প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:২১
৪৮ বছরের গৌরব নিয়ে চাঁদপুরের ক্রীড়াঙ্গনে আলোচিত ক্লাব নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্র

১৯৭৮ সালে চঁাদপুর জেলা শহরের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়িক এলাকা পুরাণবাজারের নিতাইগঞ্জ এলাকায় একঝঁাক তরুণ মেধাবী ফুটবলারের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্র। প্রয়োজনীয় ক্রীড়া সরঞ্জাম ও সুযোগ-সুবিধার অভাব থাকলেও ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাকে পুঁজি করে এগিয়ে যেতে থাকে ক্লাবটি। দীর্ঘ প্রায় ৪৮ বছর পেরিয়ে ছোট্ট উদ্যোগের সেই প্রতিষ্ঠানটি এখন চঁাদপুরের ক্রীড়াঙ্গনে আলোচিত একটি ক্রীড়া ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। পাড়ার এ ক্লাবটি প্রতিষ্ঠার প্রধান কারিগর শহরের পরিচিত মুখ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জসিম উদ্দিন খান বাবুল। ছাত্রজীবনে ছিলেন ফুটবল খেলোয়াড়। চাচাতো ভাই সেলিম খান, বন্ধু মহলের স্বপন নন্দী, নারায়ণ স্টোরের গোবিন্দ সাহা, তারা বিড়ির মরহুম মিজান খান, পি আর্টের রামচন্দ্র দেসহ অন্যদের নিয়ে ফুটবল খেলেছেন এবং সেই সুবাদে এই ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেন বাবুল খান। তিনি এ ক্লাবেরই দীর্ঘবছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ক্লাবের সভাপতি বাবুল খানের ছোট ভাই, সাবেক জাতীয় দলের ফুটবলার মহিউদ্দিন খান বোরহান এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে ক্লাবের খেলাধুলা চালিয়ে নিচ্ছেন জাতীয় লীগের প্রথম বিভাগের সাবেক ফুটবল খেলোয়াড় মো. আনোয়ার হোসেন মাঝি। তঁারা দুজন নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্রেরই নিয়মিত ফুটবল ও ক্রিকেটার ছিলেন।খেলোয়াড় থেকে এখন হয়েছেন কর্মকর্তা।
জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে লীগ-টুর্নামেন্টের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বেশ দাপটের সাথে নিজেদের ক্লাবের সুনাম ও অবস্থান সুদৃঢ় করেছে নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্র। প্রাচীন চঁাদপুর শহরের ১ নং ওয়ার্ডস্থ নিতাইগঞ্জ রোডের নামে নামকরণ করা হয় এই ক্লাবের। ক্লাবটির বড়ো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ফুটবল, ক্রিকেট এবং ব্যাডমিন্টনে নিজস্ব খেলোয়াড় নিয়ে জেলা পর্যায়ের লীগ-টুর্নামেন্টে ধারাবাহিকভাবে অংশগ্রহণ করা। সেই সুবাদে চঁাদপুর স্টেডিয়াম সৃষ্টি হবার পর থেকে (যখন টিনের বেড়া ছিলো) জেলা ক্রীড়া সংস্থার তালিকাভুক্ত ক্লাব এটি। চঁাদপুর জেলা ফুটবল ও ক্রিকেট ইতিহাসে রেখেছে উল্লেখযোগ্য অবদান।একবার ডিসি কাপ ফুটবলে নতুন বাজার ক্রীড়া চক্রকে ৭-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতা এবং জেলা ক্রিকেট লীগে তিনবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড রয়েছে নিতাইগঞ্জ ক্লাবের।
এ ক্লাবটি শুধু ক্রীড়াঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনও ধরে রেখেছে। এজন্যে একের ভেতর তিন। অর্থাৎ নিতাইগঞ্জ ক্রীড়াচক্রের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় অনুপম নাট্য গোষ্ঠী ও শতদল সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা। নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্রের এই তিনটি সংগঠন এক জায়গা থেকে পরিচালিত হতো। নতুনভাবে তাদের যোগ হয়েছে আরেকটি প্রতিষ্ঠান অনুপম মিলনায়তন।
সেই ১৯৭৮ সাল থেকে অদ্যাবধি চঁাদপুরের ফুটবল ও ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করে আসছে এ ক্লাবটি। চঁাদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়মিত পারফরম্যান্স করছে গোবিন্দ মন্ডলের মাধ্যমে অনুপম নাট্যগোষ্ঠী। নিতাইগঞ্জ রোডের আলী বিড়ি ফ্যাক্টরির পেছনে পুরাণবাজার সাধনা ঔষধালয়ের পাশে ভাড়ার মাধ্যমে ছোট্ট একটি ঘরে নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্রের কার্যক্রম শুরু হয়। এখানেই পাড়ার ছেলেদের নিয়ে অনুপম নাট্য গোষ্ঠী ও শতদল সাংস্কৃতিক সংগঠনের নাটক, গান-নৃত্য চর্চা হতো। চঁাদপুর আবাহনী ক্রীড়া চক্র, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, বিষ্ণুদী ক্লাব, নতুন বাজার ক্রীড়া চক্র, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সংসদসহ স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন দলের সঙ্গে খেলে আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ক্লাবটি দেশের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে নজরকাড়া পারফরম্যান্স দেখায়। এছাড়া জাতীয় লীগে খেলেছেন এই ক্লাবের অনেক খেলোয়াড়।
ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জসিম উদ্দিন খান বলেন, খেলোয়াড়দের ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ এবং শৃঙ্খলা ও চরিত্র গঠনের প্রতি বিশেষ জোর দেয়ার কারণেই নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্র নিজস্ব খেলেয়াড়দের নিয়ে খেলাধুলায় অংশ নিতো। আমি নিজেও এক সময় ফুটবল খেলোয়াড় ছিলাম। বাসা থেকে বের হলেই সামনের রাস্তা নিতাইগঞ্জ রোড। বাবা মরহুম হাজী আব্দুর রশিদ খান বাজারের বড়ো ব্যবসায়ী ছিলেন। আমাদের নিজস্ব ঘরগদি এখনও রয়েছে। লেখাপড়া, খেলাধুলা, এরপর বন্ধু মহলসহ আমরা পাড়ার ছেলেরাই এই ক্লাব গঠন করি। এ ক্লাবের পাশাপাশি অনুপম নাট্য গোষ্ঠী এবং শতদল সাংস্কৃতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করি। আমাদের নাট্য দলে ছিলেন স্বপন নন্দী, প্রয়াত শম্ভু আচার্যী, শুক্কুর বেপারী, ভারতী মন্ডল, গোবিন্দ মন্ডল, সত্য মন্ডলসহ স্থানীয়ভাবে অনেক শিল্পী। সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে ছিলেন শীতল ঘোষাল, অনিমা সেন, মনু মাস্টার, গোলাম মোস্তফাসহ আরো অনেকে।
ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার মাঝি বলেন, নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্র আমাদের প্রাণের ক্লাব।ছাত্রজীবন থেকে ক্লাবের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমরা যারা ফুটবল-ক্রিকেট খেলতাম, যেমন পার্থ সারথী, গোবিন্দ সাহা, হারু ঘোষ, পূর্ব শ্রীরামদীর মঞ্জু, লোহারপুলের বাদল, গোলকিপার জয়নাল আবদীন জনু, অর্জুন নাগ, অসীম মিশ্র, রাখাল, জনতা আইসক্রিমের নাসির, পশ্চিম শ্রীরামদীর শম্ভু, বোরহান খান ও আমি (আনোয়ার মাঝি) সহ আরো অনেকের এই ক্লাবের মাধ্যমে ফুটবলে হাতে খড়ি। পাশাপাশি ফুটবল এবং ব্যাডমিন্টনও খেলেছি। ক্লাব কর্মকর্তা হিসেবে সালেহ আহম্মদ, হাবিবুর রহমান কুট্টি ও সাবেক পৌর কমিশনার বিল্লাল খান।
ক্রিকেটের ম্যানেজার ছিলেন সুমন। সঞ্জয় চন্দ্র দাস সুমন, প্রদীপ সাহা ও জুট মিল এলাকার আলআমিন নিতাইগঞ্জের প্লেয়ার। এছাড়া ক্লাবের অনেক সদস্য ছিলেন। জন্ম থেকেই আমাদের ক্লাবটিকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বড়োভাই বাবুল খান। আমাদের ক্লাবের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। স্টেডিয়ামে সোনালী অতীত ক্লাবের সাথে নিতাইগঞ্জ ক্লাবের নামে দোকানঘর রয়েছে। আশা করছি, অনুপম মিলনায়তনের জায়গার পাশে আমরা আমাদের ক্লাবঘর নির্মাণ করবো। পাশাপাশি ক্রীড়া সংস্থার ইভেন্টগুলোতে অংশগ্রহণ চলতে থাকবে।
আনোয়ার মাঝি বলেন, মাঠে যেদিন নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্রের খেলা থাকতো, সাধারণ দর্শকদের উপস্থিতি থাকতো চোখে পড়ার মতো। ফুটবল এবং পরবর্তীতে ক্রিকেটে আমরা টিম স্পিরিট নিয়ে মাঠে যেতাম। তার আগে আমাদের টিমের খেলোয়াড়রা নিয়মিত চর্চা, প্রশিক্ষণ নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে যেতো। আশা করছি, আমরা অতীতের মতো এবারও সাফল্য অর্জনে ক্লাব কার্যক্রমকে এগিয়ে নেবো।
নিতাইগঞ্জ ক্লাবের প্রাক্তন ফুটবলার এবং ক্রিকেটার গোবিন্দ সাহা বলেন, প্রথম থেকেই এই ক্লাবটি পরিচালনা করতেন বাবুল খান। আমি আমার এলাকার দক্ষিণ বাজারের একটি ক্লাবের প্লেয়ার ছিলাম। বাবুল খান আমাকে নিতাইগঞ্জ ক্লাবে খেলার জন্যে অফার করেন। তখন আমি ছিলাম মোতালেবের ট্রেনিংপ্রাপ্ত ফুটবলার। লোকাল প্লেয়ার হিসেবে আমরা সবাই একত্রে খেলতাম। নতুন বাজার বা অন্য জায়গার প্লেয়ার দরকার পড়তো না, শুধু পুরাণবাজার থেকে আমাদের ১১ জন প্লেয়ার হয়ে যেতো। তিনি বলেন, আমাদের টিম এতো সুন্দর ফুটবল ক্রিকেট খেলতো, যে কোনো দলের সাথে খেলা হলে আমরা ভালো কিছু করার চেষ্টা করতাম। ওই সময় যথেষ্ট দর্শক আমাদেরকে উৎসাহিত করতো এবং আনন্দ পেতো। চঁাদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার লিগ টুর্নামেন্টে নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্রের অংশগ্রহণ বেশ সুনাম বয়ে আনতো। এখন বয়স হয়েছে, কর্ম ও পারিবারিক জীবন নিয়ে সবাই ব্যস্ত। আমাদের সময়কালের মতো তরুণরা খেলাধুলায় এখন তেমন আগ্রহী হয়ে উঠছে না। এজন্যে নিজস্ব খেলোয়াড়ও তৈরি হচ্ছে না। নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্র আমাদের মতো তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে আগের সুনাম ধরে রাখবেÑএটাই প্রত্যাশা।








