সোমবার, ০৪ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৪৬

কুমিল্লার ইতিহাস

আহমেদ উল্লাহ ভূঁইয়া
কুমিল্লার ইতিহাস

ভূ-অবস্থানগত কারণে বর্তমান কুমিল্লা জেলার ইতিহাস পৃথিবীর অবলুপ্ত ২৭টি সভ্যতার ইতিহাসের সাথে সমভাবে গর্বের সাথে উচ্চারিত। জেলা হিসেবে কুমিল্লার নামকরণ করা হয় ১৯৬০ সালে। এ জেলার এর আগের নাম ছিলো ত্রিপুরা। তারও আগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০০ সাল হতে এ এলাকা ‘সমতট’ নামে খ্যাত ছিলো। আজকের বৃহত্তর নোয়াখালী বা তারও আগের ভুলুয়া ছিলো এ সমতটেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমতট সভ্যতা আজকের ইরাক ও সিরিয়ার ইউল্লেতিস ও টাইগ্রিস নদীদ্বয়ের তীরভূমিতে প্রতিষ্ঠিত এবং বিকশিত ব্যবিলনীয় সভ্যতার সমসাময়িক বিকশিত সভ্যতা। এ সমতট সভ্যতা পত্তনের অন্তত ২০০ বছর পর সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ ঘটে। বলে রাখা ভালো, আজ হতে ৪২ হাজার বছর আগে মানুষ নৌকা তৈরির কৌশল শেখে এবং এক ভূখণ্ড হতে অপর ভূখণ্ডে যাওয়া আসা শুরু করে। আজ হতে ১৫ হাজার বছর আগে এশিয়ার মানুষ নৌকাযোগে উত্তর আমেরিকায় গমন করে। তাছাড়া এ সমতটে কৌশলী মানুষের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায় আজকের ফেনী জেলার ছাগলনাইয়ায় প্রাপ্ত ‘বর্শা’ আবিষ্কারের মাধ্যমে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের ভাষ্যমতে, এ বর্শার বয়স ৩৫ হাজার বছর। তাছাড়া কুমিল্লা জেলার লাল মাটির রংই বলে দেয় এটি একটি অতি প্রাচীন জনপদ।

বহিরাগত জনকওমের নৌকা/কাঠ নির্মিত জাহাজ সমতটের যে বন্দরে প্রথমেই নোঙ্গর করতো, তা-ই আজকের চঁাদপুর। তাই চঁাদপুরকে বলা হতো সমতটের প্রবেশ দ্বার। পরবর্তীতে চঁাদপুর ও লালমাই হয়ে বিদেশী সওদাগরদের নৌকা/জাহাজ চলে যেতো মালাক্কা হয়ে চীনের বন্দর সমূহে। সুমেরীয়, ব্যবিলনীয়, মিশরীয়, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর সভ্যতার উৎস মেসোপটেমিয়ায় আজ হতে ১০ হাজার বছর আগে কাদা মাটি দিয়ে ইট তৈরির কৌশল এদেশের মানুষ জানতে পারে মধ্যপ্রাচ্য হতে এদেশে সওদাগর এবং বসতি স্থাপনকারীদের কাছ থেকে। বলে রাখা ভালো, ১৫৯৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে তুর্কি হিত্তিতিরা ব্যবিলনীয় সভ্যতা ধ্বংস করলে ওখানকার পরাজিত জনকওমের বিরাট একটি দল জলপথে এ সমতট অঞ্চলে চলে আসে এবং বসতি স্থাপন করে। তখন এ অঞ্চলের মানুষকে বলা হতো দ্রাবিড়। আর এ দ্রাবিড় শব্দ দ্বারই-আবীর শব্দ হতে উৎসারিত বলে অনেক পণ্ডিতেরা মনে করেন। এদের উৎস ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চল, পশ্চিম ইরান, কেনান তথা আজকের ফিলিস্তিন ও আফ্রিকা মহাদেশ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের কিছু আগ থেকে আফ্রিকীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান খরার কারণে জীবন-জীবিকা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই তাদের বেশিরভাগ মানুষই এশিয়ামুখী হয়ে পড়ে। ভারতবর্ষের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ছিলো এ কৃষ্ণাঙ্গরা। এরা প্রথমে উত্তর ভারতে বসতি স্থাপন করে। খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতাব্দিতে আযর্যখ্যাত সিরীয়, ইরাকী, ফিলিস্তিনি আগ্রাসী মহাজেরগণ উত্তর ভারত দখল করে বসতি স্থাপন করে। এদের হত্যাযজ্ঞ হতে পরাজিত দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা বেঁচে যায়, তাদের একটি অংশ পাহাড়ি অঞ্চলে সরে পড়ে। আর বাকিরা ক্রমশ দক্ষিণে চলে আসে। ভারতের সে আদি জনকওম সৈনিকেরা ভারতে আজ অচ্যুৎ অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচিত। শিক্ষা গ্রহণের অধিকার হতেও বঞ্চিত।

বিজয়ী বহিরাগতগণ নিজদের ঈশ্বরের মুখ নিঃসৃত ব্রাহ্মণ হিসেবে ঘোষণা করে। আর তাদের এদেশীয় সহযোগী শক্তি আমাদের ১৯৭১-এর পরিভাষায় রাজাকার শ্রেণী বনে ক্ষত্রীয়, ব্যবসায়ী শ্রেণী, যারা ব্রাহ্মণ দক্ষিণায় কার্পণ্য করতো না, তারা বিবেচিত বৈশ্য আর উৎপাদনের সাথে জড়িত কৃষক শূদ্র শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়। শুধুমাত্র কূটকৌশলে ১৩০ কোটি লোকের দেশ ভারত মাত্র ২৫/৩০ লক্ষ কথিত ঈশ্বর প্রতিনিধি ব্রাহ্মণ শ্রেণী দ্বারা শাসিত। ভারতের মোট সম্পদের শতকরা ৬৯ ভাগ এদের নিয়ন্ত্রণে। ভারতের কোনো প্রচার মাধ্যমের মালিকানা নিম্ন শ্রেণীর হাতে নেই। বড়ো বড়ো শিল্প প্রতিষ্ঠান এদের হাতে। টাটা, বিড়লা, সাহারা, বিয়াংকা, হিন্দুস্থান মটরসের মতো প্রতিষ্ঠানের মালিক এরাই।

ভারতের আদি অধিবাসী কৃষ্ণ বর্ণের আফ্রিকী জনকওমের, যারা আজও জীবিত আছে, তাদের বাস তামিলনাড়ু এবং শ্রীলংকায়। গুজরাট, রাজস্থান, উত্তর ও মধ্য প্রদেশে এদের দেখা মেলা ভার। জাত পাতের বিভাজনের কূটকৌশলে মধ্যপ্রাচ্য হতে বিতাড়িত আগ্রাসীরাই গোটা ভারত বর্ষে ছড়ি ঘুরিয়ে ফিরছে। এরা নিজদের আযর্য তথা সভ্য বলে দাবি করে। এমনকি বাংলা ভাষার উৎস নাকি সংস্কৃত তথা দেবতাদের মুখ নিঃসৃত বাণী। এসবই মিথ্যাচার। ভারতে একটি পরিবারও নেই, যাদের ভাষা সংস্কৃত। কৃষ্টি-কালচারের সাথে, সভ্যতার সাথে এদের দূরতম সম্পর্কও ছিলো না। তাইতো এ উপমহাদেশে তথা কথিত আর্য আগমনের বহু আগ থেকে এ দেশে বসবাসকারী এদেশের প্রকৃত মালিক দ্রাবিড়দের প্রসঙ্গে ভারতের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অশ্বিনী কুমার মজুমদার তঁার ‘আরলি হিন্দু ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বলেন, “আধুনিক পশ্চিমের ধ্বনিতত্ব বিশারদের মতে, দ্রাবিড়দের উচ্চারিত ভাষার সাথে সংস্কৃত বা উত্তর ভারতের কোনো ভাষার মিলই নেই। দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী মধ্যপ্রাচ্য এবং মিশরীয় সভ্যতার আলো নিয়েই ভারতের দক্ষিণাংশে বসতি স্থাপন করে। এরা ব্যবিলনীয় সভ্যতার আলোকে নিজদের উদ্ভাসিত করে। পশ্চিম হতে আগত সুসভ্য মানসিকতার আলোতেই তারা আলোকিত ছিলো। আর দ্রাবিড় সভ্যতা বিকশিত ছিলো ভারতে আর্য আগমনের বহু হাজার বছর পূর্ব হতে। আর্যরা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে যখন মাত্র পাঞ্জাব পর্যন্ত পেঁৗছেছিলো, তার বহু আগ থেকেই বেঙ্গল ছিলো সম্পদে, প্রযুক্তিবিদ্যায় এবং শিল্প সংস্কৃতিতে সভ্যতার সুউচ্চ সোপানে। আযর্যগণ ছিলো সুসভ্য দ্রাবিড়দের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ। তাই তারা অপরাজেয় দ্রাবিড়দের, অধার্মিক, অসুর, স্নেত, দৈত্য ইত্যাদি নামে ডাকতো। খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দে উত্তর ভারতের রাজা মান্ধাতা প্রায় দশ লক্ষ সৈন্য নিয়ে হস্তিনাপুর তথা আজকের যশোহর সীমান্ত দিয়ে বঙ্গদেশ আক্রমণ করলে তিনি সসৈন্যে নিহত হন। শ্রীকৃষ্ণের সময়ে পান্ডুর রাজ বঙ্গদেশ আক্রমণ করে একই ভাগ্য বরণ করেন।”

তাইতো তাদের প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে বাঙালি জাতিকে ঘৃণা করে। দস্যু, ডাকাত, অসুর ইত্যাদি গালি দেয়। অবশ্য এছাড়া এদের করার কীই বা ছিলো। সমতটের শাসনকর্তারা বহু হাজার বছর এসব অপশক্তি আযর্য এবং ত্রিপুরার রাজাদের সাথে লড়তে হয়েছে। প্রতিবারই হেরে গেছে আক্রমণকারীরা। সাধে কি আর বলে, “বাংলার মাটি, দুর্জয় ঘঁাটি।”

১৯৭১ সালে তৎকালীন বিশ্বের তৃতীয় সমর শক্তির অধিকারী পাক হানাদার বাহিনী কী লজ্জাজনকভাবেই না আত্মসমর্পণ করেছিল দ্রাবিড় জনকওমের সন্তানদের হাতে।

হযরত নূহ (আ.)-এর সপ্তম পুরুষ হযরত আবি পীর ভারতে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। তঁার নাম নামানুসারে ভারতের নাম ছিল দ্বার-ই-আবির। অর্থাৎ আবিরের গৃহদ্বার বা বসতি। বহিরাগত বিজয়ী আযর্যগণ আজকের ভারতের সকল ঐতিহাসিক তথ্য- প্রমাণ ধ্বংস করে নিজেদের অনুকূলে প্রতিস্থাপন করে। তারা যে ভরতের নামানুসারে ভারত নামকরণ করেছে, সে ভরতও এ উপমহাদেশের সন্তান নন। ভারতে আযর্য আক্রমণের প্রথম নেতা যিনি দেবরাজ ইন্দ্র নামে খ্যাত, তিনি সিরিয়া হতে আগত। রামচন্দ্রের জন্মভূমি কিনান তথা আজকের ফিলিস্তিনে। ভরতের জন্মস্থান উত্তর পশ্চিম আফগানিস্তানে। তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে অতীতের অনেক ইতিহাসই আজ রূপকথায় বিবেচিত হচ্ছে।

এবার বর্তমান কুমিল্লার নামকরণের উৎস অনুসন্ধান করা যাক। যাদেরকে অর্থাৎ আমাদের পূর্ব পুরুষদের দ্বার-ই-আবির তথা দ্রাবিড় বলা হয়, এরা ছিলো একেশ্বরবাদী-- আল্লাহতে বিশ্বাসী। তাই বহিরাগত জনকওম এদেরকে ‘কওমে আল্লাহ’ বলে ডাকতো। কালের বিবর্তনে তা এক সময়ে ‘কুমিল্লা’ রূপ ধারণ করে। এ বিষয়ে যতো কথাই বলা হোক না কেন, ‘কওমে আল্লাহ’ হতেই কুমিল্লা শব্দের উৎপত্তি। এটাই যৌক্তিক বাস্তব সম্মত। তাছাড়া এ জাতির আতিথেয়তা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, বীরত্ব সবই আরবীয় তথা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক, জনকওমের মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে, মূল্যবোধ লালনে সম্প্রদায়গত আদর্শ সংরক্ষণে, সহমর্মিতায়, মেহমানদারিতে সমতটের মানুষ আজও বিবেচিত অনন্য উদাহরণ হিসেবে। এতদঞ্চলের মানুষের একতাবোধ আজও সর্ব মহলে প্রশংসিত। উচ্চারিত ভাষায় ‘হ’ এবং ‘ন’ এর অধিক ব্যবহারই প্রমাণ করে এখানকার উচ্চারিত শব্দের সাথে আরবী ভাষার সখ্যতা। আর ব্যক্তি মানুষের নামকরণেও এর প্রভাব সহজেই লক্ষ্য করা যায়।

সেন রাজ বংশের আগে আমাদের এ ভূ-খণ্ডে মূর্তিপূজারীদের পূজা মণ্ডপ পরিচালনা করার মতো কোনো ব্রাহ্মণ ছিলো না বিধায় রাজা লক্ষ্মণ সেন ভারতের কন্যাকুজ হতে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসতি স্থাপন করতে দেয়। কালের প্রবাহে এ এলাকার নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে।

১৬১০ সালে ত্রিপুরা রাজ্যের সমতল এলাকা নিয়ে ত্রিপুরা নাম নিয়েই বাংলার অন্তর্ভুক্তি। ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা রাজ্য হতে বিভক্ত হয়ে জেলার স্বীকৃতি পায়। ১৯৬০ সালে নামকরণ হয় কুমিল্লা। ১৯৮৪ সালে এ জেলা তিন ভাগে অর্থাৎ তিনটি মহকুমাই স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা লাভ করে। বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার আয়তন ৬ হাজার ৭১৬ বর্গ কিলোমিটার, থানা/উপজেলার সংখ্যা ২৯টি, ইউনিয়ন সংখ্যা ৫১৭টি, গ্রামের সংখ্যা ৬০৬৪টি এবং মিউনিসিপ্যালিটি ১৬টি। এ বৃহত্তর জেলাটিতে রয়েছে ৫ হাজার ২৫৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাই স্কুল ১ হাজার ১৩০টি, কলেজ ২১৪টি ও মাদ্রাসা ৬৬৮টি। রয়েছে মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। জনসংখ্যা এক কোটি ১০ লক্ষের উপর (২০১১ সালের প্রাপ্ত তথ্য মতে)।

ভূ-অবস্থানগত কারণেই কুমিল্লার সামরিক গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। বৃটিশ শাসনামলে কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত হয় বৃটিশ ইস্টার্ন কমান্ড হেড কোয়ার্টার। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কালীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃটিশ সামরিক কর্তৃত্ব এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হতো। পাকিস্তান আমলেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। আর বর্তমানে তো এর গুরুত্ব আরো বেশি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে চঁাদপুরে স্থাপিত হয় পাকিস্তান ইস্টার্ন থিয়েটার তথা রিয়ার হেড কোয়ার্টার। আর এর দায়িত্বে ছিলেন ইস্ট পাকিস্তানের ডেপুটি চীফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মেজর জেনারেল আব্দুর রহিম। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সামরিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষই অনুভব করতে পারেন সামরিক বিবেচনায় এ জেলার গুরুত্ব।

বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা প্রতিভা প্রসবিনী জেলা হিসেবেই পরিচিত। এ জেলার কৃতী সন্তান নাসির নগরে জন্মগ্রহণকারী ব্যারিস্টার এ. রসূল (১৮৭৪-১৯১৭), যিনি প্রথম ভারতীয় বি.সি.এল. ডিগ্রিধারী। জন্মগ্রহণ করেছিলেন নওয়াব স্যার গোলাম মহিউদ্দিন ফারুকী, নওয়াব স্যার কাজী শামসুল হুদা (১৮৬২-১৯২১), যিনি ১৯০২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঠাকুর আইন অধ্যাপক’ নিযুক্ত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকল্পে গঠিত ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিরও সদস্য ছিলেন। ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ছিলেন তঁার আর্টিকেল ক্লার্ক। ১৮৯৮ সালে জন্মগ্রহণকারী মফিজ উদ্দিন আহমেদ, যিনি ১৯৩৩ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদ সদস্য, অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা বিষয়ক পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী, ১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, ১৯৫৪ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদমর্যাদায় পরিকল্পনা কমিশন সদস্য এবং ১৯৬২ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রী। ১৮৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম, যঁাকে ১৯৬৪ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসের ‘ফখরে বাঙ্গাল’ উপাধিতে বিভূষিত করেন। নবাব সিরাজুল ইসলাম (১৮৮২-১৯৫৫) ছিলেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের স্বনামধন্য অধ্যাপক। ড. মমতাজ উদ্দিন (১৯০৩-১৯৭১) ঢাকা কলেজের প্রথম মুসলমান প্রিন্সিপাল ১৯৪৫ হতে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাঞ্চেলর হিসেবে ১৯৫৭ সাল হতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এ জেলারই গর্ব মহীয়সী নারী নবাব ফয়জুন নেছা চৌধুরানী, যিনি নারী শিক্ষা এবং নারী মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ।

বীর প্রসবিনী এ বৃহত্তর জেলায়ই জন্মগ্রহণ করে এ মাটির ঋণ শোধ করেছেন বৃটিশ সেনা বাহিনীর মেজর গনি, কাজী জাফর আহমদের মতো কিংবদিন্ততুল্য ছাত্র নেতা, শ্রমিক নেতা এবং পরিশেষে শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সেক্টর-১-এর প্রধান, পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও লেখক, মেজর জেনারেল শামসুল হক, যুদ্ধকালীন সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশের সরকারের উপদেষ্টা এবং পরে মন্ত্রীত্বের আসনে উপবিষ্ট । এ জেলারই কৃতী সন্তান এবং সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী, যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অলংকার, সেক্টর-২-এর অধীন সাব-সেক্টর-২-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন (অব.) জহিরুল হক পাঠান এবং এ সাব-সেক্টরের কিংবদন্তির সংগঠক ও সম্মুখ সারির যোদ্ধা বি.এম. কলিমুল্লাহ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য ও পরে তথ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল করিম পাটওয়ারী, এম.এন.এ, নওজোয়ান ওয়ালী উল্লাহ, এম.এন.এ, আব্দুর রব বিএসসি, আবু জাফর মাঈনুদ্দিন, মো. রাজা মিয়া এম.পি., ষাটের দশকের কিংবদন্তির ছাত্র নেতা এবং ঐতিহাসিক ১১ দফার রূপকার ড. মাহবুব উল্লাহ, বিপ্লবী ছাত্রনেতা, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী মাহফুজ উল্লাহ, পূর্ব-পাক-গর্ভনর নুরুল আমিন, কুমিল্লা জেলা পরিষদের সুদীর্ঘ সময়ের চেয়ারম্যান ‘খান বাহাদুর’ আবিদুর রেজা চৌধুরী, মেঘনার পূর্বপাড়ের সবচে’ বড়ো জমিদার রূপসার রসু মিয়া, মুক্তিযুদ্ধের আরেক কিংবদন্তি কমরেড খালেকুজ্জামান ভূইয়া, জাস্টিস ইব্রাহিম, উস্তাদ আলী আকবর খঁা, উস্তাদ আলাউদ্দিন খঁা, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, কবি আব্দুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) প্রমুখ।

অতএব, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, রাষ্ট্র পরিচালনায় বৃহত্তর কুমিল্লার সম্পৃক্ততা উদাহরণ হিসেবে বিবেচ্য। এ জেলাবাসীর একতা এবং ঐতিহ্যকে লালন করা অবশ্য কর্তব্য হিসেবে পালন করা উচিত।

তথ্যসূত্র : ১. এনসাইক্লোপিডিয়া-অব দ্যা ওয়ার্ল্ড; ২. হিস্টরি অব রিলিজিয়ন; ৩. দি আরলি হিন্দু ইন্ডিয়া; ৪. দি বাইবেল অব দ্যা এরিয়ান ইনভেশন; ৫. দি ফল অব সিভিলাইজেশনস; ৬. ঋগ্বেদ।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আয়কর আইনজীবী।

ছবি : ২৮

চঁাদপুর

আহমেদ উল্লাহ ভূঁইয়া

চঁাদবদনী রূপের রাণী--বাংলাদেশের হুর,

বীর সন্তানদের জন্মদাত্রী--আমাদের চঁাদপুর।

রাস্তি শাহের আশীষধন্যা--শাহ ফরিদের আবাসন,

বীরত্বে আর জ্ঞান গরিমায়--পরিপুষ্ট মানুষজন।

মেঘনা পাড়ের নদী বন্দর--চঁাদপুর এ শহর,

সুমেরিয়ান আমল হতেই আসতো হেথা--বাণিজ্য বহর।

হাজার হাজার পালতোলা নাও--সদাগরদের সাথে,

সারা বিশ্বের মানুষজন-- মিলিত এ ঘাটে।

সকল পেশায় সর্বযুগে-- চঁাদপুরেরই মানুষজন,

শিক্ষা-দীক্ষায় জ্ঞান গরিমায়--রাখছে তাদের অবদান।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে-- চঁাদপুরবাসীর বীরত্ব,

প্রমাণ করে বিশ্বের কাছে--চঁাদপুরেরই শ্রেষ্ঠত্ব।

এক ডিভিশন পাক সেনা--প্রাণ হারায় বেঘোরে,

স্বাধীনতার পতাকা এ ঠায়--সবার আগে উড়ে।

বি.এম. কলিম, জহিরুল হক পাঠান--সহযোদ্ধা মুক্তিসেনার দল,

রক্তখেকো হানাদারদের-- পাঠায় রসাতল।

রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী-- আম জনতার সহযোগিতার ফল,

বিজয় লাভ সহজ ঠেকে--বাড়ায় মোদের বল।

স্বাধীন দেশের যে ঠায় তাকাই--উচ্চে যে আসন,

চেয়ে দেখি বসা সেথায়-- চঁাদপুরের সন্তান।

মেঘনার পানে চেয়ে দেখি--ইলিশ নৃত্যরত,

রূপে স্বাদে তুলনাহীন-- জিহ্বা অসংযত।

চঁাদ যেমনি অঁাধার কেটে--মতের্য ছিটায় আলো,

বাংলাদেশের এ জনপদ-- সবার চেয়ে ভালো।

কবি : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আয়কর আইনজীবী।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়