মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৪

মতলব উত্তরে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সব গ্রামীণ খেলাধুলা

প্রাধান্য পাচ্ছে খেলার মাঠের পরিবর্তে কম্পিউটার ও মোবাইল স্ক্রীন

মাহবুব আলম লাভলু
প্রাধান্য পাচ্ছে খেলার মাঠের পরিবর্তে কম্পিউটার ও মোবাইল স্ক্রীন
শামসুজ্জামান ডলার (ক্রিকেট খেলোয়াড়), বোরহান উদ্দিন (ফুটবল খেলোয়াড়), বোরহান উদ্দিন ফরাজি (ভলিবল খেলোয়াড়)

মানুষের শারীরিক খেলাধুলা কালের আবর্তে কমে চলছে। বেড়ে চলছে এখন ভার্চুয়াল খেলায় বেশি মনোযোগ দেওয়ার বিষয়। খেলার মাঠের পরিবর্তে কম্পিউটার ও মোবাইল স্ক্রিন প্রাধান্য পাচ্ছে। আগে দলগতভাবে খেলার ও দেখার বিষয়ে মনোনিবেশ ছিলো। মানুষ টেলিভিশন বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ওপর বেশি নির্ভরশীল হওয়ার কারণে মাঠগুলোতে খেলোয়াড় ও দর্শনার্থীর শূন্যতা বিরাজমান বলে মনে করেন ৮০/৯০ দশকের অনেক খেলোয়াড়। আগেকার দিনে খেলাধুলা মূলত শারীরিক সুস্থতা, বিনোদন ও সামাজিক মেলামেশার একটি মাধ্যম ছিলো। গ্রামাঞ্চলের পাড়ায় তেমন কোনো খেলার মাঠ ছিল না, অনাবাদি জমি ও স্কুল-কলেজের মাঠই ছিলো খেলাধুলার জন্যে মাঠ। পাড়ার অনাবাদি জমিতে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে দলবদ্ধভাবে খেলাধুলায় মেতে উঠতো খেলোয়াড়েরা। খেলার জন্যে তেমন কোনো দামী সরঞ্জামের প্রয়োজন হতো না। সাধারণ বল, ব্যাট বা অন্যান্য জিনিস দিয়ে খেলা চলতো।

আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে জনপ্রিয় সব গ্রামীণ খেলাধুলা। এসব খেলাধুলার মধ্যে রয়েছে : কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা, ডাংগুলি, ঘোড়া দৌড়, ফুটবল, ভলিবল, নৌকা বাইচ, গোল্লাছুট, চারগুটি, লাঠি খেলা, লং জাম্প, সাত পাতা, ফুল টোক্কা, মোরগ যুদ্ধ, হাডুডু। গ্রামে আগের মতো চোখে পড়ে না ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা।

বর্তমানে খেলাধুলার ধরণ অনেকটাই বদলে গেছে। শারীরিক খেলার পাশাপাশি ভার্চুয়াল গেম, কম্পিউটার বা মোবাইলের মাধ্যমে খেলাধুলার প্রচলন বেড়েছে। মাঠগুলোতে আগের মতো জমে উঠছে না খেলাধুলা। মাঠে কোরবানি হাট বসাতে দীর্ঘদিন খেলার অনুপযোগী থাকতে দেখা যায়।

বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে পুরোনো দিনের খেলাধুলাগুলো এখন তেমন চোখে পড়ে না। এখন দেখা যায় ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলার প্রচলন । প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ কমে যাচ্ছে। শিশুদের মধ্যে বাইরে খেলতে যাওয়ার প্রবণতা কমছে এবং ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আসক্তি বাড়ছে। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দলীয় ব্যানারে আয়োজন হচ্ছে ফুটবল ও ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। এই টুর্নামেন্টগুলোতে দর্শকের আনাগোনা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।

মতলব উত্তর উপজেলার প্রবীণ ও নবীন খেলোয়াড়, সংগঠক ও দর্শকের সাথে কথা বলে উপরের বিষয়গুলো ধারণা করা গেছে।

গ্রামের প্রবীণদের সাথে আলাপচারিতায় তারা বলেন, এক সময় গ্রামবাংলার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা ও বয়স্ক ব্যক্তিরা তাদের নানান কর্মব্যস্ততার ফাঁকে বিভিন্ন ধরনের খেলা করে সময় কাটাতেন। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলো : কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা, ডাংগুলি, ঘোড়া দৌড়, ফুটবল, নৌকা বাইচ, কানামাছি, গোল্লাছুট, চারগুটি, লাঠি খেলা, দীর্ঘ লাফ, সাত পাতা, ফুল টোক্কা, মোরগ যুদ্ধ ও হাডুডু। এসব খেলা ছিলো বিনোদনমূলক, স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক ও প্রতিভা বিকাশের কার্যকর মাধ্যম। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় ও প্রযুক্তির বিকাশের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে জনপ্রিয় গ্রামীণ সব খেলাধুলা। সময়ের বিবর্তনে মাঠ, বিল-ঝিল ভরাট হয়ে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী এসব খেলাধুলা । একটা সময় ছিলো গ্রাম থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত শিশু ও যুবকরা পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন খেলাধুলায় অভ্যস্ত ছিলো। অবসরে দল বেঁধে খেলতো নানা প্রকারের খেলা। বাড়ির উঠান থেকে শুরু করে রাস্তার আনাচেকানাচে, খোলা মাঠে কম পরিসরেই খেলা যেতো। এখন ছেলেমেয়েরা সবাই মোবাইলে আসক্ত।

৮০/৯০ দশকের ফুটবলার, হানির পাড় গ্রামের বোরহান উদ্দিন জানান, আমি সব সময় স্ট্রাইকার পজিশনে খেলতাম। ফুটবল ছিলো নেশা। প্রতিটি মাঠে ফুটবল খেলার আয়োজন থাকতো। মাধ্যমিক স্কুলে ফুটবল খেলার ব্যাপক আয়োজন থাকতো। এখন এ খেলাগুলো আয়োজন মানুষের মাঝে অজানা থাকে। ছেলেদের মাঝে এর কোনো আগ্রহ দেখি না। দর্শকপ্রিয় এ খেলাটি বেশি বেশি আয়োজন না থাকায় মাঠ দর্শকশূন্য হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ফুটবলের কথা আসলেই মনে পড়ে প্রয়াত স্বপন মিয়াজী ও সৈয়দ আহমদ, নুরুজ্জামান, কাজী শরীফ, গোলাম মোস্তফা, মাহবুবুল আলম, নুরুজ্জামান, আলমগীর মোল্লা, হান্নান খাঁন, সোহরাব হোসেন, মফিজুল ইসলাম, কবির, ইমাম হোসেন ও সেলিম মিয়ার কথা। এ উপজলার মাঠ গুলোতে তাদের বিচরণ ছিলো স্মরণযোগ্য।

এক সময়ের স্বনামধন্য হাডুডু খেলোয়াড়, হাঁপানিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শহীদ উল্ল্যাহ জানান, হাডুডু খেলা ছিলো জনপ্রিয় খেলার অন্যতম। বিভিন্ন জেলা থেকে হায়ার করে খেলোয়াড় আনা হতো। আমরাও যেতাম। দল বেঁধে খেলা দেখতে মানুষ আসতো। এখন আর হাডুডু খেলা দেখা যায় না। প্রয়াত আবুল হোসেন, আব্দুল খালেক, মান্নান লস্কর, হান্নান লস্করের মতো হাডুডু খেলোয়াড়দের কথা তিনি স্মরণ করেন।

ভলিবল খেলোয়াড় বোরহান উদ্দিন ফরাজী জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ গ্রাম ভিত্তিকও ভলিবল খেলা ছিলো। স্বল্প পরিসরের জায়গায় এ খেলার আয়োজন করা যেতো। তাই এর আয়োজন ছিলো সহজসাধ্য। কিন্তু এখন এ খেলার আয়োজন মনের কল্পনায়। বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে ভলিবল খেলা। আমি মনে করি, ভলিবল খেলার ব্যাপক পুনর্বাসন প্রয়োজন। ভলিবল খেলোয়াড় হিসেবে কবির সরকার, প্রয়াত হান্নান ফরাজি, চাঁন মিয়া, বোরহান উদ্দিন নান্টু, আ. হালিম ও আবুল হোসেন ফরাজির কথা মনে পড়ে ।

মতলবে এক সময়ের মাঠ কাঁপানো ক্রিকেটার ও ক্রীড়া সংগঠক শামসুজ্জামান ডলার মতলবের ক্রিকেটের সেকাল-একাল নিয়ে কথা বলেছেন দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে। তিনি জানিয়েছেন, আশির দশকে মতলব উত্তর উপজেলার মুখ উজ্জ্বল করে ক্রিকেট অঙ্গন মাতিয়ে বেড়িয়েছেন একই পরিবারের ৪ ভাই। এর মধ্যে সবার ওপরে যার নাম, তিনি হলেন মিজানুর রহমান। তিনি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সূর্য তরুণ স্পোর্টিং ক্লাব, ওয়ারীর স্পোর্টিং ক্লাব ও রূপালী ব্যাংক ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভাইস ক্যাপ্টেন ছিলেন মতলবের এই কৃতী সন্তান মিজানুর রহমান। জাতীয় দলে খেলেছেন অনেক দিন। তার অপর ৩ ভাই মুস্তাফিজুর রহমান, মাসুকুর রহমান, মাহমুদুর রহমান দীর্ঘদিন খেলেছেন ঢাকার প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে। এই চার রত্ন মতলবের চিকিৎসা ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ডা. গোলাম রসুলের আপন ভাতিজা। ২০০০-এর আগে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছেন মতলবের লুধুয়ার আরেক কৃতী সন্তান স্পিনার অলরাউন্ডার সাব্বির খান। সাব্বির খান ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবসহ বেশ ক'টি ক্রিকেট ক্লাবের অধিনায়কত্বও করেছেন। তিনি বিকেএসপির হ্যান্ডবলের এক সময়ের চীফ কোচ আলী আজগর খানের ছেলে। ফরজীকান্দি ইউনিয়নের নুরুল হক মানিক ঢাকার প্রথম বিভাগে অনেকদিন ক্রিকেট খেললেও পরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ফুটবলে। ফুটবলে তিনি ছিলেন জাতীয় দলের নিয়মিত খেলোয়াড়। ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ইয়ংমেন্স ফকিরাপুল সহ বেশ ক'টি ক্লাবের হয়েও তিনি ক্যাপ্টেন্সি করেছেন।

শামসুজ্জামান ডলার জানান, ক্রিকেটে মতলবের ইতিহাস সমৃদ্ধ থাকলেও তারা কেউই মতলবে বড়ো হননি, এমনকি মতলবের কোনো মাঠ থেকেও উঠে যান নি। ১৯৮৮ সালের পর থেকে মতলবের কিছু কিছু মাঠে ক্রিকেট খেলা শুরু হয়। তখন যারা শুরু করেছিলেন এবং অনেকদিন যাবৎ এই মতলবের বিভিন্ন মাঠে ক্রিকেট নিয়ে বিচরণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে টপ টেনিস ক্রিকেটেই ছিলো আধিপত্য। সে সময়ে উপজেলার বিভিন্ন মাঠে খেলেছেন চরকালিয়ার ডলার, রেজাউল, সুমন, আলমগীর, শ্যামল, তারা, ইকরাম, রবিন, ছেংগারচর এলাকার রিপন, সংগ্রাম, ফয়সাল, শাহিন, বাবু, মানিক, রিয়াদ, শিপন, ইব্রাহীম, মফিজ, শরিফ, পাঁচানীর নোমান, গজরার বকুল, লালপুরের মানিক ঢালী, মিজান সহ আরো অনেকে। বর্তমান সময়ের খেলোয়াড়দের মধ্যে টেপ টেনিসে সারা বাংলায় বিচরণ করছেন মতলবের টেপ টেনিস স্টার অলরাউন্ডার মুন্না। এছাড়াও বিভিন্ন মাঠ মাতাচ্ছেন ছেঙ্গারচরের রাব্বানী, নিয়ন, নিশ্চিন্তপুরের জিশান, ধনাগতার ইমাম হাসান, চন্দ্রাকান্দির রাকিব, চরকালিয়ার রাকিব সহ আরো অনেকেই।

সময়ের ব্যবধানে ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের মাঝে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আগের খেলোয়াড়রা কিছুটা রক্ষণাত্মক ব্যাটিং করলেও এখনকার ব্যাটাররা মারাত্মক আক্রমণাত্মক। আগের সময়ের বোলারদের বোলিংয়ে আগুনঝরা বোলিং দেখলেও এখনকার বোলাররা ব্যাটারদের কাছে অনেকটাই যেনো অসহায়। এখানে ক্রিকেট বলে কোথাও টুর্নামেন্টের আয়োজন হয় না, আয়োজন হয় টেপ টেনিস বলের টুর্নামেন্ট। তবে

এখানকার বিভিন্ন মাঠে ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন অপেক্ষকৃত কম হলেও আয়োজনটা হয় ব্যাপক জমজমাট। তবে টুর্নামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে স্থানীয় এক-দুজন খেলোয়াড়ের বেশি মাঠে খেলতে দেখা যায় না। ম্যাচগুলো জমজমাট করার জন্যে দলগুলো ব্যাপক টাকা খরচ করে সারাদেশে টেপ টেনিসে মাঠ মাতানো স্টারদের নিয়ে এসে এখানে খেলান। মতলবের আগের ক্রিকেটাররা প্রতিযোগিতামূলক বড়ো বড়ো ম্যাচে অংশগ্রহণ করলেও তারা কোনো ম্যাচ ফি নিতেন না, শুধুমাত্র আন্তরিকতার কারণেই খেলে দিয়ে আসতেন। তাছাড়া তখন ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি'র এতো ব্যাপক প্রচলনও ছিল না। কিন্তু এখন ম্যাচ খেলার ক্ষেত্রে ক্রিকেটাররা ম্যাচ ফি'র ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী। আগের ক্রিকেটারদের সাথে বর্তমান ক্রিকেটারদের সাথে তুলনামূলক বিচার করলে আগে ক্রিকেটাররা বিভিন্ন অঞ্চলে খেলতে গেলে সতীর্থ ও প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের সাথে অনেক বেশি আন্তরিক ছিলেন বলে মনে হতো। এখনকার ক্রিকেটারদের মধ্যে অনেকের মাঝেই আন্তরিকতার ঘাটতি ও অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়।

বিশ্বায়নের এই যুগে প্রচলিত গ্রামীণ খেলাগুলোর পরিবর্তে আধুনিক খেলা যেমন ক্রিকেট ও ফুটবল বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে। এ দুটি খেলার পাশাপাশি গ্রামীণ খেলাগুলো যাতে হারিয়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।বিভিন্ন স্থানে গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যেতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়