকণ্ঠ : প্রবাসে আপনার সাফল্য, সন্তানদের সাফল্য সম্পর্কে কি কিছু বলবেন? (স্ত্রী ও সন্তানদের নাম ও পরিচয় তুলে ধরলে ভালো হয়)
সাখাওয়াত ইবনে আমীন : আসলে সাফল্য বা সফলতা এর সংজ্ঞা কী? একেকজনের কাছে সফলতার একেক রকম সংজ্ঞা হতে পারে। যেমন কেউ পুরস্কার পেয়ে খুশি হতে পারে, কেউ আবার আর্থিকভাবে এবং সম্পত্তি দিয়ে সফল হতে পারে। আমার কাছে সাফল্যটা অন্যরকম--
আমি সাফল্যকে পরিমাণ করি নিজে কী করলাম, কী পেলাম, তার থেকে অন্য কারোর কোনো উপকার করতে পারলাম না কি, কারো পাশে বিপদের সময় দাঁড়াতে পারলাম নাকি।
ছোটবেলায় আমি যখন স্কুল, কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতে নাম দিতাম বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়, অজস্র পুরস্কার পেয়েছি। জেলা পর্যায়ে, বিভাগীয় পর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি করে পুরস্কার পেয়েছি, এমনকি President Award বা রাষ্ট্রপতির পদক পেয়েছি চিত্রাংকন এবং পেন্সিল স্কেচ প্রতিযোগিতায়। এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে সব সময় চিন্তা করি, নিজের থেকে অন্যের জন্যে কিছু করা যায় কিনা। কীভাবে আরেকজনকে উপকার করা যায় এ জন্যে কাজের ফাঁকে ফাঁকে সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেদেরকে জড়িয়ে রাখতে চেষ্টা করি। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট দিনে আমরা, এখানকার বাংলাদেশী কমিউনিটির লোকজন, স্থানীয় Homeless Shelter-এ খাওয়া দিয়ে আসি। আমাদের মসজিদের যে মুসলিম কমিউনিটি আছে, তাদের তরফ থেকে আমরা অন্য ধর্মের, অন্য কমিউনিটির, অন্য জাতির জনগোষ্ঠীর সঙ্গে Inter-Faith মিটিং মানে আন্তঃধর্ম আলোচনা করি।
সফলতা তখনই আসবে, যখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একে অন্যের জন্যে কাজ করে যাবে নিঃস্বার্থভাবে। একসঙ্গে সবাই মিলে আগামীর পথে পা বাড়াবে, উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে। নিজের ভালো দেখার সাথে সাথে অন্যের ভালোটাও উপলব্ধি করবে। আমরা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
স্ত্রী ও সন্তানদের পরিচয় :
আমার স্ত্রীর নাম মিসেস দিনা ফারজানা সাখাওয়াত। তিনি হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। বাংলাদেশে তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়ালেখা করেছেন। আমেরিকাতে এসে কম্পিউটারের ওপরে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়েছেন।

ছবি: সপরিবারে সাখাওয়াত ইবনে আমীন, মিসেস দিনা ফারজানা সাখাওয়াত এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা।
আমাদের তিন ছেলে, বড়োজনের নাম সারেক আমিন, সে ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি (Washington State University) থকে গ্রাজুয়েশন করে ডালাস টেক্সাস-এ Law অফিসে কাজ করছে। দুবছর হলো বিয়ে হয়েছে, আমার বৌমার নাম মিম জাকিয়া মিজান। বৌমা (মিম) বায়ো-মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে একটা হাসপাতালে চাকরি করছে এবং কম্পিউটার সায়েন্সে দ্বিতীয়বার Bachelor ডিগ্রি করেছে।

ছবি : ২০১১ সাল, বড়ো ছেলে সারেকের হাই স্কুল গ্রাজুয়েশনের ছবি।
আমার মেজো ছেলে সাজিদ আমিন, দু বছর আগে কম্পিউটার সায়েন্স পাস করে চাকরি করছে। সে পড়ালেখা করেছে সিয়াটেল-এর ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন (University of Washington)-এl

ছবি: চার বছর আগে ২০২১ সালে, ছোট ছেলে সামির ভর্তি হয় এম আই টি (MIT-Massachusetts Institute of Technology)তে। আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জানাই ছেলেদের মাধ্যমে পৃথিবীর নামকরা কিছু ইউনিভার্সিটি বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। বোস্টন শহরে আছে হারবার্ড (Harvard) এবং এমআইটির (MIT) মতো জগৎ বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার ছোট ছেলে, সামির আমিন, এ বছর পাস করলো এম.আই.টি. (MIT বা Massachusetts Institute of Technology) থেকে। সে চাকরি করছে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো শহরে।
আলহামদুলিল্লাহ, সবাই লেখাপড়া শেষ করে যে যার কাজে ব্যস্ত।

ছবি : এই বছর ২০২৫ সালের মে মাসে ছোট ছেলে সামির, এমআইটি থেকে গ্রাজুয়েশন করে। এম আইটি বিল্ডিং-এর সামনে গ্রাজুয়েশনের দিনের সপরিবারে একটা ছবি।
প্রবাসীকণ্ঠ : প্রবাসে কখন খুব ভালো লাগে আর কখন খারাপ লাগে?
সাখাওয়াত ইবনে আমীন : ভালোলাগার ব্যাপারটা খুব মজার। কিছু ভালোলাগা একান্ত ব্যক্তিগত নিজের জন্যে, আবার কিছু ভালোলাগা হতে পারে অন্যের জন্যে, পরিবারের জন্যে, সমাজের জন্যে। বিদেশে বসে দেশের কোনো ভালো খবর পেলে মনটা ভরে যায়। তেমনি পরিবারের কোনো সদস্য যদি ভালো কোনো রেজাল্ট করে, নতুন চাকরি পায় খুব খুশি লাগে। আর সামাজিকভাবে ভালোলাগা হচ্ছে : যখন দেখি অন্য কোনো পরিবারকে সাহায্য করতে পারছি; কারো বিপদে হেল্প করতে পারছি, তখন মনটা একটু খুশি হয়।

ছবি : দেশের কোনো আত্মীয়-স্বজন বিদেশে আমাদের দেখতে আসলে মনটা খুশিতে ভরে যায়, আর সেটা যদি নিজের মা হয় তাহলে তো কথাই নাই।
২০০৮ সালে আমার মা মিসেস ফাহমিদা আমিন যখন বেঁচে ছিলেন আমাদের শহরে বেড়াতে আসেন । ছেলেদের দাদি আর নানিকে নিয়ে সবাই আমরা হাজির হলাম টিউলিপ ফিল্ডে, যেটা মাউন্ট ভারনন শহরে অবস্থিত।
বিদেশে থাকলে একটা নো-কমপ্লেইন (No-Complain) অ্যাটিচিউড থাকা উচিত, কারণ এখানে সবকিছুই পাওয়া যায়, ইচ্ছামত ঘোরা যায়। দেশে যে দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় সামান্য বিদ্যুতের জন্যে, ট্রাফিক জ্যাম থেকে বাঁচার জন্যে, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং ওষুধ পত্রের উচ্চমূল্যের কারণে। সবকিছু মিলিয়ে বিদেশে জীবনযাপন কিছুটা সহজ আমি বলবো। আমেরিকাতেও চ্যালেঞ্জ আছে তবে অতোটা প্রকট নয়। এখানে নো-কমপ্লেইন attitude থাকলে সবচেয়ে ভালো।
তবে বিদেশে দুঃখটা খুবই ভয়ংকর। বিশেষ করে হঠাৎ যখন খবর আসে কোনো নিকট আত্মীয়-স্বজন, যেমন বাবা/মা কারো কোনো অসুস্থতার খবর, অথবা কারো মৃত্যুর খবর।
এতোদূর থেকে কিছু করার উপায় থাকে না, শুধু মনটা কষ্টের নীল ব্যথায় জমে থাকে। কারো সঙ্গে কিছু শেয়ার করার উপায় থাকে না।
প্রবাসে থাকার কারণে আপনি দেশের এমন কী মিস করেন, যা আপনাকে মাঝেমধ্যে বিবর করে তোলে?
সাখাওয়াত ইবনে আমীন : প্রবাসে থাকলে যেটা হয়, সেই সে ছোটবেলার স্মৃতি বেশি বেশি মনে পড়ে।
বিশেষ করে ছোটবেলার বন্ধু, সহপাঠী, কাজিন, তাদেরকে মিস করি।
বিদেশে নতুন বন্ধু, নতুন সমাজ, নতুন করে গড়ে তুলতে হয়। কিন্তু অতীতের স্মৃতি ঘুরেফিরে সব সময় মনে আসে। ঘোটবেলার বন্ধুদের কি ভোলা যায়?
দেশি খাওয়া-দাওয়া মিস করি। আমরা চট্টগ্রামের লোক। চট্টগ্রামের শুঁটকি, চট্টগ্রামের বিভিন্ন রকম সুস্বাদু খাওয়া-দাওয়া মিস করি। আর একটা জিনিস--বিষণ্নতা আসে রমজানের শেষে যখন ঈদ আসে।
সেই দেশি ঈদের আমেজটা পাওয়া যায় না। দেশে ঈদ আসার আগেই বেশ হই হই রই রই শুরু হয়, চারিদিকে ঈদের প্রস্তুতি। তারপর ঈদের সময় আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করা, বিভিন্ন বাসায় যাওয়া, মজার মজার খাওয়া--এসবই মিস করি।
EID MUBARAK

ছবি : ঈদের সময় দিনের বেলা নামাজের পরে বাংলাদেশিসহ অন্য দেশের মুসলিম কমিউনিটি আমাদের বাসার ব্যাক ইয়ার্ডে সমাবেশ করে থাকে। ২০১৮ সালের রমজানের ঈদ পরবর্তী গেট টুগেদার।

ছবি : ২০১৮ সালের রমজানের ঈদের বিকেল বেলায় আমাদের বাসার ব্যাক ইয়ার্ডে খেলাধুলা এবং সমাবেশের দৃশ্য।
প্রবাসীকণ্ঠ : আপনি কি নস্টালজিক হন? কিসে হন? শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোর কথা কি মনে পড়ে?
সাখাওয়াত ইবনে আমীন : ভীষণ কঠিন প্রশ্ন। অবশ্যই নস্টালজিক হই।
ছোটবেলার স্মৃতি কে বা ভুলতে পারে! আমার মনে পড়ে, আমরা চট্টগ্রাম শহর থেকে মিরেরশ্বরাইয়ে শুভপুর ব্রিজের কাছে আমাদের গ্রামের বাড়ি 'পশ্চিম জোয়ারে' যেতাম। সেখানে আমাদের জন্যে দাদি, চাচা, চাচিরা মজার মজার পিঠা আর খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করতেন।
সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ ছিলো বিশাল পুকুর। আমরা অপেক্ষা করতাম গ্রামের বাড়িতে যেয়ে কখন পুকুরে ঝাঁপ দেবো। সারাদিন সাঁতার কেটে ক্লান্ত হয়ে, মিষ্টি কাঁঠাল, সুস্বাদু আম, লিচু গাছ থেকে পেড়ে খেতাম।
বিদেশে এসে আমরা ভ্রমণে যাই, ট্রাভেল করি, কিন্তু সেই গ্রামের স্মৃতি কখনো ভোলা যায় না।
শৈশব, কৈশোরে যেসব স্কুল-কলেজে পড়েছি, সেসব বন্ধুর কথা মনে পড়ে। সেই সময়কার স্মৃতি মনে হয়, কতো আপন ছিলো সেই সব স্কুলের বন্ধুরা!! আমাদের শিক্ষকদের কথা মনে পড়ে।
অনেক কিছুতে নস্টালজিক হই।
প্রবাসীকণ্ঠ : আপনি কি দূর থেকে মাতৃভূমির প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করেন? সে দায়বদ্ধতা থেকে কিছু করেছেন, করছেন, না করার কথা ভাবছেন?
সাখাওয়াত ইবনে আমীন : অবশ্যই। দেশ থেকে পড়ালেখা করে এসে বিদেশে মাস্টার্স করার পরে থেকে গেলাম বিদেশে। এর জন্যে নিজেকে বেশ লজ্জিত মনে হয়। তবে দেশের জন্যে অনেক কিছু করা সম্ভব বিদেশ থেকে।
আমরা যারা অলিম্পিয়া শহরে আছি, বিভিন্ন সময়ে দেশের দুর্যোগে বা দেশের প্রয়োজনে আমরা একত্র হয়ে একসাথে ফান্ড রেইজিং করে দেশে টাকা পাঠাতে চেষ্টা করি।
বছর পাঁচেক আগে ভীষণ শীত পড়েছিল বাংলাদেশে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর ওইসব এলাকায়। ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশ সরকার, বোয়িং কোম্পানি থেকে দুটো Boeing Jet Plane কিনে। ওই দুইটা প্লেন যখন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলো, এখানকার সব বাঙালি মিলে প্লেন ভর্তি করে কম্বল, গরম কাপড় এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাঠিয়েছিলো দেশে। দুটা খালি প্লেন দেশে যাওয়ার থেকে অন্তত কিছু শীতবস্ত্র নিয়ে যেতে পারলো--এটাই মনে শান্তি। হয়তো পুরা দেশের সবাইকে সাহায্য করা যাবে না, কিছু লোক তো উপকার পাবে!
এইতো গত বছর যখন হঠাৎ করে বন্যা হলো, ভারতের পানি চলে আসলো, ভাসিয়ে দিলো আমাদের চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী। আমরা বিভিন্ন জায়গায় বন্যার্তদের সাহায্যের জন্যে আর্থিক সহযোগিতা এবং ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করে খুবই তাড়াতাড়ি দেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। এর থেকে বেশি কিছু করতে পারিনি বলে মনটা খারাপ ছিলো।
নিয়মিতভাবে আমরা দেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কাজ করে যাই, চেষ্টা করি আমাদের জ্ঞান শেয়ার করতে অথবা আর্থিকভাবে সহায়তা করতে। চট্টগ্রামে আমাদের দাদার নামে একটা হাই স্কুল আছে, আমরা নিয়মিত সেখানে কিছু সহায়তা করে থাকি। বাংলাদেশ থেকে যারা আসে সবারই মন পড়ে থাকে দেশে কিভাবে কিছু একটা করা যায়।
আমি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাপ্তাহিক উপস্থাপনা প্রবাসীকণ্ঠের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই, আমাকে এই প্ল্যাটফর্মে আমার ব্যক্তিগত জীবনের গল্প শেয়ার করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে। আশা করি, আমার অভিজ্ঞতা অন্যদের জন্যে অনুপ্রেরণা হবে। চাঁদপুর কণ্ঠের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। ধন্যবাদ।
ডিসিকে/এমজেডএইচ