সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৪০

আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অল্প বয়সী ধূমপায়ীদের সংখ্যা-২

কিশোর ধূমপায়ীদের নিরাপদ আস্তানা চায়ের দোকানের পেছনের কক্ষ

মুহাম্মদ আরিফ বিল্লাহ
কিশোর ধূমপায়ীদের নিরাপদ আস্তানা চায়ের দোকানের পেছনের কক্ষ

কিশোর ধূমপায়ীদের নিরাপদ জায়গা বিভিন্ন হাট বাজারের চায়ের দোকানের পেছনের কক্ষ। জেলা উপজেলাসহ দেশের প্রায় সব জায়গাতেই অধিকাংশ চায়ের দোকানে পেছনে একটি কক্ষ রাখা হয়, যেখানে নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে উঠতি বয়সী কিশোরেরা ধূমপানসহ বিভিন্ন ধরনের নেশায় মত্ত থাকে। বাস্তবতা হলো, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশই ধূমপান দিয়ে শুরু করে পরে মাদকের মতো মরণ নেশায় জড়িয়ে পড়ে।

এ অবস্থার কারণে এখন আর চায়ের দোকানে বয়স্ক এবং মার্জিত শ্রেণির মানুষ বেশি একটা যেতে চায় না। কিশোরদের সিগারেটের ধূমায়িত পরিবেশ, মোবাইল গেম খেলা আর বিশ্রী সব কথাবার্তার নোংরা আবহের কারণে মার্জিত শ্রেণির মানুষ স্বাভাবিকভাবে চায়ের দোকানে যেতে পারে না।

অল্প বয়সী ধূমপায়ীদের সংখ্যা বৃদ্ধির আরেকটি কারণ রাজনৈতিক বড়ো ভাইদের আধিপত্য। এলাকার বড়োভাইদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ছোট ভাইদের গ্রুপ যা ইতোমধ্যে সারাদেশে কিশোর গ্যাং নামে পরিচিতি লাভ করেছে, তাদের বেপরোয়া আচরণের কারণে এই গ্রুপটিও চায়ের দোকানের পেছনের কক্ষ দখল করে চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। এসব চায়ের দোকানের পেছনের নির্জন কক্ষে স্কুল-কলেজগামী ছাত্ররা অধিকাংশ সময়ই ধূমপানে লিপ্ত হয়। যার ফলে এখানে শিক্ষক বা বয়োজ্যেষ্ঠদের আনাগোনা বাধ্য হয়ে কমে গেছে।

চায়ের দোকানের পেছনে কক্ষ রাখার বিষয়ে কথা হয় মতলব বাজারের চায়ের দোকানি শফিকুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান, পেছনে কক্ষ তৈরি করার পর দোকানে বিক্রি বেড়েছে। অল্প বয়সী ছেলেরা বিভিন্ন কোমল পানীয় পান করে থাকে। সিগারেট, চানাচুর, বিস্কুটসহ নানা ধরনের পণ্য তাদের কাছে বিক্রি করা যায় বলে তিনি জানান। চায়ের দোকানি শফিকুল ইসলামের মতে, বয়স্কদের কাছে এতো কিছু বিক্রি করা যায় না।

আমাদের সন্তানরা বিপথগামী হচ্ছে এমন প্রশ্ন করলে দোকানদার বলেন, আমাদের তো কিছু করার নেই। আমি বিক্রি না করলে আরেকজন করবে। তাই এ ব্যাপারে ধূমপান সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার।

অল্প বয়সী ধূমপায়ীরা চায়ের দোকানের পেছনের কক্ষ ছাড়াও গ্রাম বা শহরের নির্জন জায়গা, পরিত্যক্ত ভবন বেছে নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে নীরব স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ। ফলে বেপরোয়া হচ্ছে কিশোর গ্যাং এবং অল্প বয়সী ধূমপায়ীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীর একজন অভিভাবক বলেন, “আমি আমার সন্তানের কাছে অসহায়। যে এখনো এসএসসির গণ্ডি পার হয়নি। তার চলন বলন আমাকে বিব্রত ও লজ্জিত করে তুলেছে।” এর জন্যে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শাসনের অভাব, স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি, সিগারেট ও মাদকের সহজলভ্যতা, পারিবারিক বন্ধনের ঘাটতি ইত্যাদিকে দায়ী করেন।

গ্রাম শহর সব জায়গায় ঘুরে দেখা গেছে অল্প বয়সী ধূমপায়ীদের একটা বিরাট অংশ শ্রমিক শ্রেণির। এদের উপার্জিত অর্থের একটা বড়ো অংশ ধূমপানের পেছনে ব্যয় হয়ে যায়। ফলে তারা তাদের দৈনন্দিন জীবন ধারণের ব্যয় মেটাতে হতাশায় ভোগে। কিন্তু হিসেব করে দেখে না শুধুমাত্র ধূমপান করে মাসে কতো টাকা জ্বালিয়ে দিচ্ছে।

ধূমপানে অল্প বয়সীদের আসক্তি বিষয়ে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লোটাস-বাড চ্যারিটি ফোরামের উপদেষ্টা তরুণ শিক্ষানুরাগী জিসান আহমেদ বলেন, সিগারেট ও মাদকের অবাধ সরবরাহ, অভিভাবকদের অসচেতনতা, সামাজিক প্রতিরোধের অভাব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের শাসনের ক্ষমতা সীমিতকরণ, বন্ধুদের সাথে বাধাহীন আড্ডা ইত্যাদি অল্প বয়সীদের ধূমপানের উল্লেখযোগ্য কারণ।

এছাড়া মিডিয়ায় ধূমপানের প্রচার এবং অভিনয় শিল্পীদের অনেকের ধূমপান নিয়ে স্টাইলিস্ট আচরণ তরুণদের ধূমপানে আকৃষ্ট করে। এক প্রশ্নের জবাবে জিসান আহমেদ বলেন, ধূমপান প্রতিরোধে পারিবারিক, সামাজিক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আন্দোলন তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন রাষ্ট্র তামাক উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

মতলব দক্ষিণ উপজেলার নারায়ণপুর ডিগ্রি কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক শাহিনুর আক্তার বলেন, করোনাকালীন সময়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপাদানগুলো ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করে। প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প বিপ্লবের প্রচারণা এবং একই সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থী এবং অল্প বয়সীরা অলস সময়টাকে নেতিবাচক কাজে ব্যয় করার সুযোগ পায়। ফলে এই শ্রেণি ব্যাপকভাবে ধূমপানে জড়িয়ে যায়।

তিনি কর্মব্যস্ত পিতা-মাতার সন্তানের প্রতি যথাযথ নজরদারির অভাবকেও এর জন্যে দায়ী করেন। যার ফলে নষ্ট হচ্ছে পারিবারিক শ্রদ্ধাবোধ, ভেঙ্গে যাচ্ছে সামাজিক ভারসাম্য।

আমাদের প্রজন্মের সুরক্ষায় শিক্ষাসহ সুস্থ সামাজিক ও বাণিজ্যিক পরিবেশ বজায় রাখতে চায়ের দোকানসহ সম্ভাব্য যে সকল স্থানে তরুণ- তরুণীরা ধূমপান ও মাদকের মতো মরণ নেশায় জড়ানোর সুযোগ পেতে পারে, সেসব স্থান চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ করা আবশ্যক।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়