রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫  |   ৩৩ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর রেলওয়ে কোর্ট স্টেশনে অজ্ঞাত বৃদ্ধের মৃত্যু
  •   চাঁদপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের নেপথ্যে--
  •   হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার দাপটে বিচার পাচ্ছে না ক্ষতিগ্রস্তরা

প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৫, ০১:০৬

একটি পত্রিকার গল্প, একটি সময়ের কথা

কাজী নজরুল ইসলাম নজু
একটি পত্রিকার গল্প, একটি সময়ের কথা

সাহিত্য চর্চা মানেই শুধু কলম ধরা নয়, এর সাথে জড়িয়ে থাকে অনুভব, বিসর্জন আর এক ধরনের নীরব যুদ্ধ। আর যদি সেই সাহিত্যচর্চা হয় জেলা শহরে, তবে তা আরও কষ্টসাধ্য, আরও সংগ্রামী। বড়ো শহরের মতো না এখানে, যেখানে বইমেলা হয় বছরে একাধিকবার, সাহিত্য সভায় ভিড় জমে, আর লেখকের পাশে থাকে পাঠক ও প্রকাশক। জেলা শহরের লেখকের পাশে থাকে একটি পুরোনো ডায়েরি, কয়েকজন নীরব পাঠক, আর কিছু জেদী সহযোদ্ধা আর কিছু নবীন লেখকের, অনেকটা লেখক খুঁজে খুঁজে বের করা। এখানে নেই পর্যাপ্ত পাঠকের সংখ্যা, নেই প্রকাশনার সুযোগ, নেই নিরবচ্ছিন্ন উৎসাহ। যারা সাহিত্য চর্চা করে, তারা মূলত করে ভালোবাসা থেকে, চাহিদা বা স্বীকৃতির জন্যে নয়। হয়তো কোনো এক সন্ধ্যায় বাজার ফেরত এক লেখক চায়ের দোকানে বসে লেখা পড়ে শোনায় বন্ধুকে, তার মধ্যেই আনন্দ খেঁাজে। তবুও, এই জেলা শহরের মাটিতে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে কিছু স্বপ্ন, কিছু শব্দ, আর কিছু সাহসী কলম। যারা কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও সাহিত্যকে বঁাচিয়ে রাখে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোই আজকের সময়ের দাবি।

আশির দশকের শুরুতে এমন সময় ছিলো, যখন আমরা চঁাদপুর শহরে একসাথে হঁাটতাম, হাসতাম, স্বপ্ন দেখতাম। আমি, শাহাদাত, আবদুল্লাহিল কাফী, আ. মতিন মোল্লা, সলিমুল্লা, জহির, মহসীন, ভোলানাথ মজুমদার, তরুণ, টিপু আরও অনেকেই ছিলো সে সময়ে আমাদের পাশে। কেউ ছিলো চুপচাপ, কেউ একটু পাগলাটে, কেউ গম্ভীর হলেও ভিতরে ছিলো ঝরণার মত উচ্ছ্বাস। স্কুলের মাঠ, গ্রামের পথ, টিনের চালের নিচে দুপুরবেলার গল্প এসব নিয়েই গড়ে উঠেছিলো আমাদের দিন। তখন ভাবিনি, এই দিনগুলো একদিন শুধু স্মৃতির পাতা হয়ে থাকবে। আজ সবাই যে যার জায়গায় ব্যস্ত, কেউ শহরে, কেউ বিদেশে, কারো খবরই আর ঠিকঠাক পাই না। তবু মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করলে মনে হয়, আমরা এখনো একসাথে হঁাটছি সেই পথ ধরে... যেন সময় থেমে আছে ঠিক সেইখানে।

বয়স বাড়লে মানুষ নাকি পুরানো দিনগুলোর দিকে বারবার ফিরে যেতে চায়। আমি তার ব্যতিক্রম নই। এই জীবনের নানা ব্যস্ততা, টানাপোড়েন, সাফল্য আর ব্যর্থতার ভিড়ে হঠাৎ কোনো দুপুর কিংবা একাকী সন্ধ্যায় মনে পড়ে যায় আমি একা ছিলাম না কখনো। পাশে ছিলো শাহাদাত, আবদুল্লাহিল কাফী, মতিন মোল্লা, সলিমুল্লা, জহির... আর আরও অনেক নাম, যাদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছোট ছোট হাসি, ঝগড়া, দুষ্টুমি আর হৃদয়ের স্পর্শ। আমরা একসাথে হেঁটেছি মেঠোপথে, খেলেছি উঠানে, চায়ের দোকানে বসে রাজনীতি নিয়ে তর্ক করেছি, কবিতা পড়েছি, গান গেয়েছি। কারও গায়ে তখন

ইৎধহফবফ

জামা ছিল না, তবু সম্পর্কগুলো ছিলো মূল্যবান। কেউ কারও পদবি জানতো না, তবু ভালোবাসার অভাব ছিল না। তখন কেউ নেতা হতে চায়নি, কেউ প্রখ্যাত কবি নয়, কেউ বড়ো চাকরি করবে সেই ভাবনাও মাথায় ছিলো না। কেবল ছিলো একসাথে থাকার আনন্দ। মতিন মোল্লার ঝেঁাক ছিলো কবিতায়, কাফী ছিল একটু স্বপ্নবাজ, জহির ছিলো বোকাসোকা কিন্তু খঁাটি, আর সলিমুল্লা? সে তো ভুপেন হাজারিকার গানে ডুবে থাকতো, তার মতো পাগলাটে ভক্ত আর দেখি নাই। লেখালেখি না করলেও আমাদের সহযোদ্ধা ছিলো, সাহিত্যের প্রতি ছিলো অগাধ ভালোবাসা। আজ আমরা সবাই কোথায় ছড়িয়ে গেছি। সময় আমাদের ছিটকে দিয়েছে জীবনের নানা দিকে। কেউ হয়তো ব্যস্ত কর্পোরেট অফিসে, কেউ প্রবাসে, কেউ হয়তো আর আমাদের মাঝে নেই। তবুও একটা ফোন বাজলে, কোনো পুরোনো নাম ভেসে উঠলে, বুকের ভেতর কিছুটা যেন কেঁপে উঠে।

আমাদের মাঝে অনেকেই লেখালেখি করতো বলে মাথায় আসলো সাহিত্য পত্রিকা বের করার কথা, ঠিক এমনি করেই একটা সাহিত্য পত্রিকার জন্ম হলো নির্ভীক তারপর ‘নির্ঝর’। পত্রিকায় লেখা চেয়ে অনেকের কাছে গিয়েছি, কেউ উৎসাহ দিয়েছে, কেউ আবার নিরুৎসাহিত করেছে, কেউ কেউ টাকা-পয়সা দিয়েও সাহায্য করেছে। এটা নিয়ে আছে অনেক মধুর স্মৃতি, দুঃখের গল্প। নির্ঝরের এই যাত্রাটা ছিলো যেন একটা নদীর ধারাÑ কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল। যখন লেখার জন্যে হাত পাতলাম, কেউ হাসিমুখে বললো, ‘চমৎকার উদ্যোগ!’ কেউ আবার চুপ করে শুনে বললো, ‘এগুলো কেউ পড়ে না এখন।’ তবুও আমরা থামিনি। কারণ জানতাম, কিছু মানুষ আছে যাদের চোখ খেঁাজে ভাষা, যাদের মন আজও কাগজে ছাপা অক্ষরের ঘ্রাণে স্নিগ্ধ হয়। কেউ লেখার প্রতিশ্রুতি দিলেও দেয়নি, কেউ চুপচাপ একদিন চমৎকার লেখা পাঠিয়ে দিলো। কেউ টাকা দিয়ে বলেছে, ‘তোমার স্বপ্নে আমারও ভরসা আছে।’ আবার কেউ কটাক্ষ করে বলেছে, ‘এগুলো দিয়ে কী হয়?’ এই পত্রিকায় শুধু লেখা নেই, আছে আত্মার স্পর্শ, বন্ধুত্বের ছেঁায়া, প্রত্যাখ্যানের ব্যথা আর অকৃত্রিম কিছু ভালোবাসার গল্প। নির্ঝর তাই শুধু একটি প্রকাশনা নয়, এটা একটা অনুভূতির নাম, একটা লড়াইয়ের নাম, একটা চলার গল্প, যেখানে থেমে যাওয়াটাই সবচেয়ে সহজ ছিলো, তবু থামিনি। যারা সাহিত্যিক ছিলো না, তবুও সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো অনুরাগী ছিলো। কখনো লেখা দিয়ে নয়, তারা আমাদের সাহস দিয়ে সাহিত্যের পাতা ভরিয়েছে। আজ যখন পিছনে তাকাই, নির্ঝরের পথচলায় এই মানুষগুলোর অবদান চোখে পড়ে না ঠিকই, কিন্তু হৃদয়ে তারা সবচেয়ে উজ্জ্বল জায়গাটিতে আছেন।

সেই মানুষগুলোর কথা ভাবলে আজও মনটা নরম হয়ে আসে। যারা কলম না ধরলেও পাশে দঁাড়িয়েছিলো ছায়ার মতোÑকখনো একটা বিজ্ঞাপন জোগাড় করে, কখনো দুটো কপি বেশি কিনে, আবার কেউ নিঃশব্দে শুধু বলেছে, ‘চল, পাশে আছি।’

নির্ঝর পত্রিকাটা হয়তো এখন আর প্রকাশিত হয় না, কিন্তু নির্ঝরের পাতায় লেখা রেখেছেন অনেকেই। কেউ প্রথম লেখা ছেপেছিলেন, কেউ সাহস পেয়েছিলেন কলম চালানোর, কেউ নিজের হৃদয়ের কথাগুলো প্রথমবার প্রকাশ করেছিলেন সেই পাতায়। নির্ঝর ছিলো শুধু একটা পত্রিকা না, ছিলো একটা আবেগ, একটা প্ল্যাটফর্ম, একঝঁাক স্বপ্নবাজ মানুষের মেলবন্ধন। এখন হয়তো নির্ঝর নেই, কিন্তু নির্ঝরে লেখা সেই শব্দেরা এখনো বহু পাঠকের বুকের ভেতর বেঁচে আছে। নির্ঝরের প্রতিটা সংখ্যা যেন একটা সময়ের দলিল। যারা লিখেছিলেন, তারা নির্ঝরের সাথে বেঁধেছিলেন নিজেদের একটা আত্মিক সম্পর্ক, আর সেই সম্পর্ক কখনো হারিয়ে যায় না। নির্ঝর থেমেছে, কিন্তু নির্ঝরের পথচলা হয়ে উঠেছে অনেকের নিজের লেখালেখির সূচনাপথ।

নিলুফার আক্তার শিল্পীর নির্ঝরের পাতায় কবিতা দিয়ে শুরু, আর আজ দুটি অসাধারণ উপন্যাস ‘অতলান্ত খেঁাজ’ আর ‘তাহাদের কথা’ তাকে এনে দিয়েছে আলাদা পরিচিতি। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সে অধ্যাপনা করছে, দেশের একজন গর্বিত কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে সাহিত্য-অঙ্গনে। নির্ঝরের লেখক বায়তুল্লাহ কাদরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রফেসর। শিল্পী তার বইয়ে নির্ঝরের নাম, আমাদের ছোট্ট চেষ্টাটির প্রতি তার কৃতজ্ঞতা জানায়। এটাই প্রমাণ করে, ভালোবাসা আর শেকড় কেউ ভোলে না।

আমার নিজের খুব ভালো লেগেছে ভেবেÑআমরা একসময় পাশে ছিলাম, তার শুরুর সাক্ষী ছিলাম। এই পথচলায় নির্ঝর যেমন গর্বিত, আমরাও তেমনি। শিল্পীর মতো একজন সত্যিকারের সাহিত্যসঙ্গী আমরা পেয়েছিÑএটাই তো বড়ো পাওয়া।

কাজী শাহাদাত নামটা উচ্চারণ করলেই মনে পড়ে যায় এক নিরলস কর্মীর মুখ। সাহিত্যকে শুধু ভালোবেসে নয়, দায়িত্ব নিয়ে তিনি কাজ করে গেছেন নিঃশব্দে, দৃঢ়তায়। তখন তো এতো প্রযুক্তি ছিলো না, হাতে গোণা কিছু টুলস আর অফুরন্ত মনোযোগ ছিলো তঁার সম্বল। কিছু মানুষের পরিচয় লেখা থাকে না ব্যানারে, তাদের কাজই হয়ে উঠে তাদের পরিচয়। কাজী শাহাদাত ছিলেন এমনই এক নাম, যিনি নিঃশব্দে গড়েছেন একটি সাহিত্যিক যুগ। প্রেসের গন্ধ, ছাপার অক্ষরে মিশে থাকা তার নিঃস্বার্থ শ্রম, একটি বানানের ভুলেও যিনি অঁাচ করতেন সাহিত্যের অপমান যেন হয়ে যাবে। তাই তো তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ এক দায়বদ্ধতায়, যার নাম আজও শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হয় নির্ঝরের পৃষ্ঠায়, স্মৃতির পাতায়।

প্রেসে বসে ঘামে ভিজে প্রুফ দেখা, পুরানো কম্পোজের অক্ষরে অক্ষরে চোখ বুলানো, প্রতিটি শব্দে যেন প্রাণ ঢেলে দিতেন। বানান ভুল যেন না হয়Ñএই একাগ্রতা দেখে আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। সাহিত্যের প্রতি এমন নিষ্ঠা আজকাল খুব কমই দেখা যায়। তিনি ছিলেন সেই মানুষ, যিনি ব্যাকগ্রাউন্ডে থেকে কাজ করতেন, প্রচারের আলো থেকে দূরে। আর এখানে অর্থিক সুবিধা তো ছিলোই না, শুধু ছিলো সাহিত্যের প্রতি নিখাদ ভালবাসা,আর এজন্যেই তঁার ছেঁায়া ছাড়া নির্ঝরের কোনো সংখ্যাই যেন পূর্ণ হতো না। আজ তিনি যেখানে আছেন, সেখান থেকেও যদি দেখেন, তবে নিশ্চয়ই গর্ব করেন, তঁার নিঃশব্দ শ্রম কতো মানুষের মনে আজও জায়গা করে আছে। কাজী শাহাদাত কেবল একজন মানুষ নন, তিনি এই সাহিত্যপ্রয়াসের এক অনন্য স্তম্ভ,সেই সময়ে যারা নিজের চোখে দেখেছে তারা এটা স্বীকার করবেÑএটা হলফ করে বলতে পারি। শাহাদাত এমন একজন মানুষ, যিনি শুধু নিজের মেধা দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে সাহিত্যকে ভালোবেসেছিলেন। তিনি চাইলে ঢাকার নামী পত্রিকায়, নামী প্রতিষ্ঠানে অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারতেন। তঁার লেখার জোর, সম্পাদনার মুন্সিয়ানা, প্রুফে নিখুঁত নজরÑসবকিছুই ছিলো জাতীয় পর্যায়ে কাজ করার মতো। তবুও তিনি চেয়েছিলেন নিজের মাটি, নিজের শহর, নিজের মানুষদের সঙ্গে থাকতে। চঁাদপুরের মফস্বল শহরটাই তঁার ভালোবাসার জায়গা। এখানকার তরুণদের লেখালেখিতে উৎসাহ দেওয়া, ছোট ছোট পত্রিকা দঁাড় করানো, রাত জেগে প্রুফ দেখা, নীরবে পাশে থাকাÑএসবই তিনি করে গেছেন কোনো স্বীকৃতির আশায় নয়, একান্ত ভালোবাসা থেকে। চঁাদপুর শহরেই তিনি তঁার স্বপ্ন বুনেছেন এবং সেই স্বপ্নের কিছুটা হলেও বাস্তব রূপ দিয়েছেন। এমন মানুষ সত্যিই বিরল। শাহাদাত শুধু একজন সম্পাদক ছিলেন না, তিনি ছিলেন সাহিত্যের এক নীরব পথপ্রদর্শক। ওসব অর্জনের পেছনে থাকে কিছু নীরব নায়ক, যারা কৃতিত্বের মোড়কে না থেকে দঁাড়িয়ে থাকে আড়ালে। কাজী শাহাদাত ছিলেন তেমনই। নির্ঝর তঁার কাছে শুধু পত্রিকা ছিলো না, ছিলো প্রাণ। গ্রীষ্মের দুপুরে, রাতে আলো ফেলে বানান দেখে তিনি তৈরি করেছেন যে সাহিত্যিক পথ, আজও অনেকের জন্যে অনুপ্রেরণা। কিছু মানুষ সত্যিই যেন আলো ছড়ায় নিঃশব্দে। তারা থাকে না মঞ্চের সামনে, তবু পর্দার পেছনেই গড়ে তোলে দৃশ্যপট। কাজী শাহাদাত ছিলেন তেমনই এক নাম, যশ, পুরস্কার নয়, তিনি খুঁজতেন সাহিত্যিক সৌন্দর্যের ছায়া। প্রেসের গরম ঘরে ঘাম ভেজা পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে একটি একটি শব্দে ছুঁয়ে যেতেন মমতা, যত্ন আর নির্ভুলতার পাঠ। তঁার চোখে বানানের ছোট ভুলও যেন ছিলো সাহিত্যচ্যুতি, তঁার হাতে জন্ম নিতো নির্ঝরের মতো একেকটা নিঃশব্দ বিপ্লব। তিনি চাইতেন, এই ছোট শহরেও সাহিত্য বঁাচুক, মোহনায় বয়ে যাক পদ্মা-মেঘনার মতো গদ্য-কবিতার ঢেউ। হয়তো পত্রিকাটি এখন আর ছাপা হয় না, কাগজে-কালিতে তার চলাফেরা থেমে গেছে, কিন্তু আমার হৃদয়ে নির্ঝর আজও জীবন্ত। এই ভালোবাসা, এই টান এতোটাই গভীর যে, নিজের দ্বিতীয় সন্তানের নামও রেখেছি নির্ঝর। কাগজের পাতায় সে হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু আমার রক্তে, আমার জীবনের গল্পে, আমার সন্তানের নামেই সে আজও বহমান। নির্ঝর ছিলো আমার স্বপ্ন, সাহস, সংগ্রাম আর সৃষ্টির মিলনস্থল। সে কেবল একটি সাহিত্যপত্রিকা নয়, ছিলো একটা সময়, একটি অনুভব, কিছু সম্পর্ক, কিছু গভীর ভালোবাসার নাম। আর তাই নির্ঝর হারায়নি, সে রয়ে গেছে আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে, আমার সন্তানের হাসিতে, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবিতে। জীবনের দায়-দায়িত্ব, সংসার, চাকরি, সময়ের চাপÑসব মিলে একসময় সেই সৃজনশীল প্রবাহটা ধীর হয়ে আসে। তবুও ভেতরে কোথাও একটা অংশ থাকে, যেটা কখনো মরে না। কখনো হঠাৎ কোনও কবিতা দেখে, পুরোনো বইয়ের পাতায় ধুলোমাখা গন্ধে, কিংবা পরিচিত কারও লেখায়, সেই পুরোনো টান আবার জেগে উঠে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। আমি সেই হাজারো হৃদয়ের একজন, যঁারা এখনো শব্দকে ভালোবাসি, মনের ভেতরে তুলে রাখি ছোট ছোট ভাবনার জোগান। থেমে গেলেও তা হারায়নি, শুধু অপেক্ষায় থাকিÑকখন আমি আবার কলম তুলে নিবো, কিছু একটা লিখি হাবিজাবি, যা একটা কিছু।

হ্যঁা, কিছু মানুষ সত্যিই আলাদা। কাজী শাহাদাত সেই ধরনের মানুষ, যিনি নিজের ভালোবাসার জায়গাটাকে সময়ের স্রোতে ভেসে যেতে দেননি। সাহিত্য আর সম্পাদনার প্রতি তঁার দায়বদ্ধতা, নিষ্ঠা, এমনকি জীবনের নানা ব্যস্ততার মধ্যেও সে টানটাকে ধরে রেখেছেন, সেটাই তঁাকে আমাদের মাঝে আলাদা করে তোলে। আমরা অনেকেই সময়, পরিবার, কর্মজীবন, বাস্তবতার চাপে সেই স্বপ্নটা একটু পিছনে সরিয়ে রেখেছি। পারিনি মানে হারিয়ে যাইনি, হয়তো থেমে গেছি কিছু সময়ের জন্যে। কিন্তু কাজী শাহাদাতের মতো কারও উপস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যেখানে থেমে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে আবার শুরু করা যায়। এই স্বীকারোক্তি শুধু এক ধরনের দুঃখ নয়, একরকম শ্রদ্ধা, অনুপ্রেরণাও। তিনি করে যাচ্ছেন সৃষ্টির কাজ, শব্দের সঙ্গে বোঝাপড়া। আর আমরা তাকিয়ে দেখি, মনে মনে ভাবিÑ‘আমিও কি একটু সময় বের করে আবার কলমটা তুলতে পারি না?’

৩০ মে ২০২৫ তারিখে চঁাদপুর সাহিত্য একাডেমির নির্বাচনের দিনটা ছিলো যেন এক আবেগঘন মিলনমেলা। অনেকদিন পর বহু পরিচিত মুখ একসাথে।কারো চোখে ছিলো বিস্ময়, কারো মুখে পুরোনো গল্পের হাসি। কেউ কেউ হয়তো বদলে গেছে, কারো চুলে এসে গেছে রূপালি ছেঁায়া, তবুও সেই চেনা ভঙ্গিমা, সেই পরিচিত হাসিÑসবই যেন সময়কে পেছনে টেনে নিয়ে এলো।

সেদিন শুধু নির্বাচন হয়নি, হয়েছে স্মৃতি ভাগাভাগি, অনুভূতির আদান-প্রদান। মনে হচ্ছিলো, যেন আবার ফিরে এসেছি সেই দিনগুলোতে, যখন সাহিত্য নিয়ে আলোচনায়, তর্কে, আড্ডায় মুখর ছিলো চারপাশ। এমন দিনগুলো বারবার আসুকÑএই প্রত্যাশাই রয়ে যায় মনে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, এই প্রজন্মের অনেক তরুণ-তরুণীর সাহিত্য একাডেমি ঘিরে উচ্ছ্বাস, আগ্রহ আর মুগ্ধতা দেখে। ওদের চোখে যে আগুন, যে কৌতূহল, তা যেন আমাদের তরুণ দিনের সাহিত্যপ্রেমকে মনে করিয়ে দেয়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট, সভায় অংশগ্রহণ, প্রশ্ন-উত্তর, আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণÑসবকিছুতেই ফুটে উঠেছে ওদের আন্তরিকতা। যেন এক নতুন বাতাস বইছে সাহিত্য আঙ্গিনায়।

এই উচ্ছ্বাসটাই প্রমাণ করে, সাহিত্য কখনো পুরোনো হয় না, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা শুধু রূপ বদলায়, কিন্তু প্রজ্ঞা আর অনুভূতির ধার একটুও কমে না। এদের দেখে আশার আলো জাগে, আমাদের কাজ বৃথা যায়নি। সাহিত্যের এই শিখা ঠিকই এগিয়ে নিয়ে যাবে নতুনরা।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সাহিত্য একাডেমি, চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়