প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৫, ০৯:১২
স্যার, আপনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায়

“কী বুঝি না তাহাও বুঝি না!”
১৯৭৮ সাল। তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র, পড়ি চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমাদের পদার্থবিজ্ঞান পড়াতেন এক অসাধারণ শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান স্যার। স্যারের সেই বিখ্যাত ডায়ালগ আজ ৪৬ বছর পরেও কানে বাজে--
“কী বুঝি না তাহাও বুঝি না!”
কোনো ছাত্র যখন কোনো পাঠ ভালোভাবে না বুঝতো, তখন স্যার হাসিমুখে এই বাক্যটি উচ্চারণ করতেন। এতে রাগের পরিবর্তে হাস্যরস ছড়িয়ে পড়তো পুরো ক্লাসে এবং সেই সঙ্গে জেগে উঠতো পাঠটা নতুন করে বোঝার অনুপ্রেরণা।
শিক্ষক ছিলেন, দার্শনিকও ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান স্যার। ছিলেন এমন একজন শিক্ষক, যিনি শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞানে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি ছাত্রদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতেন যুক্তি, কৌতূহল এবং শুদ্ধ মূল্যবোধ।
একজন শিক্ষক কতোটা প্রভাব ফেলতে পারেন একজন শিক্ষার্থীর জীবনে, স্যার ছিলেন তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
আমি নিজেও দীর্ঘকাল শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। ইনশাআল্লাহ, চলতি বছরের নভেম্বর মাসে আমার কলেজ শিক্ষকতার পরিসমাপ্তি ঘটবে। জীবনের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভাবি মোস্তাফিজ স্যার যেভাবে আমাকে আলোকিত করেছিলেন, আমি কি আমার ছাত্রদের তেমন কিছু দিতে পেরেছি?
হয়তো আমার ছাত্ররাই একদিন এর উত্তর দেবে। এটিই পৃথিবীর একটি চিরন্তন নিয়ম—শিক্ষক শেখান, ছাত্র মূল্যায়ন করে।
নীতিবান, সংবেদনশীল ও অনুপ্রেরণাদায়ী স্যার ছিলেন শৃঙ্খলা ও নীতির প্রতীক। তাঁর চেহারায় যেমন ছিলো অনাড়ম্বর সৌম্যতা, তেমনি তাঁর আচরণে ছিলো মমত্ববোধ, দৃঢ়তা এবং প্রজ্ঞার ছাপ। পরীক্ষার সময়েও তিনি ছিলেন একজন উদার অথচ কঠোর নীতিবান শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষে একাধিকবার তাঁর কণ্ঠে শুনেছি--“শেখা না হলে জানাও, আমি বোঝাবার জন্যেই শিক্ষক।” তাঁর এই মানসিকতাই আজও শিক্ষকদের জন্যে অনুকরণীয়।
স্মৃতির পাতায় স্যারের ছায়া, স্যারের পাঠদান ছিলো যেন নাট্যরূপে উপস্থাপিত একটি জ্ঞানভিত্তিক নাটক। বোর্ডে চক হাতে নিয়ে তিনি যখন ধাপে ধাপে সমস্যা সমাধান করতেন, ক্লাসরুমে তখন থাকতো পিনপতন নীরবতা—সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতো তাঁর উপস্থাপন।
পদার্থবিজ্ঞানের কঠিন সূত্রগুলো তাঁর হাত ধরে যেন জীবন্ত হয়ে উঠতো।
হাসান আলী স্কুলের অনেক প্রাক্তন ছাত্র আজ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কর্মরত। তারা সবাই স্যারের স্মৃতি বয়ে বেড়ায় শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। কেউ কেউ উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ আবার সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সবাই একবাক্যে বলেন,
“স্যার আমাদের মেরুদণ্ড সোজা করে চলতে শিখিয়েছেন।”
আলোকবর্তিকারূপে আমার শিক্ষকতা জীবনে বহু সহকর্মী পেয়েছি, বহু ছাত্রও। কিন্তু মোস্তাফিজুর রহমান স্যারের মতো একজন আদর্শ শিক্ষক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তিনি শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের প্রতীক, একজন আদর্শবাদী শিক্ষক, একজন নির্মোহ পথপ্রদর্শক।
আজ এই স্মৃতিচারণা যখন লিখছি, তখন অন্তরের গভীর থেকে স্যারের জন্যে দোয়া রইলো আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসের সর্বোচ্চ স্থানে স্থান দেন। স্যারের সকল ছাত্রের পক্ষ থেকে আমি জানাতে চাই অকৃত্রিম ভালোবাসা, অবিরাম শ্রদ্ধা ও দোয়া-- আপনি ছিলেন শুধু আমাদের শিক্ষক নন, আপনি ছিলেন আমাদের দিকনির্দেশক, আমাদের বাতিঘর। স্যারের মতো একজন শিক্ষককে পাওয়া যেমন গর্বের, তেমনি তাঁকে হারানো একটি অপূরণীয় শূন্যতা। তবে আমরা জানি, একজন প্রকৃত শিক্ষকের মৃত্যু হয় না, তিনি বেঁচে থাকেন তাঁর ছাত্রদের চরিত্রে, তাঁদের নৈতিকতায়, তাঁদের কর্মকাণ্ডে। স্যার, আপনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায়।
মো. জাকির হোসেন : সাবেক ছাত্র (১৯৭৬-১৯৮০), হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়; সহকারী অধ্যাপক, বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ; তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।