বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৬

রোবট এবং কোবট

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার
রোবট এবং কোবট

প্রযুক্তির যুগে রোবটের বহুমুখী ব্যবহার সকলের জানা। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকহারে রোবটের ব্যবহার হচ্ছে। এতে অনেকাংশে কমছে বিপজ্জনক কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের হতাহত বা প্রাণহানির ঝুঁকি। ডাক্তার, নার্স বা রোগীদের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিস, ওষুধ দ্রুত পৌঁছাতে স্বাস্থ্য খাতে রোবটের ব্যবহার হচ্ছে। শরীরের কোনো অঙ্গহানিতে ব্যবহার হচ্ছে রোবটিক হাত-পায়ের মতো অঙ্গ। হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অটোনমাস মোবাইল রোবট কাজে লাগছে কোনো কোনো জায়গায়।

বিভিন্ন প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম খনি আছে, যেগুলো বিষাক্ত, দুর্গম ও মানুষের কাজের জন্য বিপজ্জনক, সেসব ক্ষেত্রে মানুষের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে রোবট। বোমা চিহ্নিতকরণ, মাইন অপসারণ ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবট, ড্রোন, চালকহীন রোবট বিমানসহ রোবটিক্সের অত্যাধুনিক কিছু আবিষ্কার কাজ করছে যুদ্ধ ও সামরিকক্ষেত্রেও। সেই দিন হয়তো দূরে নেই, যখন রোবট সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়বে মানুষের হয়ে। মঙ্গল গ্রহে পাঠানো মার্স রোভার থেকে নাসার রোবোনট, পৃথিবীর গন্ডি পেরিয়ে মহাকাশেও বিচরণ করছে অত্যাধুনিক রোবটেরা। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য রোবট শিক্ষক ব্যবহার শুরু হয়েছে। যাদের বলা হচ্ছে ‘টেলি-প্রেজেন্স’ রোবট। প্রাত্যহিক জীবনেও রোবটের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে- বীজ বপন, আগাছা পরিষ্কার, মাটি বিশ্লেষণ, ফসল সংগ্রহসহ কৃষিক্ষেত্রে। রোবটিক সুইপার, রোবটিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, পুল ক্লিনারসহ বিভিন্ন ঘরোয়া রোবট ব্যবহার করছে বিশ্বজুড়ে প্রচুর মানুষ। অনেক হোটেল, রেস্টুরেন্টেও খাবার আনা-নেওয়া ও পরিবেশনার কাজ করছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোবট।

মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ ও সুবিধাজনক করতে রোবট নিরলসভাবে কাজ করলেও রয়েছে নানান অসুবিধাও। যেমন- রোবট ও এই সম্পর্কিত সব যন্ত্রপাতির দাম এখনো অনেক মানুষের হাতের নাগালে আসেনি। তাই রোবট ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ যথেষ্ট ব্যয়বহুল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা না থাকার কারণে বেশিরভাগ রোবটেরই নেই কোনো সৃজনশীলতা।

তাই এগুলো ভুল করলেও বুঝতে পারে না। নানান ক্ষেত্রে রোবট ব্যবহারের ফলে বিশ্বজুড়ে প্রচুর মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। মানুষের মতো সব রোবট পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না, যদি না তার প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা হয়। রোবটনির্ভর শিল্পকারখানায় রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, দক্ষ টিম ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এসব সমস্যা থেকে কিছুটা রেহাই দিতে বিশ্ববাজারে এখন এসেছে কোবট। কোবট হলো এমন ধরনের রোবট, যেগুলো প্রচলিত রোবটের তুলনায় অনেক দক্ষভাবে মানুষের সঙ্গে কাজ করতে পারে।

কারখানায় সচরাচর ব্যবহৃত ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটের তুলনায় কোবট অনেকাংশেই আলাদা। ‘কোলাবরেশন’ ও ‘রোবট’ শব্দ দুটি মিলিয়ে ‘কোবট’ শব্দটি এসেছে। কোবট এমন ধরনের রোবট, যারা কোনো ধরনের জটিলতা ছাড়াই মানুষের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে পারে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট সাধারণত অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এসব রোবট মানুষের সঙ্গে কাজ করা বা মানুষের কাজে সাহায্য করার জন্য অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বেশিরভাগ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট সেকেন্ডে ৮ মিটারের বেশি গতিতে নড়াচড়া করতে পারে এবং ১০০০ কেজি পর্যন্ত ওজন নিয়ে কাজ করতে পারে। এসব রোবট কাজ করার সময় আশপাশে মানুষ থাকলে তাদের আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে।

পক্ষান্তরে, কোবট আকারে বেশ ছোট হয়। সাধারণত ১৬ কেজির চেয়ে কম এবং এর গতি থাকে সেকেন্ডে ৪ মিটারের মধ্যে। মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুবিধার্থে প্রয়োজনে এর গতি আরও কমানো হয়। মূলত কোবটের গতিসীমা কত হতে পারে, সে ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের রোবটের সেফটি রেগুলেশনে নির্দেশনা দেওয়া থাকে। এছাড়া স্পর্শ বা সংঘর্ষ এড়াতে কোবটে বিশেষ ধরনের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকে। যেমন- কোবটের কিছু মডেল ইলেক্ট্রিক মোটরের মতো গিয়ারের সাহায্যে মনিটর করা হয়।

আবার কিছু কোবটে ‘ইন্টার্নাল ফোর্স টর্ক সেন্সর’ ইনস্টল করা থাকে। কোবট ব্যবহার করার আগে এর নিরাপত্তা সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম দুটি হলো, বায়োমেট্রিক মেজারমেন্ট এবং কোবটের কাজের ধরন অনুযায়ী অ্যাপ্লিকেশন টেস্ট। টেস্ট করে দেখা হয় কোবটের সর্বোচ্চ গতি কত হতে পারে এবং এতে আর কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে কি না। যদি কোবটের গতি বা কার্যক্ষমতা বেশি হয়, তখন সেটা মানুষের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই বিপদ এড়ানোর অন্যতম একটা উপায় হলো গতি কমানো। আরেকটা উপায় হচ্ছে ‘এয়ারস্কিন’ নামের একধরনের সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম ব্যবহার করা। মূলত এয়ারস্কিন হলো প্যাডযুক্ত একধরনের সেন্সর কাভার, যার ওপর বল প্রয়োগ করা হলে তা সবদিকে সমানভাবে ছড়িয়ে যায়। এছাড়াও এয়ারস্কিনের মাধ্যমে জরুরি মুহূর্তে খুব দ্রুত কোবটের কার্যক্রম বন্ধ করে ফেলা যায়। আবার মানুষের মতো কোবট ব্যবহারের সময়ও এর সুরক্ষা নিশ্চিত করেই কাজে নিযুক্ত করতে হয়। সাধারণত কোবটে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি সংযুক্ত থাকে, যেমন - ক্যাবল ক্যারিয়ার, ক্যামেরা এবং গ্রিপার। তবে কোবট দিয়ে যখন ধারালো ছুরি বা গ্লাসের মতো বিপজ্জনক যন্ত্রপাতি আনা-নেওয়া করা হয়, তখন যেন ঝুঁকি ছাড়াই সম্পূর্ণ কাজ করতে পারে, সেদিকে আলাদা খেয়াল রাখতে হয়।

সাধারণত সিকিউরিটি স্ক্যানারের মাধ্যমে কোবট তার চারপাশের পরিবেশের ব্যাপারে জানতে পারে। কোনো মানুষ কোবটের খুব কাছে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে এর গতি কমে যায়। এরপরে যদি বিপজ্জনকভাবে আরও কাছে চলে আসে, তাহলে কোবট একেবারেই থেমে যায়। অনেক সময় সুরক্ষার জন্য কোবটের কাজের জায়গা বা ওয়ার্কস্পেসের মেঝেতে সীমানা দেওয়া থাকে। এই সীমানা অতিক্রম করলে কোবটের গতি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কমে আসে। আরেকটি উপায়েও কোবট মানুষের উপস্থিতি বুঝতে পারে, সেটা হলো এয়ারস্কিন। এয়ারস্কিনের সুবিধা হলো, কোবটের সঙ্গে এটি যুক্ত থাকলে কোবটকে স্পর্শ করা মাত্রই এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তাই ভুল করে কেউ কোবটের নির্ধারিত সীমানার মধ্যে প্রবেশ করলেও আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। মোটরগাড়ি শিল্পে অনেক বেশি পরিমাণে কোবট ব্যবহার করা হয়।

তাছাড়া অনেক ছোট ও মাঝারি সাইজের প্রতিষ্ঠানও আজকাল কর্মীদের সহায়তার জন্য কোবট ব্যবহার করছে। যেমন, একটি কারখানায় তরল অ্যালুুমিনিয়াম ধাতু ঢালাই করার জন্য কোবট এবং লেজার সেফটি স্ক্যানার ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন মালামাল গুদামজাত করা বা ক্ষুদ্র কোনো জিনিস ঝালাই করার মতো কাজও কোবটের সাহায্যে করা হয়। এছাড়াও আঠা দিয়ে কিছু যুক্ত করা, টোস্টে জ্যাম লাগানো বা ডিম ভাজার মতো দৈনন্দিন অনেক ধরনের কাজ করতেও কোবট ব্যবহার করা হয়।

বর্তমানে মোবাইল প্রযুক্তি, মেশিন ভিশন, জ্ঞানীয় কম্পিউটিং এবং স্পর্শ প্রযুক্তির অগ্রগতি সাপেক্ষে বড় বড়, ছোট ও নিম্ন-শক্তি তথা কোবট আকারে কর্মের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মানবকর্মী উপযোগী হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। এককথায় রোবট যেখানে অত্যন্ত ব্যয়বহুল, আকার অনেক বড় ও ভারি এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে জর্জরিত, সেখানে কোবটগুলো এই ভয়কে মোকাবিলা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে কোবট একটি বাহুর আকার ধারণ করে কর্মীকে একটি অতিরিক্ত হাত হিসেবে সাহায্য করে। কোবট রোবটেরই একটি পরিমার্জিত মানব উপযোগী যন্ত্র এবং এর ব্যবহার ক্রমে বেড়ে চলেছে, তাই দেশে এর নির্মাণ উপযোগী ইন্ডাস্ট্রি থাকা উচিত। সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে অনেক কোমলমতি শিক্ষার্থীকে রোবট ও কোবট বানাতে আগ্রহী দেখা যাচ্ছে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের বিজ্ঞানমেলায় তাদেরকে দেখা যায়। প্রায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন রোবটিক্স ল্যাবরেটরি আছে। স্কুল পর্যায়েও এই চর্চা ছড়িয়ে দিতে পারলে এবং সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজনের পাশাপাশি, রোবটিক্সের যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করা গেলে কিংবা এসব তৈরির কাঁচামাল দেশে তৈরি করতে পারলে দেশের তরুণ প্রজন্ম স্বাবলম্বী হতে পারবে এবং এগুলো রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়