বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনে আগুন

প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৫, ০৯:৩০

স্টার্টআপ : সফলতার কৌশল ব্যর্থতার কারণ

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
স্টার্টআপ : সফলতার কৌশল ব্যর্থতার কারণ

স্টার্টআপ হলো নতুন একটি ব্যবসা, যার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য কিংবা অন্য যে কোনো পরিষেবা বাজারজাত করার জন্য যাত্রা শুরু করে। তবে বর্তমানে স্টার্টআপের কার্যক্রম অনেকটাই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (ওঈঞ) ওপর নির্ভরশীল। এটি একটি স্কেলেবল ব্যবসায়িক মডেল যেখানে এর অগ্রাধিকার হলো দ্রুত এবং সুশৃঙ্খলভাবে পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে এর সুবিধাভোগীকে সেবা দান করে।

সাম্প্রতিক সময়ে তরুণ আইসিটি ও বিজনেস গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে ‘স্টার্টআপ’ শব্দটি বেশ জনপ্রিয়। মূলত ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে যেখানে চাকরির বাজার খুবই সীমিত, সেখানে শিক্ষিত তরুণদের অনেকেই চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তারা গ্রহণ করছেন ক্ষুদ্র উদ্যোগ, গড়ে তুলছেন বিভিন্ন স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখছে দেশের ক্রমবিকাশমান তথ্যপ্রযুক্তি খাত।

বাংলাদেশে বর্তমানে ১ হাজার ২০০-এর বেশি স্টার্টআপ সক্রিয় রয়েছে এবং প্রতিবছর নতুন ২০০ করে স্টার্টআপের সৃষ্টি হচ্ছে। এই স্টার্টআপগুলো এরই মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। দেশীয় স্টার্টআপের মধ্যে ফিনটেক, ই-কমার্স ও লজিস্টিকস স্টার্টআপের সংখ্যা বেশি। তাদের মাধ্যমে দেশের চেয়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেশি লক্ষণীয়।

গত এক দশকে প্রায় ৩০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে তাদের মাধ্যমে। দেশজুড়ে মুঠোফোনের বিস্তার, ইন্টারনেট সম্প্রসারণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুযোগটি স্টার্টআপ বিকাশের অন্যতম প্রধান সহায়ক।

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশী দুই তরুণের এআই স্টার্টআপ ‘ঙপঃড়ষধহব’ পেয়েছে ২৬ লাখ ডলারের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ। ওয়ান চৌধুরী ও মো. আবদুল হালিম রাফি। বাংলাদেশি এই দুই উদ্যমী তরুণ তৈরি করেছেন এআই-নেটিভ কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট (সিআরএম) সফটওয়্যার ঙপঃড়ষধহব, যা এখন সারা বিশ্বের প্রযুক্তি দুনিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

এটি একটি স্বয়ংক্রিয় (সেলফ-ড্রাইভিং) ঈজগ সফটওয়্যার, যা নিজে থেকেই ডেটা আপডেট করে, পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করে এবং ম্যানুয়াল কাজের ঝামেলা কমিয়ে বিক্রয় টিমকে আরও দক্ষ করে তোলে। ঙপঃড়ষধহব বর্তমানে ২০০টির বেশি কোম্পানিকে সেবা দিচ্ছে এবং ৫ হাজারের বেশি কোম্পানি রয়েছে ওয়েটিং লিস্টে। বিশ্ব বিখ্যাত ঝধষবংভড়ৎপব ও ঐঁনঝঢ়ড়ঃ-এর মতো জায়ান্টদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ঙপঃড়ষধহব এখন ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঈজগ মার্কেটে নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছে।

এছাড়া ‘ফোর্বস এশিয়া ১০০ টু ওয়াচ’ তালিকায় কৃষি (এগ্রিকালচার) ও উৎপাদন ও শক্তি (ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এনার্জি) বিভাগ থেকে বাংলাদেশের নতুন উদ্ভাবনী উদ্যোগ (স্টার্টআপ) আইফার্মার ও টাইগার নিউ এনার্জি স্থান পেয়েছে।

দেশের অভ্যন্তরেও সাফল্য পাওয়া বেশ কিছু স্টার্টআপ রয়েছে। যেমনÑবিকাশ : বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রায় ৭০ ভাগ বিকাশের দখলে আছে। পাঠাও : বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং সিস্টেমে এক বিপ্লব বয়ে এনেছে। বর্তমানে এটি নেপালেও সার্ভিস চালু করেছে। অন্যরকম গ্রুপ : উদ্ভাস কোচিং দিয়ে শুরু করে রকমারি.কম, টেকশপ বিডি, অন্যরকম ইলেকট্রনিক্সসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে এই গ্রুপের। চালডাল.কম : নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস হোম ডেলিভারি সার্ভিস দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

বিডিজবস : চাকরির জন্য সবচেয়ে বড় পোর্টাল। আজকের ডিল : ই-কমার্সের বৃহত্তম অনলাইন প্রতিষ্ঠান। শপআপ : সোশ্যাল মিডিয়া এবং মুদি দোকানিদের স্মার্ট বিটুবি প্লাটফর্ম। দেশের শীর্ষ একটি কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান রেডএক্স শপআপের মালিকানাধীন। সম্প্রতি তারা ১০৫ মিলিয়ন ডলার বিদেশী বিনিয়োগ পেয়েছে। টেন মিনিট স্কুল : বাংলাদেশের অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থায় এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। সম্প্রতি টেন মিনিট স্কুল ২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে। সাজগোজে : অথেনটিক বিউটি প্রোডাক্ট সেকশনে লিড করছে।

প্রাভা হেলথ : ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবায় একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। সিন্দাবাদ.কম : হোলসেলে পণ্য কেনার একটি বিটুবি প্লাটফর্ম। হাংরি নাকি : হোম ফুড ডেলিভারি সার্ভিসে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি দারাজ এদেরকে কিনে নিয়েছে। মায়া : ডিজিটাল কাউন্সেলিং ও হেলথ কেয়ার প্লাটফর্ম।

স্টার্টআপ বা নতুন একটি ব্যবসা শুরু করার চিন্তা যখন মাথায় আসে, তখন অনেকেই হাল ছেড়ে দেন। কিন্তু আসলে প্রক্রিয়াটা সহজ। সঠিক আইডিয়া ও পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সব কিছু হাতের নাগালে আনা যায়। নিচে কিছু ধাপ তুলে ধরা হলো, যেগুলো মেনে চললে স্টার্ট আপ শুরু করার পথ সুগম হয়। ১. আইডিয়া : একটি ইউনিক এবং কার্যকরী ব্যবসায়িক আইডিয়া, যা বাজারে একটি নির্দিষ্ট সমস্যা বা প্রয়োজনকে সমাধান করে।

২. গবেষণা এবং সত্যায়ন: আপনার আইডিয়াটি গবেষণা করে নিশ্চিত করা এবং টার্গেট অডিয়েন্স এবং প্রতিযোগিতার বিষয়ে ধারণা লাভ করা। ৩. ব্যবসায়িক পরিকল্পনা: একটি বিস্তারিত ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করা, যাতে আপনার কৌশল, লক্ষ্য, আর্থিক প্রয়োজন এবং পরিচালনা কাঠামো পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকে। ৪. অর্থায়ন : পর্যাপ্ত অর্থ সংগ্রহ করা। যেমন-সঞ্চয়, বিনিয়োগকারী, ঋণ বা ক্রাউডফান্ডিং, যাতে শুরুতেই প্রয়োজনীয় অর্থ থাকে। ৫. টিম : একটি শক্তিশালী এবং বৈচিত্র্যময় টিম গঠন করা, যাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আপনি আপনার ভিশন কার্যকর করতে ব্যবহার করতে পারবেন।

৬. পণ্য উন্নয়ন : একটি প্রোটোটাইপ বা মিনিমাম ভায়েবল প্রডাক্ট (গঠচ) তৈরি করা, যাতে আপনি আপনার ধারণাটি পরীক্ষা করতে পারেন এবং ব্যবহারকারীর প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করতে পারেন। ৭. মার্কেটিং কৌশল : একটি কার্যকর মার্কেটিং কৌশল তৈরি করা, যা আপনার পণ্যকে প্রচার করবে এবং টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছাতে সহায়তা করবে। ৮. নেটওয়ার্কিং : পরামর্শদাতা, মেন্টর এবং শিল্পের যোগাযোগ গড়ে তোলা, যারা আপনাকে সমর্থন ও নির্দেশনা দেবে।

৯. আইনগত কাঠামো : আপনার ব্যবসার জন্য উপযুক্ত আইনগত কাঠামো নির্বাচন করা এবং প্রয়োজনীয় আইনগত প্রয়োজনীয়তা মেনে চলা নিশ্চিত করা। ১০. অ্যাডাপটেবিলিটি: বাজারের প্রতিক্রিয়া ও পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির প্রতি রেসপন্স করা।

স্টার্টআপের শুরুতেই ব্যর্থ হওয়ার কিছু কারণÑ ১. যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা (তাড়াহুড়া করা) : যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে, তাড়াহুড়া করে কাজ করা নতুন ব্যবসা ব্যর্থ হওয়ার একটি অন্যতম কারণ বলে মতামত দিয়েছেন বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা। একটি আইডিয়া মাথায় এলেই তা নিয়ে মার্কেটে নেমে যাওয়াটা বোকামি। ২. টিম মেম্বারদের মাঝে বোঝাপড়ার অভাব : টিমের মাঝে যদি একপেশে চিন্তা ভাবনার কোনো লোক থাকে, (যেমন সবকিছুই সে অ্যাকাউন্টিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করে) তাহলে সেই টিমের সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

৩. লক্ষ্যে অটল না থাকতে পারা ও ধৈর্যের অভাব : লক্ষ্যে অটল না থাকতে পারা নতুন ব্যবসার উদ্যোগ বা স্টার্টআপ ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী। বেশিরভাগই ঝোঁকের মাথায় ব্যবসায় নামেন, কিন্তু সাফল্যের পথ কতটা কঠিন, তা তাঁরা চিন্তা করেন না। এই একটি কারণেই ৫০% এর বেশি স্টার্টআপ ব্যর্থ হয়। ৪. লোভ : লোভ তখনই একটি স্টার্ট আপকে আক্রান্ত করে, যখন তারা দীর্ঘমেয়াদি বা লং টার্ম সাফল্যের বদলে স্বল্পমেয়াদি বা শর্ট টার্ম সাফল্যকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

৫. পরিকল্পনা ও হিসাব রক্ষণের অভাব : একটি নতুন ব্যবসার প্রোডাকশন, মার্কেটিং, সেলস, ঝুঁকি, আয়-ব্যয়Ñ ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে যদি গোছানো পরিকল্পনা না থাকে এবং নিয়মিত এগুলোর হিসেব না নেওয়া হয়, তবে উদ্যোক্তারা যত বড় জিনিয়াস আর দক্ষই হোক- সেই উদ্যোগ সফল হবে না। ৬. ভুল স্বীকার না করা : যে কোনো জিনিস প্রথমবার করতে গেলে ভুল হবেই। ভুল স্বীকার না করাটা একজন উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় ভুল।

পরিশেষে, একটা স্টার্ট আপ শুরু করার প্রক্রিয়াটা সহজ মনে হলেও, প্রতিটি ধাপে চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথমে একটা ভালো আইডিয়া থেকে শুরু করে বাজারের অবস্থা বোঝা, স্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করা, টিমের সহায়তা নেওয়া, আর্থিক ব্যবস্থা ঠিক রাখা, প্রোডাক্ট বা সেবা তৈরি করা, অনলাইন পরিচিতি বাড়ানো, গ্রাহকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা, আইনগত কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করা এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়াÑএই সব ধাপ একসঙ্গে মিললে সফল স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করা যায়।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়