সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ

প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

একজন মা, এক অনন্য প্রতিষ্ঠান : জোবায়দা বেগম
মুক্তা পীযূষ

জগতে প্রতিটা সন্তানের জন্যে এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হলো তার মা। মা আসলে কেবল ব্যক্তি মাত্র নন, মা হলেন সন্তানের জন্যে একটা আপন পৃথিবী। মায়ের চারপাশ প্রদক্ষিণ করলে সন্তানের জন্যে আসলে বিশ্বব্রহ্মা- ঘোরার সমান হয়ে যায়। মায়ের পায়ের নিচে যেমন সন্তানের বেহেশত আছে, তেমনি মায়ের অন্তরে আছে সন্তানের অনন্য সুধা। মা-ই সন্তানের বল, মা-ই সন্তানের দুর্বলতা। মা আছে বলেই জগৎ এতো সুন্দর। জীবিত অবস্থায় মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা, দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রকাশিত হওয়া সন্তানের জন্যে এক অনন্য প্রাপ্তি। এ সুযোগ সবাই যেমন পায় না, তেমনি অনেকে সুযোগ পেয়েও তা যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করতে পারে না। বর্তমান চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার বলাখাল কাজী বাড়ির বারোজন সন্তানের পক্ষে জীবিত অবস্থায় মায়ের প্রতি বই প্রকাশের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশের পরম সৌভাগ্য ঘটেছে। ফরিদগঞ্জের ভাটিয়ালপুর এলাকার বৃটিশ আমলের পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে জোবায়দা বেগমের বিয়ে হয় বলাখাল কাজী বাড়ির সন্তান কাজী ছেফায়েত উল্লাহর সাথে। তাঁদেরই প্রেমময় দাম্পত্যের ফসল তেরটি স্বর্ণকুসুম। যাদের বারোজন সৎ পথে জীবন পরিচালনায় মা ও বাবার পথকে অনুসরণ করেছেন আন্তরিকভাবে। সেই বারোজন পুত্র-কন্যার মৌলিক লেখায় ফুটে ওঠা স্মৃতিচারণ ও মাকে মূল্যায়নের অমৃত রসায়নকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে ‘আমাদের মা’ শীর্ষক গ্রন্থটি। পুত্রকন্যার লেখাকে মলাটবদ্ধ করতে গিয়ে গ্রন্থটিতে ভাগে ভাগে পত্রস্থ করা হয়েছে পুত্রকন্যার বদৌলতে পাওয়া পুত্রবধূ, জামাতা, নাতি-নাতনি ও তাদের ঘরের সন্তান-সন্ততির স্মৃতিচারণ। গ্রন্থটিতে আরো সংযোজিত হয়েছে মায়ের আলোকচিত্র ও মায়ের নিজের লেখা স্মৃতিকথা। বাবার আদুরে মেয়ে জবা তাঁর জবানিতে জানিয়েছেন, পুলিশ কর্মকর্তা বাবার কড়া শাসনে তাঁরা বড় হয়েছেন। এমনকি নানাবাড়ি বেড়াতে গেলেও প্রতিবেশীর ঘরে গিয়ে যাতে তাঁরা ঘোরাফেরা না করেন সে ব্যাপারেও কড়া নির্দেশনা ছিল। নিজের বাবাকে নিয়ে মজার এক ঘটনার কথা বলেছেন বারোটি স্বর্ণকুসুমের মমতাময়ী মা জোবায়দা বেগম। তাঁর বান্ধবী একদিন আলোচিত এই মায়ের বাবাকে দেখতে চান। তাঁর বাবা যখন আসলেন, তখন ঐ বান্ধবী বলে উঠলেন, ওমা! এ যে দেখি মানুষ! তখনকার ছোট মেয়েটি মনে করেছিল, দারোগারা বুঝি মানুষ নন, অন্যকিছু।

বাল্যবিবাহের ওই দিনগুলোতে জোবায়দা বেগম ছিলেন উচ্চ প্রাইমারি পাস। অর্থাৎ সব বই তিনি নিজে নিজে পড়ার দক্ষতা তৈরি হয়েছিল। তিনি শরৎ চন্দ্র হতে শুরু করে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল সবই পড়েছেন। বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ যেমন পড়েছেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথের বৌঠাকুরানীর হাটও পড়েছেন। তাঁর হাতের লেখাও ছিল সুন্দর। তাঁর এই পড়াশুনার কারণে তাঁকে নতুন বউ হিসেবে গ্রামবাসীরা দেখতে এলে তাঁর হাসিও পেতো। এই মাকেই তাঁর স্বামী কাজী সাহেব কিনে দিয়েছিলেন হোমিওপ্যাথির বই। যাতে ছেলেমেয়েদের রোগে-শোকে তিনি ব্যবস্থা দিতে পারেন।

মায়ের আন্তরিক চেষ্টা ছিল যাতে তাঁর প্রতিটি ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে যায়, পড়াশুনায় শিক্ষিত হয়। তারা সবাই মায়ের এ স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছে। অন্য কাউকে নিয়ে বেগ পেতে না হলেও মাকে বেগ পেতে হয়েছিল তাঁর ছেলে দুরন্ত শাহাদাতকে নিয়ে। অতি শৈশবে নিজের ছোটবোনকে সরিয়ে নিজেই মাতৃ-অমৃত পান করে বোনকে ঠকাতো। তার যাতে ভালোভাবে পড়া হয় এই ভেবে তাকে পাঠানো হলো বড় বোনের কাছে, চট্টগ্রামে। এই ছেলে ক্লাস ফাইভে ও এইটে বৃত্তি পেয়ে মাকে সুখী করে। মায়ের আফসোস ছিল, তিনি সচল থাকাকালীন তাঁর পঞ্চম ছেলে (শাহাদাত) জীবনে প্রতিষ্ঠা পায়নি। বইটির প্রকাশক পারুল নিজেই স্বীকার করেছেন, মাকে নিয়ে লেখা আহ্বানের পর কারো লেখা আসেনি। এই বইয়ের সম্পাদক জানিয়েছেন, তাঁর মেঝ ভাই-ই প্রথম মাকে নিয়ে লেখা দেন। এরপর ধীরে ধীরে সবার লেখা আসতে শুরু করে।

‘আমাদের মা’ বইটি এক সংগ্রামী নারীর অনবদ্য জীবনকথা। এই মা সংগ্রাম করেছেন বারোজন সন্তানকে মানুষ করার জন্যে। সমাজকে বারোটা আলোকবর্তিকা দান করতে পারা সহজ কথা নয়। জবা নামের মায়ের মধ্যে ফুলের শুদ্ধতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল জীবনকে সাজানোর নিরন্তর প্রয়াস। স্বামীর বদলির চাকরিতে এই মহীয়সী মা ছিলেন সন্তানদের উপযুক্ত গন্তব্যে পৌঁছানোর বাতিঘর। মায়ের আশঙ্কা ছিল, ছেলেদের কেউ যদি জেলে বা চাষা হতো তবে তা একজন দারোগার মেয়ের জন্যে হয়ে যেত পরাজয়ের গ্লানি। কিন্তু তাঁর ছেলেমেয়েরা কেউই সেই গ্লানির ভাগীদার তাঁকে করেনি।

মায়ের জন্যে লেখা ‘আমাদের মা’ বইটির মধ্য দিয়ে বাঙালির সংগ্রামমুখর বিজয়িনী নারীরই জয়জয়কার ফুটে উঠেছে। ঊনিশ্শো আটাশ সালে জন্ম নেওয়া এক মা সদ্য বিপত্নীক এক স্বামীর ঘরকে নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে শুধু স্বামীকেই ভাত রেঁধে খাওয়াননি, বরং ছেলেমেয়েদের জন্যে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করেছেন। আজকের আলোচ্য এই মা জয়িতা বা রত্নগর্ভা মায়ের সম্মাননা দেয়ার যোগ্য ছিলেন। আমরা এইসব মায়ের জীবনচরিতকে সামনে রেখেই আজকের মায়েদের প্রশিক্ষণের কথা চিন্তা করতে পারি।

বারো সন্তানের সাহসিনী সৃজনশীল মা জোবায়দা বেগম জবার স্মৃতিতে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের নারীদের উদ্দেশ্যে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলি,

‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’।

লেখক : নারীনেত্রী; সভাপতি, বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ ও পদক্ষেপ বাংলাদেশ, চাঁদপুর জেলা শাখা; সাবেক সভাপতি, চাঁদপুর সেন্ট্রাল ইনার হুইল ক্লাব।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়