বৃহস্পতিবার, ০১ মে, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

ঈদুল ফিতরের ফজিলত ও তার করণীয় বর্জনীয়

মুফতি মোহাম্মদ মাছুম বিল্লাহ বাগদাদী

ঈদুল ফিতর কী?

ঈদ ও ফিতর শব্দ দুটি আরবি, যার অর্থ হচ্ছে উৎসব, আনন্দ, খুশি, রোজা ভেঙ্গে ফেলা ইত্যাদি। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগির পর মুসলিম উম্মাহ শাওয়াল মাসের চাঁদের আগমনে রোজা ভেঙ্গে আল্লাহর বিশেষ শোকরিয়াস্বরূপ যে আনন্দ-উৎসব পালন করেন-শরিয়তের পরিভাষায় তাই ঈদুল ফিতর।

ঈদের আনন্দের কারণ কী?

ঈদ আনন্দ। কিন্তু সেই আনন্দ কেন? এমনি এমনিতেই কী কেউ আনন্দিত হয় না। হয়, যখন আনন্দের কিছু ঘটে। পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলে আনন্দিত হয়। কঠিন কোনো কাজ সহজেই সমাপ্ত করতে পারলে আনন্দিত হয়। পুরস্কৃত হলে আনন্দিত হয়। আনন্দের জন্যে তো কোনো কারণ থাকতে হবে! এক মাস রোজার পর এদিনে সেই সাধনার পুরস্কার হিসেবে ক্ষমাপ্রাপ্তিই সেই আনন্দের কারণ।

হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, বায়হাকি শরীফ-৩/৩৪৩

ঈদুল ফিতরের সূচনা :

হযরত আনাস বিন মালিক (রাঃ) বলেন, প্রতি বছর মুশরিকদের জন্যে দুটি দিন ছিল, সেদিন তারা আনন্দ-উৎসব করতো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় আসেন তখন তিনি বলেন, তোমাদের ঐ দুটি উৎসবের চেয়ে আরও উত্তম দুটি আনন্দের দিন দেয়া হলো। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা।

(সুনানে নাসায়ি, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নম্বর-১৭৭, সুনানে আবু দাউদ, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নম্বর-১৬১, হাদিস নম্বর-নম্বর-১১৩৬)।

ঈদের দিনের ফজিলত :

আল আনসারী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঈদুল ফিতরের দিন সকালে সকল ফেরেশতা রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, হে মুসলিমগণ! তোমরা দয়ালু প্রতিপালকের দিকে এগিয়ে আসো। উত্তম প্রতিদান ও বিশাল সাওয়াব প্রাপ্তির জন্যে এগিয়ে আসো। তোমাদের রাত্রিবেলার নামাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশ মেনে নামাজ পড়েছ। তোমাদেরকে দিনগুলোতে রোজা রাখতে বলা হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশও পালন করেছ, এক মাস রোজা রেখেছ। গরিব দুঃখীদের পানাহারের মাধ্যমে নিজ প্রতিপালককে তোমরা পানাহার করিয়েছ।

এখন নামাজ পড়ার মাধ্যমে সেগুলোর প্রতিদান ও পুরস্কার গ্রহণ কর। ঈদের নামাজ পড়ার পর ফিরিশতাদের মাঝে একজন ঘোষণা দেন, শোন, নামাজ আদায়কারীরা! তোমাদেরকে মহান রাব্বুল আলামীন ক্ষমা করে দিয়েছেন, সকল গুনাহ থেকে মুক্ত অবস্থায় নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাও।

আর শোন! এ দিনটি হচ্ছে পুরস্কার প্রদানের দিন। আকাশে এ দিনের নামকরণ করা হয়েছে পুরস্কারের দিন (আল মুজামুল কাবীর লিত তাবারানী, হাদিস নম্বর-৬১৭ ও ৬১৮)।

ঈদের দিন রোজাদারকে ক্ষমা ঘোষণা :

হযরত আনাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা ঈদের দিন ফেরেশতাদের মাঝে রোজাদার নিয়ে গর্ব করে বলেন, হে ফেরেশতারা আমার কর্তব্যপরায়ণ প্রেমিক বান্দার বিনিময় কী হতে পারে? ফেরেশতারা বলেন, হে প্রভু পুণ্যরূপে পুরস্কার দান করাই তো তার প্রতিদান। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব (রোজা) পালন করেছে। অতএব, দোয়া করতে করতে ঈদগাহে গমন করেছে। আমার মর্যাদা, সম্মান, দয়া ও বড়ত্বের কসম আমি তাদের দোয়া কবুল করব এবং তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। (বায়হাকি, ৩/৩৪৩)।

ঈদের রাতের ফযীলত :

যে সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখা যায় সে রাতকে ঈদের রাত বলা হয়। এ রাতের অনেক গুরুত্ব ও ফযিলতের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কয়েকটি হাদীস নি¤েœ তুলে ধরা হলো :

১. হযরত আবু উমামা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বর্ণনা করেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে আল্লাহর নিকট সাওয়াব প্রাপ্তির নিয়তে ইবাদত করবে তার হৃদয় সেদিনও জীবিত থাকবে যেদিন সকল হৃদয়ের মৃত্যু ঘটবে। (ইবনু মাজাহ, হাদিস নম্বর-১৭৮২, আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নম্বর-১৫৯)।

২. হযরত উবাদাতা ইবন সামিত রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার রাতকে (ইবাদতের মাধ্যমে) জীবিত রাখবে তার দিল ঐ দিনও মরবে না যেদিন অন্যদের দিল মরে যাবে। (আত তারগীব ওয়াত তারহীব,২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৯৮,হাদীস নম্বর-১৬৫৭)।

৩. হযরত মাআয ইবন জাবাল রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি পাঁচটি রাত (ইবাদতের মাধ্যমে) জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।

(এক). যিলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখ রাত, (দুই). যিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখ রাত, (তিন). ঈদুল আযহার রাত, (চার). ঈদুল ফিতরের রাত এবং (পাঁচ). ১৫ শাবানের রাত। (আত তারগীব ওয়াত তারহীব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৯৮,হাদিস নম্বর-১৬৫৬)

ঈদের দিনের সুন্নাতসমূহ :

১. অন্যদিনের তুলনায় সকালে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। (বায়হাকী, হাদীস নম্বর-৬১২৬)

২. মিসওয়াক করা। (তাবয়ীনুল হাকায়েক-১/৫৩৮)

৩. গোসল করা। হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই ঈদের দিন গোসল করতেন। (মুসনাদে বাযযার, হাদিস নম্বর-৩৮৮০)

ইবনে উমর রাদিআল্লাহুতাআলা আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক,হাদিস নম্বর:- ৬০৯)

৪. শরীয়তসম্মত সাজসজ্জা করা। (বুখারী শরীফ-হাদীস নম্বর-৯৪৮)

৫. সামর্থ্য অনুপাতে উত্তম পোশাক পরিধান করা। ইবনে উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি দু ঈদের দিনে সুন্দরতম পোশাক পরিধান করতেন। (বায়হাকী শরীফ হাদিস নম্বর-১৯০১)

৬. সুগন্ধি ব্যবহার করা। (মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নম্বর-৭৫৬০)

৭. ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাবার আগে মিষ্টিজাতীয় যেমন-খেজুর ইত্যাদি খাওয়া। তবে ঈদুল আযহাতে কিছু না খেয়ে ঈদের নামাজের পর নিজের কুরবানির গোশত আহার করা উত্তম। বুরাইদা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের নামাজের পূর্বে খেতেন না। সালাত থেকে ফিরে এসে কুরবানির গোশত খেতেন (আহমদঃ-১৪২২)

আনাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন কয়েকটি খেজুর না খেয়ে বের হতেন না, আর খেজুর বে-জোড় সংখ্যায় খেতেন। (বুখারী শরীফ, হাদিস নম্বর-৯০০)

৮. সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া। (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস নম্বর-১১৫৭)

৯. ঈদুল ফিতরে ঈদগাহতে যাওয়ার পূর্বে সাদকায়ে ফিতর আদায় করা। হযরত ইবনু উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদেরকে ঈদের নামাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই সাদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দেন (বুখারী শরীফ,হাদীস নম্বর-১৪২১)

১০. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। হযরত আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত,

তিনি বলেন, সুন্নাত হলো ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া। (তিরমিযী শরীফ,হাদিস নম্বর১৮৭ )

১১. ঈদের নামায ঈদগাহে আদায় করা, বিনা অপারগতায় মসজিদে আদায় না করা (বুখারী শরীফ,হাদীস নম্বর-৯৫৬, আবু দাউদ,হাদীস নম্বর-১১৫৮)

১২ .যে রাস্তায় ঈদগাতে যাবে, সম্ভব হলে ফিরার সময় অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরা। (বুখারী শরীফ, হাদীস নন্বর-৯৮৬)

১৩. ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাবার সময় আস্তে আস্তে এই তাকবীর পড়তে থাকা : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।

তবে ঈদুল আযহায় যাবার সময় পথে এ তাকবীর আওয়াজ করে পড়তে থাকবে (মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নম্বর-১১০৫)

“ঈদ মুবারাক” বলা হয়। এর শরয়ী বিধান ঈদের দিন আনন্দ প্রকাশ করা, দান সাদকা করা ও মুবারাকবাদ জানানো মুস্তাহাব। তবে মুবারাকবাদ জানানোর জন্য"ঈদ মোবারাক"শব্দ নির্ধারণ করা, একই শব্দ সবসময় ব্যবহার করা, বা "ঈদ মুবারাক" শব্দটি দিয়েই মুবারাকবাদ জানাতে হবে এমন মনে করা ঠিক নয়। তা মাকরুহ হবে, কেউ কেউ বিদআত বলেছেন। তাই সতর্ক থাকা উচিত ৷

উচ্চারণ-তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম, ঈদুকুম মুবারাক, ঈদুন সাঈদুন। এ ধরনের শব্দ দিয়ে মুবারাকবাদ জানানো যাবে। মোবারাকবাদের স্বপক্ষে সাহেবে হুলিয়া সহিহ সনদে অনেক আসারে সাহাবা এনেছেন। যার দ্বারা বুঝা যায় তা সাহাবাগণ থেকে প্রমাণিত। তাই তা মুস্তাহাব। ফতহুল বারী২/৪৪৬,রদ্দুল মুহতার,১/৭৭৭, ফাতওয়ায়ে রহিমিয়া ১/২৮১৷

ঈদের দিনে কিছু করণীয়:-

ক) নিজ পরিবার-পরিজনের সাথে সময় অতিবাহিত করা এবং উত্তম উপদেশ দেয়া। যা পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে।

খ) আত্মীয়-স্বজন, মাতা-পিতার সাথে দেখা করা ও খোঁজ-খবর নেয়া।

গ) পাড়া প্রতিবেশী, গরীব-অসহায় নির্বিশেষে সকলের সাথে মিশা, তাদের খোঁজ খবর নেয়া ও কুশল বিনিময় করা।

ঘ) সম্ভব হলে পরস্পরকে দাওয়াত দেয়া এবং আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা।

ঙ) ঝগড়া, বিবাদ, কলহ, হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে সবার সাথে মুলাকাত আলিঙ্গন ও একাকার হয়ে যাওয়া।

চ) জীবন মানে সময়ের যোগফল। অর্থহীন কাজে সময় ব্যয় করা ও টিভির অনুষ্ঠান দেখার নামে মূল্যবান জীবন শেষ করা থেকে বিরত থাকা ও বিরত রাখা। বিশেষ করে নিজেকে ও নিজের পরিবার পরিজনকে।

ঈদের দিনের বর্জনীয় দিকসমূহ :

১. জামাআতের সাথে ফরজ সালাত আদায়ে অলসতা করা

২. ঈদের দিন সিয়াম পালন করা

৩. বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন করা

৪. নারী-পুরুষ একে অপরের বেশ ধারণ করা

৫. নারীদের খোলামেলা অবস্থায় রাস্তাঘাটে বের হওয়া

৬. গান-বাজনা করা, অশ্লীল সিনেমা ও নাটক দেখা

৭. অযথা কাজে সময় ব্যয় করা

৮. অপচয় ও অপব্যয় করা

৯. আতশবাজি করা

১০. ঈদের সালাত আদায় না করে কেবল আনন্দ-ফূর্তি করা ইত্যাদি। পরিশেষে বলতে চাই, ঈদের দিনের শরীয়তসম্মত করণীয়গুলো পালন করার মাধ্যমে নিজেকে ধর্মীয় অনুভূতি সম্পন্ন একজন প্রকৃত মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলা এবং সামাজিক,পারিবারিক ও রাষ্ট্রে শান্তি, শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করা।

লেখক : মুহাদ্দিস, দাসাদী ডিএসআইএস কামিল মাদ্রাসা। মোবাইল ফোন : ০১৭২৩৩৯১৭১৯

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়