সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ

প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

তথ্য-প্রযুক্তি জগতে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির সঠিক ব্যবহার

তথ্য প্রযুক্তি কণ্ঠ ডেস্ক ॥
তথ্য-প্রযুক্তি জগতে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির সঠিক ব্যবহার

১৯৬২ সালে মর্টন হেইলিগ তার Sensorama আবিষ্কারের মাধ্যমে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির ধারণার সূত্রপাত করেন। ১৯৬৮ সালে ইভান সুথারল্যান্ড সর্বপ্রথম মাথার সাথে বসানো ত্রি-মাত্রিক ডিসপ্লের আবিষ্কার করেন। ১৯৮৯ সালে জেরন লেইনার (Jaron Lainer) সর্বপ্রথম virtual reality শব্দটির প্রচলন করেন। কাজেই ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির জনক কে এ নিয়ে নিয়ে মতভেদ আছে।

প্রফেসর বারডিয়া (Grigore C. Burdea) তাঁর Virtual Reality Technology বইতে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটিকে অবগাহন (immersion), কল্পনার জগৎ (imagination) ও মিথস্ক্রিয়া (interaction)-এর সমন্বয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটিতে মানুষ কল্পনার রাজ্যে নিজকে নিমজ্জিত বা অবগাহন করে মিথস্ক্রিয়া করতে সমর্থ হয়।

ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির প্রকারভেদ

ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি মূলত ৫ প্রকার, যেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন কাল্পনিক জগৎ তৈরি করার জন্যে।

এক. Fully Immersive : সম্পূর্ণ ভার্চুয়্যাল জগৎকে রিয়েলেস্টিক বাস্তবমুখী করার জন্যে ফুললি ইমার্সিভ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়্যাল জগৎ তৈরি করলে মনে করবেন আপনি অন্য একটি জগতে রয়েছেন।

দুই. Semi Immersive : কোনো একটি ভার্চুয়্যাল জগৎকে আংশিক রিয়েলিস্টিক বাস্তবমুখী করার জন্যে সেমি ইমার্সিভ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এই প্রযুক্তি বেশিরভাগ বিভিন্ন ভিডিও গেমে ব্যবহৃত হয়।

তিন. Non Immersive : কোন ভার্চুয়্যাল জগৎকে তৈরি করা হবে, কিন্তু সেটা বাস্তবমুখী হবে না। এই ধরনের ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটিকে নন-ইমার্সিভ প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা হয়। বিভিন্ন ধরনের কার্টুন এবং ভিডিও গেম তৈরিতে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।

চার. Augmented Reality : অগমেন্টেড রিয়েলিটি ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির এমন একটি প্রকার যেখানে বিভিন্ন ক্যারেক্টার আপনার মনে হবে আপনার রুমের মধ্যে আছে, কিন্তু সত্যিকারে সেটা আপনার সাথে থাকবে না।

উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন হোম ডেকোরেটররা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আপনার বাসা কেমন হবে সেটা দেখাতে পারবে। যেমন আপনার ঘরের কোন্ স্থানে শোবার খাট রাখলে সেটা সুন্দর লাগবে, তিনি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আপনাকে অনুধাবন করাতে পারবেন।

পাঁচ. Collaborative VR: ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির এই ভাগে একটি নতুন জগৎ তৈরি হয়ে যায়। যেখানে আপনি এবং অন্য ব্যক্তিরা একই সাথে কথাবার্তা এবং কার্টুন ক্যারেক্টার-এর মাধ্যমে দেখাও করতে পারে। ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির ভাগটি অনেক উন্নত। (যেমন : পাবজি ও ফ্রি ফায়ার গেম)

ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির ব্যবহার

ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটিতে ব্যবহারকারী সম্পূর্ণরূপে একটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিমজ্জিত হয়ে যায়। তথ্য আদান প্রদানকারী বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস সম্বলিত চশমা, হেডসেট (headsets) বা মাথায় বসানো ডিসপ্লে (Head Mounted Display-HMD), গ্লোভস (gloves), পোশাক (suit) ইত্যাদি পরিধান করার মাধ্যমে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটিতে বাস্তবকে উপলব্ধি করা হয়। একটি টিপিক্যাল ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটিতে একজন ব্যবহারকারী ত্রি-মাত্রিক স্ক্রীন সম্বলিত একটি হেলমেট পরে এবং তার মধ্য দিয়ে বাস্তব থেকে অনুকরণকৃত প্রাণবন্ত ছবি দেখে।

কৃত্রিম ত্রিমাত্রিক জগতে উপস্থিত থাকার ভ্রমণ একটি গতি নিয়ন্ত্রণকারী সেন্সর দ্বারা প্রভাবিত করা হয়। গতি নিয়ন্ত্রণকারী সেন্সরের মাধ্যমে স্ক্রীনে প্রদর্শিত ছবির গতিকে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি ব্যবহারকারীর গতির সাথে মেলানো হয়। যখন ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি ব্যবহারকারীর গতির পরিবর্তন হয় তখন স্ক্রীনে প্রদর্শিত দৃশ্যের গতিও পরিবর্তিত হয়। এভাবে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি ব্যবহারকারী কৃত্রিম ত্রি-মাত্রিক জগতের সঙ্গে মিশে যায় এবং সেই জগতের একটি অংশে পরিণত হয়।

ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির প্রয়োগ বা ব্যবহার নিচে তুলে ধরা হলো :

গেম শিল্প ও সিনেমা : বিভিন্ন প্রকার আধুনিক আকর্ষণীয় গেম তৈরিতে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়। যেমন Xbox360, PS5 ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্য ধারণ করতে প্রয়োজনীয় অ্যানিমেশন তৈরি করার সময়ও ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ : শিশু শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা ও প্রকৌশল শিক্ষায় এর ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের অভ্যন্তরীণ সিম্যুলেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অনুধাবন করতে পারে।

চিকিৎসাক্ষেত্রে : চিকিৎসাক্ষেত্রে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি প্রয়োগ করে বিভিন্ন ধরনের ভুল ও ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। যেমন সিম্যুলেটেড সার্জারির মাধ্যমে নতুন ডাক্তার ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব।

সামরিক বাহিনী : সামরিক বাহিনীতে অনেক বছর যাবত প্রশিক্ষণে ফ্লাইট সিমুলেশন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি ব্যবহার করে প্রচলিত ফ্লাইট সিম্যুলেটরের আরো উন্নতি সাধন করা সম্ভব।

ব্যবসা-বাণিজ্য : ব্যবসা-বাণিজ্যে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কোনো যন্ত্র বা পণ্য উৎপাদন শুরু করার আগে তা ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির মাধ্যমে তৈরি করে তার মান ও গুণাগুণ পরীক্ষার জন্যে জনসম্মুখে উপস্থাপন করা যায় এবং এর সুবিধা ও অসুবিধা যাচাই করা যায়।

শিল্প কারখানায় : ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির মাধ্যমে শিল্প কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়ার সিম্যুলেশন করা হয়। এর ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করার পূর্বে তার দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা, ঝুঁকি ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা যায়।

ফ্লাইট সিম্যুলেটর : ফ্লাইট সিম্যুলেটর এমন একটি যন্ত্র বা ডিভাইস যা পাইলট প্রশিক্ষণ, ডিজাইন, গেম ইত্যাদি কাজের উদ্দেশ্যে কৃত্রিমভাবে বিমান বা এয়ারক্রাফট উড্ডয়ন ও অবতরণ এবং এর চলাচল কাল্পনিক পরিবেশ তৈরি করে।

মহাকাশ অভিযান : মহাকাশ অভিযানের প্রতিটি পর্বেই রয়েছে নানা ধরনের ঝুঁকি। প্রস্তুতি পর্বে নানা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নভোচারীদের কার্যক্রম, নবযান পরিচালনা সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রশিক্ষণে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।

প্রাত্যহিক জীবনে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির প্রভাব

এবার ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির কিছু ইতিবাচক প্রভাব :

বাস্তবায়নের পূর্বেই বাস্তবকে অনুভব করা : ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির সাহায্যে অনেক ক্ষেত্রেই কোনো কিছু বাস্তবায়ন করার পূর্বেই কম্পিউটার, মেকানিক্যাল, সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল ইত্যাদি ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার প্রয়োগের ফলে কাল্পনিক মডেল তৈরি করা যায়, যা বাস্তবের অনুরূপ। যেমন-একটি ভবন তৈরি করে ক্রেতাকে দেখানোর পর ক্রেতার চাহিদা অনুসারে তার পরিবর্তন করা কঠিন। কিন্তু ভবন নির্মাণের পূর্বে তার মডেল ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির প্রয়োগের মাধ্যমে তৈরি করে ক্রেতাকে দেখালে ক্রেতা তার পছন্দমত ডিজাইন পরিবর্তন করতে পারেন। ডিজাইন চূড়ান্ত হলে এই মডেল অনুসারে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হতে পারে।

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী করা : শিক্ষাক্ষেত্রে জটিল বিষয়গুলোর সিম্যুলেশন ও মডেলিং করে শিক্ষার্থীদের দেখালে সঠিক শিক্ষার বিস্তার হয়। যেমন-মানুষের হার্ট কীভাবে কাজ করে তা বাস্তবে দেখানো কঠিন, কিন্তু ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির মাধ্যমে তা’ সহজেই দেখানো যেতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ বা জটিল উৎপাদন ব্যবস্থাকে সহজ ও সরল করে শিল্প-কারখানার ঝুঁকিপূর্ণ বা জটিল প্রক্রিয়াকে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির সাহায্যে প্রকৌশল বিদ্যার প্রয়োগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সহজ ও সরল করা সম্ভব।

খরচ কমানো : ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির প্রয়োগের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই খরচ কমানো সম্ভব হয়। বাস্তবায়নের পূর্বেই মডেল তৈরি করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ডিজাইন চূড়ান্ত করা হলে নির্মাণ খরচ তুলনামূলকভাবে কম হবে।

ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির কিছু নেতিবাচক প্রভাব :

মনুষ্যত্বহীনতা : বর্তমান সমাজের মনুষ্যত্বহীনতা বা ডিহিউম্যানাইজেশন (Dehumanization) ইস্যুটি হচ্ছে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির একটি নেতিবাচক দিক। পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে মনুষ্যত্বকে ধরে রাখতে হবে এবং একই সাথে খেয়াল রাখতে হবে যেনো আমরা প্রযুক্তি দ্বারা চালিত না হই। কিন্তু যদি বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে, তাহলে মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। কারণ মানুষ তখন ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি দ্বারা বাস্তব জীবনের চেয়েও অনেক ভালো সঙ্গী এবং মনের মত পরিবেশ পাবে। আর মানুষ যদি এভাবে goggles আর gloves -কে মানুষ ও সমাজের বিকল্প হিসেবে বেছে নেয় তাহলে মানব সমাজ বিলুপ্ত হতে আর বেশি সময় লাগবে না।

কল্পনার রাজ্যে বিচরণ : ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির মাধ্যমে মানুষ তার কল্পনার রাজ্যে ইচ্ছেমতো বিচরণ করতে পারবে। ফলে দেখা যাবে মানুষ বেশিরভাগ সময় কাটাবে কল্পনার জগতে এবং খুব কম সময় থাকবে বাস্তব জগতে। কিন্তু এভাবে যদি মানুষ কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে না পারে তাহলে এই পৃথিবী চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হবে।

স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর : এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যেও হানিকর। এটি মানুষের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির ক্ষতিসাধন করে।

ডিজিটাল ডিভাইড তৈরি : ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটি ব্যয়সাধ্য বিধায় অনেকেই তা’ ব্যবহার করে এর সুবিধা গ্রহণ করতে পারছেন না। যাদের আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে শুধুমাত্র তারাই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারছেন। ফলে এখানে ডিজিটাল ডিভাইড তৈরি হচ্ছে।

তাই যে কোনো প্রযুক্তি গ্রহণে আমাদেরকে বুঝতে হবে আমরা সেটি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবো কি-না। যে কোনো প্রযুক্তি সঠিকভাবে সঠিক স্থানে ব্যবহারে যেমন সফলতা আসবে তেমনি এর অপব্যবহার আমাদের সমাজ ও পরিবেশকে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়