প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৪৬
শূন্যের ভারে ভারাক্রান্ত ফরিদগঞ্জের প্রশাসন
সাতটি দপ্তরে ৪০৩ পদের বিপরীতে শূন্য ১৬৭

ফরিদগঞ্জ উপজেলায় প্রশাসনের প্রায় প্রতিটি দপ্তরের অধিকাংশ পদ শূন্য। এ যেনো শূন্যের ভারে ভারাক্রান্ত ফরিদগঞ্জের প্রশাসন। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে লোক না থাকায় কাজের ব্যাঘাত ঘটছে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন দপ্তর বছরের পর বছর শূন্যপদে লোক চেয়েও পাচ্ছে না বলে এ প্রতিনিধিকে জানায় যথাযথ কর্তৃপক্ষ। স্বল্প সংখ্যক লোকবল নিয়ে কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন কর্মকর্তাগণ। এতে কাজের স্বাভাবিক গতি চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
জানা গেছে, উপজেলার ৭টি দপ্তরে মোট ৪০৩টি পদের বিপরীতে শূন্য পদ ১৬৭টি। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র হলো উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস এবং উপজেলা মৎস্য অফিসের। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাসহ এই অফিসের ৭টি পদই শূন্য। এর মধ্যে একজন ডাক্তারও নেই।
উপজেলা মৎস্য অফিসে ৫টির মধ্যে ৪টি পদই কার্যত শূন্য। সবচেয়ে
ভয়াবহ অবস্থা এই অফিসের। এখানে রাজস্ব পদ ৫টি থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে একজনই অফিস চালাচ্ছেন। এ যেনো এক বনের এক রাজা। বাস্তবতা হলো, তিনি কাজের চাপে রাজা হতে পারেননি। কারণ তাকে পাঁচজনের কাজ একাই করতে হয়। যদিও কাগজে কলমে এখানে ২জন দেখানো হচ্ছে। বাস্তবে অফিসে বার বার গিয়ে একজনকেই পাওয়া যায়। অথচ ফরিদগঞ্জ জেলার মধ্যে মাছ উৎপাদনের স্বর্ণ ভাণ্ডার। বেশ কয়েকবার উপজেলা পর্যায়ে মাছ উৎপাদনে ফরিদগঞ্জ ৪র্থ হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রশাসন এ বিভাগে তেমন একটা গুরুত্বই দিচ্ছে না। যেভাবে মৎস্যচাষীদের পরামর্শ এবং সেবা দেয়ার কথা, তা পারছে না লোকবল সংকটের কারণে। এতো বড়ো একটি উপজেলা ৫জন লোক দিয়ে কভার দেয়া সম্ভব নয়। বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষের ভালো করে ভাবা উচিত বলে মনে করেন উপজেলাবাসী। ৫টির মধ্যে যে ৪টি পদ শূন্য রয়েছে, তা হলো : সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা। কাগজে-কলমে তাকে ফরিদগঞ্জে সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত) দেখানো হলেও তিনি পাবলিক অনুষ্ঠান ছাড়া আসতে পারেন না। তিনি মূলত দায়িত্ব পালন করছেন চাঁদপুরে মৎস্য জরিপ কর্মকর্তা হিসেবে। লোক নেই ক্ষেত্র সহকারী এবং কম্পিউটার অপারেটর কাম কেরানী। অফিস সহকারী একজন যোগদান করে ১০/১২ দিন অফিস করে দীর্ঘ ছুটিতে চলে গেছেন। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা যদি অসুস্থ হন বা ছুটিতে চলে যান, তাহলে ফরিদগঞ্জ মৎস্য অফিস শতভাগ শূন্য হয়ে যাবে।উপজেলা সমাজসেবা দপ্তরের মোট পদ ১৯টি। এর মধ্যে শূন্য পদই ১০টি। শূন্য পদগুলো হলো : সহকারী সমাজসেবা অফিসার, ফিল্ড সুপারভাইজার, উচ্চমান সহকারী যুক্ত হিসাবরক্ষক, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, ইউনিয়ন সমাজকর্মী ২ জন, কারিগরি প্রশিক্ষক ২জন, অফিস সহায়ক ও নৈশ প্রহরী।
উপজেলা কৃষি অফিসে মোট অনুমোদিত পদ ৬২টি। এর মধ্যে শূন্য পদ ২৯টি। অতিরিক্ত কৃষি অফিসারের পদ ১টি, সেটাও শূন্য। কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার পদ ২টি, শূন্য ১টি। উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তার পদ ১টি, সেটাও শূন্য। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা (ব্লক সুপারভাইজার) পদ মোট ৪৬টি, এর মধ্যে শূন্য পদ ২৪টি; অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদ ২টি, শূন্য ১টি; নিরাপত্তা প্রহরী পদ ২টি, শূন্য ১টি। কৃষির মতো মৎস্যের পরিধিও ফরিদগঞ্জে বিশাল। যদিও এখানে মৎস্য বিপ্লব ঘটে শূন্য পরবর্তী দশকে। তবে কৃষির সাথে পাল্লা দিয়ে তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মৎস্য, পোল্ট্রি এবং গবাদি পশু শিল্প।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মোট পদ ২৭৮টির মধ্যে শূন্যপদ রয়েছে ১১০টি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ক'টি পদ রয়েছে, যেখানে কোনো লোকই নেই। যা চিকিৎসা সেবা প্রদানে মারাত্মকভাবে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী) পদটি, যেটি শূন্য। জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন)-এর ১টি পদও শূন্য। জুনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া)-এর ১টি পদ শূন্য। আবাসিক মেডিকেল অফিসার পদ ১টি, কিন্তু সেটিও শূন্য। মেডিকেল অফিসার (সাব সেন্টার) মোট পদ ৪টি, এর মধ্যে ৩টিই শূন্য। সহকারী সার্জন (ইউএইচ এবং এফডব্লিওসি) পদ ১২টির মধ্যে শূন্য পদ ৮টি। একটি হাসপাতাল সত্যিকার অর্থে তখনই হাসপাতাল হয়ে উঠে যখন সে প্রতিষ্ঠানে রোগী, চিকিৎসক এবং চিকিৎসা সেবার উপকরণ থাকে। বিশাল একটি উপজেলার হাসপাতালের চিকিৎসকের এই যদি হয় হাল, তাহলে রোগীদের কি থাকে কোনো তাল? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, হাসপাতাল নিজেই অসুস্থ। এছাড়া অন্য যেসব পদ শূন্য রয়েছে তা হলো : সিনিয়র স্টাফ নার্স পদ ২৫টি, এর মধ্যে শূন্য ৪টি; মিডওয়াইফারী (ইউএইচসি) পদ ৪টি, এর মধ্যে ৩টিই শূন্য; মিডওয়াইফারী (সাব সেন্টার) পদ ৪টির মধ্যে ৪টিই শূন্য; পরিসংখ্যানবিদ পদ ১টির মধ্যে শূন্য ১টি; অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদ ৩টি, শূন্য ১টি; সহকারী সেবক/সেবিকা পদ ১টি, শূন্যও ১টি; স্যানিটারী ইন্সপেক্টর পদ ১টি, শূন্য ১টি; স্যাকমো (সাব সেন্টার) পদ ৪টি, শূন্য পদ ২টি; স্যাকমো (ইউএইচ এবং এফডব্লিওসি) পদ ১২টি, এর মধ্যে শূন্য পদই ৭টি; ফার্মাসিস্ট (ইউএইচসি) পদ ২টি, ১টি শূন্য; ফার্মাসিস্ট (সাব সেন্টার) পদ ৪ টির মধ্যে ৪টিই শূন্য; মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব.) পদ ২টি, শূন্য ১টি; কুষ্ঠ সহকারী পদ ১টি, শূন্যও ১টি; স্বাস্থ্য সহকারীর পদ ৮৯টির মধ্যে শূন্য রয়েছে ৫২টি; সিএইচসিপি পদ ৪১টি, শূন্য ৬টি; ওয়ার্ড বয় পদ ৩টি, শূন্য ১টি; অফিস সহায়ক (সাব সেন্টার) পদ ৪টি, এর মধ্যে শূন্য ২টি; দারোয়ান পদ ২টি, শূন্য পদ ১টি; পরিচ্ছন্নকর্মী পদ ৫টি, শূন্য ২টি। এই হলো ফরিদগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালের জনবল সংকটের চিত্র।
মানুষের হাসপাতালের মতো পশুপাখির হাসপাতালও ভালো নেই। ফরিদগঞ্জে প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের স্বাস্থ্য ভালো নেই। বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত উপজেলার একমাত্র এই হাসপাতালটি। হাসপাতালের ১১ পদের (রাজস্ব) মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ৬টি পদই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। এ প্রতিবেদন যখন লিখা হয় (১৮ আগস্ট ২০২৫), তখন জানা গেলো, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুমন ভৌমিক অলরেডি অফিসিয়ালি রিলিজ নিয়ে নিয়েছেন। ফলে ডাক্তার শূন্য হলো ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস। উপজেলা প্রাণিসম্পদ দফতর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে জনবল সংকট রয়েছে। ফলে পশুপাখির স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন খামারি-উদ্যোক্তারা। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা এই হাসপাতালের। এখানে দীর্ঘদিন ধরে কোনো ডাক্তারই নেই। শূন্যপদ গুলো : ভেটেরিনারি সার্জন (ভিএস) ১ জনের মধ্যে শূন্যও ১জন, উপজেলা লাইভ-স্টক অফিসার (ইউএলএ) পদ ১টি, সেই ১ জনই নেই; কৃত্রিম প্রজনন সহকারী (ভিএফএ) ৩টি পদের মধ্যে রয়েছেন মাত্র ১ জন, ২টিই শূন্য; কম্পাউন্ডার ১টি পদের মধ্যে সেই একজনও নেই। এম.এল.এস.এস. পদ ১টি, শূন্যও ১টি।
উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মোট পদ ৭টির মধ্যে ২টি পদ শূন্য। পদগুলো হলো : সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা। উপজেলা প্রকৌশল বিভাগের মোট পদ ২১টি, এর মধ্যে শূন্য পদ হলো ৬টি। শূন্য পদগুলো হলো : উপ-সহকারী প্রকৌশলী ১টি, ড্রাফটসম্যান (সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার) ১টি, কার্যসহকারী ২টি, অফিস সহায়ক ২টি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুলতানা রাজিয়া বলেন, আগস্ট মাসের জেলা সমন্বয় কমিটির সভায় প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের বিষয়টি উপস্থাপন করেছি। এ বিষয়ে উক্ত সভায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। জেলা প্রশাসক মহোদয় জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করার জন্যে অনুরোধ করেন।