মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১৮

একান্ত সাক্ষাৎকারে সঁাতারু বাদল মজুমদার

পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতায় সাঁতার থেকে নতুন প্রজন্ম বিমুখ হচ্ছে

গোলাম মোস্তফা
পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতায় সাঁতার থেকে নতুন প্রজন্ম বিমুখ হচ্ছে

চঁাদপুরে এককালের কৃতী সঁাতারু বাদল মজুমদার। ২০১২ সালে তঁার আগ্রহে ও অন্যান্য সঁাতারুর ঐকান্তিকতায় চঁাদপুরের সকল সঁাতারুর কমন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে চঁাদপুর সঁাতার পরিষদ নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যে সংগঠনটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা চঁাদপুর আউটার স্টেডিয়ামের অরুন নন্দী সুইমিং পুলটি জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে মাসিক ভাড়া নিয়ে সঁাতার প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়। যেখানে শিশু-কিশোররা জীবন বঁাচানোর প্রয়োজনে সঁাতার শেখার সুযোগ পায়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অদ্যাবধি বাদল মজুমদার এ সংগঠনের সাধারণ সস্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। স্টুডিও ব্যবসার মাধ্যমে তঁার পেশাগত জীবন শুরু হলেও বর্তমানে তঁার পেশা ফটো সাংবাদিকতা। তিনি ফটো সাংবাদিকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন চঁাদপুর জেলা শাখার সভাপতি হিসেবে কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দৈনিক চঁাদপুর প্রবাহে তঁার কর্মজীবন শুরু করলেও বর্তমানে চঁাদপুর কণ্ঠে কর্মরত আছেন। তিনি ফোকাস বাংলার জেলা প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেছেন।

একজন সঁাতারু ও সঁাতার সংগঠক হিসেবে দৈনিক চঁাদপুর কণ্ঠের ক্রীড়াকণ্ঠ বিভাগ থেকে তঁার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। নিচে সেটি পত্রস্থ করা হলো :

ক্রীড়াকণ্ঠ : স্টুডিও’র ব্যবসা করেছেন বলেই ফটো সাংবাদিক হয়েছেন? কেমন কাটছে দিনকাল?

বাদল মজুমদার : হ্যঁা, একসময় স্টুডিও ব্যবসার পাশাপাশি ভিডিও ব্যবসা করতাম। দৈনিক চঁাদপুর প্রবাহের কোনো এক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তৎকালীন সময়ে পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা মরহুম শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম আমাকে অনুষ্ঠানের সকল ছবি তোলার জন্যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি আমার ছবি দেখে মুগ্ধ হন। এক পর্যায়ে তিনি পত্রিকাটির ফটো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার জন্যে বললে তাতে আমি সাড়া দেই। এভাবে ফটোসাংবাদিক হিসেবে যাত্রা শুরু করি। সেই থেকে আজো আছি এই পথে।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনি একজন সঁাতারু ছিলেন। সঁাতারে আপনার উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের কথা মনে পড়ে কি? সেগুলো কী কী?

বাদল মজুমদার : সবকিছু মনে না থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে আছে। আমি ছাত্রজীবনে উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াবস্থায় একজন কৃতী সঁাতারু হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম হয়েছি। তৎকালীন সময় প্রতি বছর শিক্ষা বোর্ড গুলো এবং জাতীয় পর্যায়ে স্কুল ও কলেজের প্রতিযোগিতা ছিলো নিয়মিত। সে কারণে প্রথমেই নিজ বিদ্যালয় ডিএন উচ্চ বিদ্যালয়ের সঁাতারু হিসেবে তৎকালীন মহকুমায় ও জেলায় নিজের কৃতিত্বের জন্যে কয়েকবার পুরস্কৃত হয়েছি। এক পর্যায়ে আন্তঃ স্কুল সঁাতার প্রতিযোগিতায় তৎকালীন মহকুমা পরবর্তীতে জেলা পর্যায়ে সঁাতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে চঁাদপুরের মুখ বারবার উজ্জ্বল করেছি। শুধু তাই নয়, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের হয়ে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সঁাতারে অংশগ্রহণ করে কৃতিত্ব অর্জন করেছি। ১৯৮৩ সালে ডিএন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় কুমিল্লা বোর্ডের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন, পরবর্তীতে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সহায়তায় জাতীয় পর্যায়ে সঁাতার প্রতিযোগিতায় রৌপ্য পদক লাভ করি। ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে চঁাদপুর সরকারি কলেজ জাতীয় পর্যায়ে সঁাতারে যে সুনামটি অর্জন করে , সেটি আমার আমার কারণেই হয়। সে সময় সঁাতারের ছয়টি ইভেন্টের মধ্যে আমি ছয়টিতে অংশগ্রহণ করি। তন্মধ্যে ৫টি সঁাতারে জাতীয় পর্যায়ে ব্রোঞ্জ পদক ও একটি সঁাতারে রৌপ্য পদক লাভের মধ্য দিয়ে আন্তঃকলেজ সঁাতার প্রতিযোগিতায় চঁাদপুর সরকারি কলেজ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। চঁাদপুর শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সড়কস্থ বর্তমান রেলওয়ে লেকটিতে ২৪ ঘন্টা সঁাতার করার রেকর্ড অর্জন করেছি। যার আয়োজক ছিলো তৎকালীন জেলা প্রশাসন। এ সময় চঁাদপুরে যারা সঁাতারু ছিলেন তারা সকলেই ডাকসাইটে সঁাতারু ছিলেন। আমি নিজে প্রায় ১০ বছর একটানা সঁাতারের কারণে আঞ্চলিক ও বিভাগীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করার জন্যে ডাক পেতাম। অবশ্য এ জন্যে তৎকালীন সময়ে সঁাতার চর্চা অব্যাহত রেখেছি। এছাড়াও চঁাদপুর শহরের ইচলী ঘাট থেকে শহরের বড় স্টেশন ডাকাতিয়া ও মেঘনার মিলনস্থল পর্যন্ত দূরপাল্লার সঁাতারে আমার আরেকটি কৃতিত্ব আছে। চঁাদপুর শহরের চারজন বাসিন্দা আমরা ছোট এবং বড়োভাইরা মিলে এ সঁাতারে অংশগ্রহণ করি। এঁদের মধ্যে রয়েছেন আমার দুজন শ্রদ্ধেয় বড়োভাই আশীষ কুমার লোধ ও তপন চন্দ। মূলত এ দুজনের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আমার তৎকালীন সময়ে সঁাতারে সুনাম বা কৃতিত্ব অর্জন করা। সে সময় শিক্ষা বোর্ডগুলো প্রতিবছর বয়সভিত্তিক সঁাতার নিয়মিত আয়োজন করতো। শুধু তাই নয়, তৎকালীন সময়ে জেলা পর্যায়েও সঁাতার প্রতিযোগিতাটি ছিলো নিয়মিত একটি প্রতিযোগিতা। চঁাদপুর শহরের রেলওয়ে লেকে প্রতিবছর এই সঁাতার প্রতিযোগিতাগুলো অনুষ্ঠিত হতো।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনার সাথে যঁারা সঁাতারে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন, তঁারা কে কে? কোথায় আছে জানেন কি?

বাদল মজুমদার : চলমান সমাজ ব্যবস্থার কারণে এবং নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে যদিও ওইভাবে সকলের খেঁাজ খবর নেওয়া হয় না। তারপরও যতোটুকু সম্ভব হয় দেখা বা সাক্ষাতে খেঁাজখবর নেয়ার চেষ্টা করি। তাছাড়া ওই সময় অধিকাংশ কৃতী সঁাতারু শহর বা আশেপাশের বাসিন্দা ছিলেন। এদের মধ্যে দু-একজন মারা গেছেন। বাকি যারা আছেন সকলে ভালো আছেন। চেষ্টা করি মাঝে মাঝে যোগাযোগ করার।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনার সন্তান ও আত্মীয় স্বজন কাউকে কি সঁাতার শিখিয়েছেন?

বাদল মজুমদার : আমি শুধু আমার ছেলে মেয়েদেরই নয়, আমার পরিবারের সকলকে সঁাতার শিখিয়েছি। এমনকি পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন শুভাকাঙ্ক্ষী সহ শত শত মানুষকে সঁাতার শিখিয়েছি এবং সঁাতার শেখার জন্যে উৎসাহ প্রদান করেছি।

ক্রীড়াকণ্ঠ : চঁাদপুরের সঁাতারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কী ধারণা? আপনাদের সময়ের মতো কি সঁাতার চলছে, না খারাপ অবস্থা?

বাদল মজুমদার : চঁাদপুরে বর্তমানে সঁাতারের একেবারে নাজুক পরিস্থিতি। এছাড়াও সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারের অসচেনতার কারণে নতুন প্রজন্ম সঁাতারের কাছ থেকে একেবারেই অনেক দূরে। নতুন প্রজন্মের প্রায় ৭০ ভাগ ছেলেমেয়ে সঁাতার জানে না। অপরদিকে জেলা শহর হিসেবে এবং সঁাতারের পূর্বের ইতিহাসের আলোকে চঁাদপুরের সঁাতারে যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে সেই তুলনায় অজ্ঞাত কারণে চঁাদপুরে সঁাতারের বা নতুন প্রজন্মের সঁাতার শেখার কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। চঁাদপুরি স্টেডিয়ামে সঁাতারের জন্যে একটি সুইমিং পুল নির্মাণ হওয়ার অল্প কয়েক বছর পার হতে না হতে সেটি সংস্কারের নামে দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। এটি কবে নাগাদ আলোর মুখ দেখবে সেটা কারো জানা নেই। অপরদিকে শহরবাসী শহরের রেলওয়ে লেকে সঁাতার শিখবে বা সঁাতারু তৈরি করার প্রশিক্ষণ হবে সেটিও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যবহার করতে পারছে না। অন্যদিকে জেলা ক্রীড়া সংস্থা বা জেলা প্রশাসনের অধীনে সঁাতার প্রতিযোগিতার যে সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে, সেটির কে বা কারা দায়িত্বে আছেন তাও সাধারণ মানুষ বা সচেতন জনগণও জানে না। এ অবস্থায় আমি মনে করি, চঁাদপুরের সঁাতারের অবস্থা কতোটুকু ভালো বা কতোটুকু মন্দ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ক্রীড়াকণ্ঠ : বিশ্বখ্যাত সঁাতারু আ. মালেক ও অরুন নন্দীর মতো সঁাতারু কি আর চঁাদপুরে জন্মাবে না?

বাদল মজুমদার : বাংলাদেশের সঁাতারের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিয়ে কোনো ইতিহাস রচনা করা হলে আমাদের চঁাদপুরের দু ব্যক্তি যথাক্রমে মরহুম আব্দুল মালেক ও অরুণ নন্দীর নাম লিখতে হবে। সে জেলায় নতুন প্রজন্ম ও আগামী প্রজন্মের মধ্য থেকে আব্দুল মালেক ও অরুন নন্দীর মতো সঁাতারু সৃষ্টি করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে যে সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন সেগুলো বর্তমানে নেই। ফলে তাদের মতো সঁাতারু তৈরি করা তো দূরের কথা, সঁাতার শব্দটি এক সময় হারিয়ে যাবে। একদিকে সঁাতারের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বা স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে জেলা ক্রীড়া সংস্থার যে সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করা বা উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়োজন সেটি ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক বছরহুলোতে দেখা যাচ্ছে না। এর বাইরেও স্থানীয়ভাবে বা জাতীয়ভাবে ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব চরমভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে নতুন প্রজন্ম এসব বিষয়ে আগ্রহ নিয়ে আসে না। যার ফলে নতুন প্রজন্ম প্রতিনিয়ত বিপথগামী হচ্ছে।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আমাদের উপরের প্রশ্নমালার বাইরে আপনার কোনো বক্তব্য থাকলে বলতে পারেন।

বাদল মজুমদার : সব কথার শেষ কথা বা সর্বোপরি আমার বক্তব্য হচ্ছে : নতুন প্রজন্মসহ অনাগত প্রজন্মের অথবা প্রতিটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে সঁাতার শেখার অবশ্য অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকদের সচেতনতার একান্ত প্রয়োজন। অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ৭০ ভাগ সঁাতার জানে না। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সকলকে এগিয়ে আসা উচিত।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়