মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৫, ০৮:৪৪

আমার শিক্ষকতা জীবন

মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম
আমার শিক্ষকতা জীবন

আমার নাম মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম। জন্ম এক শান্ত গ্রামীণ পটভূমিতেÑচাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার ডাটরা শিবপুর গ্রামে। শৈশব কেটেছে ধুলোমাটি, পুকুরঘাট আর বাঁশঝাড় ঘেরা এক পরিবেশে, যেখানে অর্থের অভাব ছিল, কিন্তু আদর্শের কোনো কমতি ছিল না।আমার পরিবার ছিল শিক্ষকের পরিবার। আমার বাবা, নানা ও চাচাÑতিনজনই ছিলেন শিক্ষক। তাই শিক্ষার আলো আমাদের বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে খেলা করত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছাত্ররা এসে বাবার কাছে পড়ত, বাবা ঈযধষশ ইড়ধৎফ না নিয়েও যেভাবে বোঝাতেনÑতা ছিল এক জীবন্ত পাঠশালা। আমার দাদা মরহুম ইদ্রিস তপাদার সকাল বেলায় আমাদের উঠানে অসংখ্য কোরআনের ছাত্র পড়াতেন। ছোটবেলায় আমি এ দৃশ্য দেখেই বড় হয়েছি। এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা জন্মে গেছে চেতনায়।

আমাদের আর্থিক অবস্থা কখনো খুব একটা ভালো ছিল না। মোটামুটি ছিলো, কারণ বাবা শিক্ষক। তবু পড়াশোনার ক্ষেত্রে মা-বাবা কোনো আপস করেননি। নতুন জামা না হোক, বই যেন পুরনো না হয়Ñসেই চেষ্টাই ছিল তাঁদের কাছে বড় স্বপ্ন। এ স্বপ্ন নিয়েই আমার শিক্ষাজীবন শুরু।

শুরু থেকে বাংলা ভাষার প্রতি ছিল আমার আলাদা টান। মাধ্যমিক শিক্ষা জীবনে কবিতা আবৃত্তি, রচনার প্রতিযোগিতা, এমনকি প্রশ্নের উত্তর লেখার ধরনেও এক রকম সৃজনশীলতা খুঁজতাম। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ দাশÑএঁদের লেখা পড়তে পড়তে আমি লেখার ভাষা শিখতে শুরু করি।

উচ্চমাধ্যমিকের পর বাংলায় অনার্সে ভর্তি হই। সাহিত্যের গভীরতা, চরিত্র বিশ্লেষণ, সামাজিক প্রেক্ষাপট, ভাষার গঠনÑসবকিছু এতই আকর্ষণীয় লাগত যে মনে হতো, আমি এই পথেই থাকবো। এমএ-তে যেতেই বুঝতে পারি, এই ভাষা কেবল বইয়ের পৃষ্ঠা নয়, একটি আত্মিক পৃথিবী।

বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে অনেকের মতো আমিও পড়েছিলাম পেশা নির্বাচন নিয়ে দ্বিধায়। শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম বটে, কিন্তু সমাজে তখন শিক্ষকতার আর্থিক মর্যাদা কমে আসছিল। তাই সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতিও নিতে থাকি। তবে বাস্তবতা ছিল এমনÑপরিবারের দায়িত্ব, আর্থিক টানাপড়েনÑসব কিছু মিলিয়ে দ্রুত চাকরি দরকার ছিল। ঠিক তখনই বিঘা আহমদিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসায় বাংলা বিভাগের একজন লেকচারার পদে ইন্টারভিউ দেওয়ার সুযোগ পাই। প্রস্তুতি নিই, ইন্টারভিউ দিই। নিয়োগ পেলাম।

প্রথমে ভাবিনি এখানেই থাকবো। কিন্তু ক্লাসে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের সেই চাহনির গভীরতা দেখে আমি বুঝে যাইÑএখানে আমার জায়গা। এই শ্রেণিকক্ষ, এই ছাত্র, এই বোর্ডই আমার জীবনদর্শনের মূলমঞ্চ।

প্রথম ক্লাসে আমার ভয় হচ্ছিল। নিজের ভয় ঢেকে রেখে যখন ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়ালাম, আমার মুখে উচ্চারিত প্রথম বাক্যটির পর ৫০ জোড়া চোখ একসাথে তাকিয়ে রইল আমার দিকেÑসে এক বিস্ময়ের মুহূর্ত।

আমি ধীরে ধীরে পাঠ শুরু করি। কবিতার লাইন, ব্যাখ্যা, সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণৃ ছাত্ররা চুপ করে শুনছিল। শেষে হাত তুলেছিল প্রশ্ন করতে। সে মুহূর্তে মনে হয়েছিল, এই শ্রেণিকক্ষই যেন এক নতুন পৃথিবী, যেখানে আমি একজন নাবিক, যিনি প্রতিটি ছাত্রকে আলোর দিকে চালিয়ে নিচ্ছেন।

সেদিন থেকে ক্লাস রুটিন নয়, ভালোবাসার অনুশীলন হয়ে গেল। নাবিকের ভূমিকায় আজ ২১ বছর। মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা। যিনি সফলতার সাথেই এ পেশায় রেখেছেন।

আমার শিক্ষকতা জীবনের মূল উদ্দেশ্য তিনটিÑ

১. সততার সঙ্গে জ্ঞান পৌঁছে দেওয়া।

২. শিক্ষার্থীদের মনন গঠনে সহায়ক হওয়া।

৩. ভালো মানুষ তৈরির চেষ্টা করাÑসনদধারী নয় কেবল।

আমার সফলতা আমি পরিমাপ করি এইভাবেÑযখন একজন ছাত্র আসে এবং বলে, ‘স্যার, আপনি না থাকলে আমি এই পথে আসতে পারতাম না। আপনার পরামর্শ নিয়ে ভালো ফলাফল করেছি। যখন দেখি ছাত্ররা নিজেরাই কবিতা লিখছে, রচনা করছে, চিন্তা করছেÑতখন বুঝি, আমি ব্যর্থ হইনি।

মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম : সহকারী অধ্যাপক (বাংলা), বিঘা আহমদিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, কাঞ্চনপুর, রামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়