প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৫, ১২:৩৬
পথভ্রান্ত পথিক

অতি প্রাচীন কালের অতি সার্বিক সৌন্দর্য মণ্ডিত এই বঙ্গদেশ ভূ-স্বর্গের আদলে নদীমাতৃকতা নিয়ে কখনো সোনার বাংলা, কখনো বাংলাদেশ, কখনো রূপসী বাংলার বিশেষণে বিশেষায়িত হয়েছে। সুদূর উত্তর বঙ্গের উৎস থেকে স্রোতস্বিনী রূপে বঙ্গের বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে বারিরূপে সাগরে কর দিতে নিয়ত ধাবিত হতো সাগর অভিমুখে। সাথে সাথে ক্ষুধার্ত বঙ্গভূমির উর্বরতার জন্যে বিতরণ করা হতো উর্বরতা সহায়ক পলি মাটি। আজ রাজশাহীর হারিয়ে যাওয়া সাতটি নদী নারদ-সন্ধ্যা-স্বরমঙ্গলা-বারাহী-হোজা-মুসা-দয়া সব গুলোর উৎসমুখ ছিলো রাজশাহী আর গন্তব্য ছিলো বঙ্গোপসাগর। তাতেই এই অনুপম বাংলা হয়ে যেতো সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা আর তাতেই জন্মাতো পৃথিবী-বিখ্যাত সোনালী অঁাশ। এক সময় এদেশে নদ-নদীর শাখা নদী ছিলো প্রায় ১০০৮টি। ষাটের দশকে এদেশে মোট নদ-নদী ছিলো ৭৫০টি। এর মধ্যে ২৩০টি মৃত আর প্রবহমান ছিলো ৫২০টি। এদের মধ্যেও অনেকগুলো নাব্যতা এবং স্রোতধারা হারায়ে সহস্র শৈবাল ধাম কর্তৃক আক্রান্ত হযে বিলুপ্তির পথে। এজন্যে কিন্তু মানব কারসাজি হাড়ে হাড়ে দায়ী।
এ বাংলায় জনগণ বহু রঙে রঞ্জিত শাসকের শাসনকাল প্রত্যক্ষ করেছে এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হয়েছে। যেমন সুলতানী শাসন, জমিদারি শাসন, নবাবী শাসন, সুবেদারি শাসন (শায়েস্তা খঁার আমলে টাকায় আট মণ ধান বিক্রি হতো), ইংরেজ আমল, সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক শাসন, সামরিক গণতন্ত্রের শাসন, স্বৈরশাসন ইত্যাদি। রংধনুর সাতটি প্রাকৃতিক রং বে-নী-আ-স-হ-ক-লা এর সাথে বাংলার আকাশে যুক্ত হয়েছে একটি হালকা সবুজ রং, যা “ছাত্রনেতা থেকে সরাসরি সরকারী দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বনে যাওয়া।” এতোকাল আমাদের জানা ছিলো শ্বেত-শুভ্র শ্মশ্রুমন্ডিত ব্যক্তিত্বই রাজনীতিতে অভিজ্ঞ। যা ১৯৪৭ সাল থেকে জুলাই বিপ্লব ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশীদেরকে বহু কন্টকাকীর্ণ-বন্ধুর পথ পরিক্রমা করিয়ে দেশের অন্তঃসারশূন্য রাজত্ব কালে উপনীত করেছিলো। তাই দীর্ঘকাল অবধি সুশাসন বঞ্চিত বাংলাদেশীরা প্রশাসনিক দুর্নীতি-অরাজকতা-দ্বিচারিতা-লুণ্ঠনের বিপরীতে এক মহত্ত বিজড়িত শুভ প্রত্যুষকে আলিঙ্গন করেছিলো। যার পরিণাম অনাগত ভবিষ্যতের গর্ভে সুপ্ত অবস্থায় আছে। এতেই বাংলার জনগণ হতাশ, বিভ্রান্ত এবং আশাহত হয়েছে। কারণ মনোনীত উপদেষ্টা পরিষদ এই সুদীর্ঘ নয় মাসেও সময়োপযোগী শিক্ষানীতি-রাজনীতি-অর্থনীতি-আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্বাভাবিকত্ব এবং কিশোর সন্ত্রাসের অবদমন, কোনো তরফ থেকেই দৃশ্যমান কোনো সুখবর নেই। বরং বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সফলতাই যেন নির্মমভাবে কটাক্ষ করছে। তাতে বাংলাদেশী জনগণ, শাসক এবং শাসিত গোষ্ঠির মধ্যে বিরাজমান চরম অনৈতিকতা বহুল কর্মকাণ্ডের দ্বারা এদেশের রাজনীতিতে নতুন এক অজানা অশনিসংকেত সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে জাতি আজ দিশেহারা। (সূত্র: ২৮শে এপ্রিল ২০২৫ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন) যেটি তীর ভাঙ্গা ঢেউ আর নীড় ভাঙ্গা ঝড়ের মতো তীব্র মাত্রিক। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কণ্ঠে ধ্বনিত পংক্তিগুলো মনে পড়ে যায় : “নতুন কিছু করো, একটা নতুন কিছু করো। নাকগুলো কাটো, কানগুলো ছঁাটো। পা গুলো উঁচু করো, মাথা দিয়ে হঁাটো।” আমাদের এই অববাহিকায় অনেক গতানুগতিকতাকে ধুয়ে-মুছে নতুনত্বে প্রকাশ করতে হবে। এই সর্বংসহা ধরিত্রীর অংশবিশেষ বাংলাদেশের মাটি ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১,১৯৭৫, ২০০৪, ২০০৯ এবং ২০২৪ এ সমস্ত বছরগুলোতে এই সোনার বাংলা নরশোণিতে রঞ্জিত হয়েছিলো শুধুই ক্ষমতার তুচ্ছ আক্রোশে। এগুলোর হিসাব-নিকাশ একজন সুশাসক কেবল মাত্র একজন সুশাসকই নিতে অথবা দিতে পারে। আমরা শুধুই আমাদের নাগরিত্ববোধের যথাযথ কর্তব্যটুকু সম্পাদন করে যাবো মাত্র। স্বাভাবিক ভাবেই দেশপ্রেমে প্রকৃত সাম্যতা বোধের সৃষ্টি হয়, পক্ষান্তরে ক্ষমতাপ্রেমিক মানুষের মধ্যে পশুত্ব বোধের উদ্রেক ঘটে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চঁাদপুর।