সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫  |   ৩৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ

প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

খুদে মুক্তিযোদ্ধা

ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
খুদে মুক্তিযোদ্ধা

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। দেখবার কথাও নয়। আমার বাবাও মুক্তিযুদ্ধের সময় দুগ্ধপোষ্য শি,শু ছিলেন। তবে আমার দাদার মুখে শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধে অনেক শিশুও অংশ নিয়েছে এবং তাঁরা যথেষ্ঠ বীরত্বও দেখিয়েছে। এরকম একজন আমার দাদার বন্ধুর ছেলে দুলাল। দুলাল জ্যাঠা যখন দরিয়া বেগমের পেটে তখন তিনি স্বপ্নে দেখেন, একটা বাঘ গর্জাতে গর্জাতে ধীর পায়ে হেঁটে এসে তার পেটে ঢুকে শান্ত হয়ে গেল। এই স্বপ্নের কথা পরদিন দুলাল জ্যাঠার মা খুব আনন্দিত মনে আমার দাদীকে বললো। বলার সময় তার মুখে যেন চাঁদের বান জেগেছিল। আমার দাদী আবার মানুষের স্বপ্নের ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারতেন। দাদী বললেন, দরিয়া, তোর পেটে যে আসছে সে কোন সাধারণ কেউ নয় রে। সে হবে বাঘের মতো অসাধারণ সাহসী। দেখিস্, এই ছেলে হবে আমাদের এই হরিণডাঙা গাঁয়ের বাঘ। তখনকার দিনে মায়েরা পেটে ছেলেমেয়ে থাকলে সুন্দর সুন্দর বাচ্চার ছবি ঘরে রাখতো। যাতে সকালে ঘুম থেকে জেগেই তার ছবি দেখে। দুলাল জ্যাঠার মা তার ঘরে শেখ মুজিবের একটা ছবি রেখেছিলো। ঊনিশশো ষাট সালে যখন দুলাল জ্যাঠার জন্ম হয় তখনো শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু উপাধি পাননি। তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে বাঙালিকে শোষণমুক্ত করার স্বপ্ন দেখছিলেন। দুলাল জ্যাঠার মা চেয়েছিলেন তার সন্তান যেন শেখ মুজিবের মতো সাহসী আর মানবতাবাদী হয়। ঠিক ঠিক জন্মের পর থেকে দুলাল জ্যাঠার মধ্যে সেই রকম সাহসের বিস্তার দেখা গেছে। শেখ মুজিবের মতোই মানুষের প্রতি তাঁর টান তৈরি হয়েছে। একবার দুলাল জ্যাঠা তাঁর গায়ের গরম জামাটি খালি গায়ে শীতে কাঁপা তাঁর বয়সী একটা ছেলেকে দিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ নিজে তখন শীতে কাঁপছিলেন। এই হচ্ছেন আমাদের দুলাল জ্যাঠা।

যখন বাঙালির জীবনে মুক্তিযুদ্ধ নেমে আসে তখন দুলাল জ্যাঠার বয়স ছিল মাত্র এগার। দুলাল জ্যাঠার মা যুদ্ধ শুরু হওয়ার বছর খানেক আগেই অজ্ঞাত রোগে মারা যান। সেই থেকে দুলাল জ্যাঠা মাতৃহীন হয়ে পড়ে। দুলাল জ্যাঠার বাবা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পর ঐ পারে চলে যায়। ঐ পার মানে ভারতের আগরতলায়। ওখানেই মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং হয় নাকি। এগার বছরের দুলালকে রেখে গেল তার বুড়ো বাপের কাছে অর্থাৎ দুলালের দাদার কাছে। অভিভাবকহীন দুলাল হয়ে গেল ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো। সারাদিন টই টই করে। কেবল পেটে টান পড়লেই বাড়িতে ঢোকে।

মুক্তিযুদ্ধ যখন ঘোরতর তখন গ্রামে পাকিস্তানী সেনারা আসতে শুরু করে। তারা প্রথম দিনই দুলালদের গ্রামে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তারপর জোয়ান ছেলেদের ধরে ধরে বের করে এনে জড়ো করে একজায়গায়। সবার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। চোখও বেঁধে ফেলা হয়েছে। পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি চিনে না। কিন্তু তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা রাজাকাররা সব চিনিয়ে দিয়েছে। এই রাজাকারদের নেতা হলো মতি। মতিউর রহমান। দাদা বলেছেন, এরা নাকি পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে। এরা পাকিস্তানের দালালী করতেই নিজেদের নিযুক্ত রেখেছে। পাকিস্তানী আর্মির আগুন হতে রেহাই পায়নি দুলালদের খড়ের ঘরটাও। শুধু ঘরবাড়ি জ্বালিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি। তারা কম বয়সী নারীদের টেনে টেনে গাড়িতে তোলা শুরু করলো।

জওয়ান ছেলেদের ধরে নিয়ে পাক সেনারা ক্যাম্পে চালান করে দিলো। আর নারীদের নিয়ে গেলো অন্য কোনখানে। যাওয়ার সময় দুলালকেও তারা সাথে নিয়ে গেল ক্যাম্পে। ক্যাম্পে এসে দুলাল ভয় পেয়ে গেল। সব ধরে আনা যুবকদের এক লাইনে দাঁড় করিয়ে রাতের বেলা মেরে ফেলল পাকসেনারা। কিছু কিছু গুলি খাওয়া দেহকে তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে দেখলো মরে গেছে কি না। দুলাল এই ঘটনা দেখে বমি করে দিলো আতঙ্কে। চোখ বন্ধ করলেই সে দেখতে পায় বীভৎস সেই দৃশ্য।

দুলালের বয়স অতি কম বিধায় ক্যাম্পে দুলালকে তারা ফুট-ফরমাশ খাটানোর জন্যে রেখে দেয়। দুলাল ক্যাম্পে পাকিস্তানী আর্মির চা-টা এগিয়ে দেয়, শার্ট-প্যান্ট ভাঁজ করে দেয়। কখনো কখনো পাকসেনাদের হাত-পা টিপে দেয়। দুলাল তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে খানসেনাদের মন জয় করে। কিন্তু দুলালের মনে শান্তি নেই। তার মূল উদ্দেশ্যই হলো খানসেনাদের কুপোকাত করা। সে তাই তক্কে তক্কে থাকে। তার সেই সুযোগ একদিন তার কাছে ধরা দেয়। সে শুনতে পায়, পাঞ্জাবী সৈন্যরা পরেরদিন মুক্তিবাহিনীর মূল ঘাঁটি আক্রমণ করবে। দুলাল তার আগের সন্ধ্যায় হঠাৎ ক্যাম্প হতে উধাও হয়ে যায়। তারপর আধঘন্টা পার করে সে ক্যাম্পে ফিরে আসে। সে যখন ক্যাম্পে ঢোকে তখন সেনারা সবাই মাতাল হয়ে বসে আছে। দুলাল সুযোগ বুঝেই ঢুকে যায় ক্যাম্পের কক্ষে। এসময় তার প্যান্টের পকেট দুটো ফুলো ফুলো মনে হয় আধো আঁধারে। রাতের দিকে দশটা নাগাদ সেনাদের শার্ট-প্যান্ট ভাঁজ করার ডাক পড়ে দুলালের। দুলাল শার্ট-প্যান্ট ভাঁজ করতে গিয়ে সন্তর্পণে দু'পকেটে করে নিয়ে আসা বিছুটি পাতার গুঁড়ো মিশিয়ে দেয়। এভাবে সবকটা শার্ট-প্যান্ট সে বিছুটি পাতার গুঁড়ো মিশিয়ে ভাঁজ করে ফেলে। সুন্দর করে ইস্তিরি করার মতো ভাঁজ করার কারণে কারও বোঝার উপায় নেই যে এই শার্টগুলোতে বিছুটি পাতার গুঁড়ো মেশানো আছে।

হরিণডাঙা গাঁয়ে যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের মূলঘাঁটি সেখানে আজ একটা চাপা উত্তেজনা। তারা দুলালের কাছে খবর পেয়েছে, আজ রাতে এই ঘাঁটি আক্রমণ করবে পাকসেনারা। সবাই দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। যে করেই হোক, একটা খান সেনাকেও আজ জ্যান্ত ফিরতে দেয়া যাবে না। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের কমাণ্ডার হলো আজাদ। আজাদের সাথে সন্ধ্যায় দেখা হয়েছে দুলালের। দুলাল খুব সাহসী ছেলে। সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এই খবর জানিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় জঙ্গল থেকে দুই পকেট ভর্তি বিচুটি পাতা গুঁড়ো করে নিয়ে গেছে দুলাল। দুলালকে বিছুটি পাতার গুঁড়ো নিতে দেখে কমাণ্ডার আজাদ মনে মনে হেসে ওঠে নিজের শৈশব মনে পড়ায়। আজাদ তাড়াতাড়ি ঘাঁটিতে গিয়ে সহযোদ্ধাদের নিয়ে ছক সাজাতে থাকে আক্রমণ মোকাবেলার।

রাত দুটো বাজলো। পাক সেনারা অভিযানের অ্যাকশনের জন্যে তৈরি হতে শুরু করে। কয়েকজন পাকসেনা আর রাজাকার মিলে ক্যাম্প পাহারা দেওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকে। দুলাল জানে একটু পরেই শুরু হবে আসল খেলা। সে তাই দেরি না করে সটকে পড়ল অলক্ষ্যে ক্যাম্প হতে। উত্তেজনায় পাক সেনারা প্রথমে কিছুই টের পেলো না। যতই মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির দিকে আসতে থাকলো ততই একজন একজন করে সবার পিঠ,বুক, পেট, হাতের সব জায়গায় চুলকানি শুরু হয়ে গেলো। তিন গাড়ি ভর্তি পাকসেনাদের সবাই শরীর চুলকানিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। উর্দুতে মাঝে মাঝে গাল আর খিস্তি-খেউর করতে শুরু করে সেনারা। তারা সবাই বুঝে গেছে, এটা দুলালের কাজ। প্যান্ট-শার্টে বিছুটি পাতার গুঁড়ো মিশিয়ে দিয়েছে সে। রাজাকারের বাচ্চাটা বাংলায় গালি দিতো দুলালের উদ্দেশ্যে। কিন্তু দুলাল হাতের কাছে নেই। ওয়াকি টকিতে হানাদার মেজর উর্দুতে ক্যাম্পে থাকা পাকসেনাদের বললো, ও হারামি হ্যায় না উসকো নাম ক্যায়া? দুলাল,দুলাল। ইয়াদ আয়্যা, ইয়াদ আয়্যা। উসকো গোলি মার দো। ও আদমী শেখ মুজিবকা বাচ্চা আছে। খান সেনারা যখন বুঝলো আজ আর তারা বন্দুক ধরার অবস্থায় নেই তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারা বন্দুক ফেলে গা-হাত চুলকাচ্ছে দলবেঁধে। আর এইদিকে গাছের ঝোপের আড়ালে আগে থেকে ওঁৎপেতে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা অবাক হলো কিছুটা। খানসেনাদের দলবেঁধে শরীর চুলকাতে দেখে। কিন্তু তারপরই তাদের বন্দুকগুলো গর্জে উঠল একসাথে, ঠা ঠা ঠা, ঠাঠাঠা, ঠা ঠা ঠা...। প্রায় একঘন্টা পর যুদ্ধ থেমে গেল। সবকটা খানসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়।

পরদিন সকালে পুরো গ্রাম ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার তার দল নিয়ে হানাদারদের ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। তার দুটি কাতর চোখ কেবল ইতিউতি ঘুরছে। কাউকে বললো না আজাদ, সে কী খুঁজছে। খুঁজতে খুঁজতে সে দেখল, ক্যাম্প থেকে একটু দূরে ধানক্ষেতে ছোট্ট একটা দেহ নিথর হয়ে পড়ে আছে। স্রোতের মতো ঝরে পড়া রক্ত কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে দেহটার পাশে। মাছি বসতে শুরু করেছে লাশে। উপুড় হওয়া দেহের মুখখানা উল্টে দেখেই কেঁদে দেয় কমাণ্ডার আজাদ। গতকাল সন্ধ্যায়ও সেই মুখটা প্রাণবন্ত ছিলো। তার দেওয়া অব্যর্থ সংবাদেই মূল ঘাঁটির মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ছিলো হানাদার রুখে দেওয়ার। অথচ আজ এই সকালে দুলাল গুলিতে লাশ হয়ে শক্ত হয়ে গেছে। আজাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ খুলে স্যালুট জানায় শিশু মুক্তিযোদ্ধা দুলালকে। আজাদের আর বুঝতে বাকি রইল না, কেন গতরাতে খানসেনাদের বন্দুক চালানোর পরিবর্তে গা-হাত চুলকাতে দেখা গেছে। আজাদ যাকে শিশুর খেলা ভেবেছিল গত সন্ধ্যায় সেটা ছিল দুলালের চাল। একটা বড় জীবনবাজি রাখা চাল। বন্দুক নয় মেধা আর বিছুটি পাতার গুঁড়ো দিয়েই খান সেনা কুপোকাত করলো শিশু মুক্তিযোদ্ধা দুলাল। আজাদ ও তার দল দুলালের ছোট্ট নিথর দেহটাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে থাকে হরিণডাঙা গাঁয়ের রাস্তায়। দুলালের মৃতদেহকে দূর হতে একটা বাঘের দেহের মতোই মনে হয়।"

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়