প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৪
প্রকৃতির গহীনে কমলগঞ্জের হাম হাম ঝর্ণা

ঝর্ণা হলো প্রকৃতির একটি অনন্য সৃষ্টি, যেখানে পাহাড়ের উচ্চতা থেকে পানি নিচে পড়ে একটি সুন্দর দৃশ্য তৈরি করে। এর স্বচ্ছ পানি, স্ফটিকের মতো ঝলমলে স্রোত এবং চারপাশের প্রশান্তি মনকে এক গভীর প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলে। ঝর্ণার শব্দ এবং পরিবেশ মানুষের মনে শান্তির সঞ্চার করে, যেন প্রকৃতির এক অমূল্য রত্ন। এটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, বরং জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা মানুষের দেহ ও মনকে সতেজ করে তোলে। তেমনই এক ঝর্ণার গল্প তুলে ধরেছি আজ ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য।
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার একটি উপজেলা কমলগঞ্জ। বর্তমানে এ উপজেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে হাম হাম ঝর্ণা বা জলপ্রপাত। এটিকে অনেকে চিতা ঝর্ণা নামেও চিনেন। তবে এর উচ্চতা নিয়ে মতভেদ আছে। স্থানীয়দের দাবী- এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ উঁচু জলপ্রপাত। যেখানে দেশের সবচেয়ে উঁচু মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের উচ্চতা ১৬২ ফুট। প্রকৃতির অপরূপ রোমাঞ্চকর নয়নাভিরাম হাম হাম জলপ্রপাত একনজর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠছে দিনে দিনে। ২০১০ সালে আবিষ্কৃত ১৩৫ থেকে ১৬০ ফুট উঁচু এই ঝর্ণা দেখে ঘুরে আসা যায় মাত্র একদিনেই। দুই থেকে আড়াই ঘন্টা উঁচু-নিচু পাহাড়, পিচ্ছিল পথ এবং সংকীর্ণ পথের দুই ধারে ভয়ংকর খাদের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে পর্বতচূড়ায় উঠলেই দূর থেকে দেখা মিলবে ভারতের পাহাড়গুলো। ঘন সবুজ বন, বাঁশবন, বুনো ফুল এবং রঙ্গিন প্রজাতি দ্বারা আকর্ষণীয় এ পাহাড় থেকে খাড়া ও পিচ্ছিল ঢাল বেয়ে নেমে মিলবে গিরিপথ। সেই পুরোনো পাথর আর শীতল জলের গিরিপথ যা হামহাম ঝরনা থেকে বয়ে এসেছে। কত শত বছর ধরে যে সে এমন করে বয়ে চলেছে তা হয়তো কোথাও লেখা নাই। এই পাথরগুলোর হৃদয় হয়তো জানে এর উৎপত্তির কথা। এগুলো হয়তো ভূতাত্বিকভাবে প্লাইস্টোসিন কালের পাথর হবে। কিন্তু সেটা বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়; অভিযাত্রিকের আলোচনার বিষয় নয়। ১৫-২০ মিনিট সামনে এগোতেই ভুলে যেতে হবে সদ্য দুই আড়াইঘন্টা আগের কষ্টের কথা। কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় লুকিয়ে থাকা কাঙ্ক্ষিত প্রাকৃতিক জলপ্রপাতের দেখা পেয়ে। টলমলে স্বচ্ছ পানির ধারা গড়িয়ে পড়ছে শক্ত পাথরের মত পাহাড়ের শরীর লেপ্টে। এনে দেয় এক প্রশান্তির ছোঁয়া।
প্রকৃতির এই অপার রোমাঞ্চকর সৌন্দর্য একনজর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটকদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠছে এই হাম হাম ঝর্ণা। এই ঝর্ণায় পৌঁছতে হলে আপনাকে পাড়ি দিতে হবে দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গলের পিচ্ছিল ঝিরিপথ ও পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তা। প্রকৃতির এই দৃষ্টিময় সৌন্দর্য দেখতে হলে আপনাকে অবশ্যই সুস্থ ও সবল স্বাস্থ্যের মানুষ হতে হবে। কারন, প্রায় দুই আড়াই ঘন্টা উঁচু-নিচু পাহাড় বেয়ে অনেকটাই ক্লান্ত হয়ে যেতে পারেন। গভীর জঙ্গলময় এই পাহাড়ের ভিতরে গেলে মোবাইলের সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে উদ্ধার করাও কঠিন হয়ে পড়বে যে কারো। এমনকি সময়ের প্রতি সঠিক লক্ষ্য থাকতে হবে যেন সন্ধার মধ্যে এই পাহাড় থেকে বেরিয়ে পড়তে পারেন। নতুবা অন্ধকার নেমে পড়লে পাহাড়ের রাস্তা হারিয়ে যেতে হবে কিংবা হাটতে গিয়ে একটু ব্যতিক্রম হয়ে গেলে পাহাড়ের নিচে পড়ে যেতে হবে। দুঃসাহসিক এ যাত্রায় প্রয়োজনে উক্ত এলাকা থেকে ২/৩ শ টাকায় একজন গাইড নিয়ে নিলে, গাইড সঠিক পথে দ্রুত নিয়ে আস্তে পারবে। তবে এক্ষেত্রে ভ্রমণসঙ্গী বেশি হলে ভালো হয়।
কিভাবে যাবেনঃ সড়ক ও রেলপথে দেশের যেকোন স্থান থেকে শ্রীমঙ্গল শহরে আসা যায়। সেখান থেকে সিএনজি বা জীপ নিয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান হয়ে চা বাগানের গাঁ ঘেঁষে আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে প্রায় ঘণ্টা খানেক গেলেই আপনি পৌঁছে যাবেন কলাবনপাড়া। সেখান থেকে পায়ে হেটে যেতে হবে ঝর্ণায়। এছাড়াও কমলগঞ্জ পৌরসভার মোড় থেকে কলাবন পর্যন্ত দূর ২৪ কিলোমিটার। এই ২৪ কিলোমিটারের মধ্যে কুরমা বনবিট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার পাকা রাস্তা এবং বাকিটা পথ কাঁচা। কলাবনপাড়া থেকে হামহাম ঝর্ণায় যেতে- আসতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ ঘন্টার মতো। রাস্তা খারাপ হলে একটু বেশীও লাগতে পারে। তাই শ্রীমঙ্গল শহর থেকে সকাল ৭টার মধ্যে রওয়ানা হওয়াই ভাল। পরে অন্য কিছু স্থানেও ঘুরে আসতে পারবেন। ভাড়া- শ্রীমঙ্গল শহর থেকে সর্বোচ্চ ২৫০০ টাকার মধ্যে সারাদিনের জন্য জীপ ভাড়ায় পাওয়া যায়। তবে হাম হাম ঝর্ণায় গেলে আরো ৫০০ টাকা বেশি লাগতে পারে।
টিপস ও সতর্কতাঃ হাম হাম ঝর্ণা দেখতে যেতে হলে আপনাকে ট্রেকিং এর জন্যে ভালো গ্রুপের জুতো ব্যবহার করবেন, বিশেষ করে বর্ষাকালে গেলে।ব্যাকপ্যাক যত সম্ভব হালকা রাখবেন। সেই সাথে হালকা জামাকাপড় পরিধান করবেন। সাথে পানি রাখবেন, প্রয়োজনে সাথে করে স্যালাইন নিয়ে যাবেন। কারন, উঠতে নামতে পর্যাপ্ত পানির পিপাসা লাগবে। এমনকি শরীর থেকে ঘাম বের হবে। পাহাড়ি উঁচু নিচু পথ, চলার সময় সাবধান থাকবেন। উঠার আগে ১০ টাকায় বাঁশের লাঠি নিয়ে নিবেন অবশ্যই। পাহাড় থেকে বেরিয়ে এলেই স্থানীয় কয়েকটি বাড়িতে ৩০ টাকার বিনিময়ে প্রাণ খুলে গোসল করে নিতে পারবেন। পাহাড়ে রওনা দেয়ার আগে শহর থেকে অবশ্যই খাবার খেয়ে নিবেন। এতে শরীরের শক্তি যোগাতে সাহায্য করবে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে- স্থানীয় মানুষদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করার কোন বিকল্প নেই। হাম হাম ঝর্ণায় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে গেলে ভালো হয়। ঝর্ণার ধারা কম হলেও পাহাড় পদযাত্রায় সুবিধা হবে। বর্ষাকালে গেলে পাহাড়ের ভয়ংকর পথগুলো পিচ্ছিল থাকে এবং পাহাড়ি ঝোঁকের কবলে পড়তে হবে নিশ্চিত। এছাড়াও গরমে ক্লান্ত হয়ে পরার আশংকা থাকে বেশি।আশপাশে ঘুরে দেখার অন্যান্য স্থানঃ দৃষ্টিনন্দন অসংখ্য চা বাগান, মাধবপুর লেক, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, সাত রঙ্গের চা- নীলকন্ঠ টি কেবিন, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, ললিতকলা একাডেমি, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ, শমরেশনগর গলফ মাঠ, ক্যামেলিয়া লেক, মনিপুরী কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম। হাম হাম ঝর্ণায় গিয়ে যেকোন প্রয়োজনে কমলগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের দেয়া নিন্মোক্ত নম্বরে যোগাযোগ করে সহযোগিতা নিতে পারেন। উপজেলা প্রশাসন: ০১৭৩০-৩৩১০৭৩, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: ০১৭৩০-৩২৪৭৩৬, কমলগঞ্জ থানা: ০১৩২০-১১৯৮৩২, অ্যাম্বুলেন্স সেবা: ০১৮১৯-৮০৭৯৫৩, ট্যুরিস্ট পুলিশ: ০১৩২০-১৫৮৪৪৭ ও ফায়ার সার্ভিস: ০১৯০১-০২৩৬৬৬।








