প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৬
হারিয়ে গেছে শৈশবে সময় কাটানো নানান ধরনের খেলাধুলা
বর্তমান প্রজন্ম আসক্ত হচ্ছে মোবাইল গেমসে

আজ থেকে ১৫/ ২০ বছর পূর্বেও গ্রামাঞ্চলের শিশু কিশোর মেতে থাকতো নানান দেশীয় খেলায়। দুজন, চার জন, অথবা দলবদ্ধ ভাবে মাঠে ময়দানে আনন্দ উল্লাসে মুখরিত থাকতো আমাদের শৈশব। লুকোচুরি, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, দড়ি লাফ, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, কাবাডি, বউচি, বাউলা খেলা, ডাংগুলি খেলা, মার্বেল খেলা, গুটি খেলা, সাতচারা, ঘুড়ি ওড়ানো, লাঠিখেলা (বিশেষত মেলায়), কুমির ডাক, কুতকুত, পুতুল খেলা,
এক্কা-দোক্কা (কুতকুত জাতীয়), হাড়িভাঙ্গা,
কানা-মাছি ছানা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে হারিয়ে যাওয়া এ সকল খেলাধুলার নাম জানা নেই। শৈশবের হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলা হারিয়ে গেলেও জাতীয় খেলা যে হাডুডু তাও অনেকের জানা নেই। ফুটবল, ক্রিকেট সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকলেও বর্তমান প্রজন্মের কাছে খেলাগুলোর আকর্ষণ তেমনটি দেখা মেলে না! আগে যেভাবে দলবদ্ধ হয়ে শিশু-কিশোর গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলায় মেতে থাকতো, বর্তমানে তারা মোবাইল গেমসের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। যেমন যুবক ও কিশোররা বেশি খেলছে PUBG Mobile, Free Fire, CODM, Mobile Legends।
শিশুদের মধ্যে ক্যাজুয়াল প্লেয়াররা খেলছে Ludo King, Carrom Pool, Subway Surfers,
পাজল/মাইন্ড গেমে Block Blast! আর Royal Match ট্রেন্ড করছে। এ ধরনের খেলাধুলায় বর্তমান শিশু-কিশোর আসক্ত হয়ে ঘরবন্দি হওয়ার পাশাপাশি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অনেকের মতে, এভাবে চলতে থাকলে আগামী প্রজন্ম মেধাহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
খেলাপ্রেমিক মনির হোসেন মিন্টু বলেন, আমাদের শৈশব কেটেছে পড়ার টেবিল ও খেলার মাঠে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে নানান রকমের খেলাধুলায় মেতে থাকতাম। যখন যা ভালো লাগতো তা-ই খেলতাম। কোথাও খেলার আয়োজন দেখলে ছুটে যেতাম। সারাদিন লেখাপড়ার বাইরে খেলাধুলা নিয়ে পরিকল্পনা করতাম। সেসব কিছু শুধুই স্মৃতি হয়ে রয়েছে। আগের মতো খেলাধুলার আয়োজন আর দেখা যায় না। আমাদের সন্তানদের শৈশবের খেলাধুলার কাহিনী শোনালেও তারা বিশ্বাস করতে চায় না। তিনি বলেন, আমরাই আমাদের শৈশবের খেলাধুলাগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি। আমরাই খেলার মাঠ ধ্বংস করেছি, তাদের হাতে মোবাইল তুলে দিয়েছি। তিনি বলেন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আবারও নতুন করে হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলাগুলোর সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। অন্তত সপ্তাহে একদিন করে হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কৃতি ও ক্রীড়া আয়োজন বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
মো. জসিম উদ্দিন বলেন, গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাগুলো, যেমন লুকোচুরি, হাডুডু, গোল্লাছুট, লাঠিখেলা, ইচিং বিচিং, দাঁড়িয়াবান্ধা, কড়ি খেলা, ডাংগুলি ইত্যাদি আধুনিকতা ও প্রযুক্তির প্রভাবে ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। এই খেলাগুলো কেবল বিনোদনই দিতো না, বরং শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। খোলা মাঠের অভাব, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি এবং আধুনিক বিনোদনের সহজলভ্যতার কারণে এই খেলাগুলো এখন প্রায় রূপকথার গল্পে পরিণত হয়েছে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগ নিতে হবে।
গণমাধ্যমকর্মী ফয়েজ আহমেদ জানান, ঘাম ঝরানো খেলাগুলো কমে যাওয়ায় শারীরিক স্থূলতা বাড়ছে। অতীতের খেলাগুলো শুধু আমাদের ঐতিহ্য নয়, এগুলো স্বাস্থ্যের টনিক।
ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়ক হলেও অনলাইন গেমে আসক্তি তাদের পড়াশোনা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক বন্ধনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ ও মাঠমুখী খেলার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা জরুরি।
সচেতন মহল মনে করেন, বর্তমান সময়ে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ খেলাধুলার পরিবেশ সংকুচিত হওয়া। আগের মতো খেলাধুলার পরিবেশ নেই। গ্রামীণ মাঠগুলো অনেকটাই পরিত্যক্ত। তাই বাধ্য হয়েই মোবাইল হাতে উঠতি বয়সী তরুণীদের সময় পার করতে হচ্ছে। বিদ্যালয়গুলোতে শরীর চর্চা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নিয়মিত আয়োজন না হওয়ায় ক্রীড়ামুখী হচ্ছে না যুব সমাজ। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহ সামাজিক ভাবে খেলাধুলার পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে মাদক, ইভটিজিং ও কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। তাই নতুন প্রজন্মকে অপরাধ প্রবণতা থেকে দূরে রাখতে তাদেরকে খেলার মাঠে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্যে যথাযথ ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে বলে অনেকেই মনে করেন।