প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৫, ০৮:৩৩
মেঘনাকেও রক্ষা করতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সরব ও সোচ্চার নয়!

উইকিপিডিয়াতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সম্পর্কে লিখা হয়েছে, এটি বাংলাদেশের একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। নদীর অবৈধ দখল, পানি ও পরিবেশ দূষণ, শিল্প কারখানা কর্তৃক সৃষ্ট নদী দূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌ-পরিবহনযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা সহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে এ কমিশন গঠিত হয়েছে। আর মেঘনা নদী সম্পর্কে লিখা হয়েছে, মেঘনা বাংলাদেশের গভীরতম ও প্রশস্ততম নদী এবং অন্যতম বৃহৎ ও প্রধান নদী। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, ভোলা ও লক্ষ্মীপুর জেলার একটি নদী। এর দৈর্ঘ্য ১৫৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৪০০মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চলের নদী নম্বর ১৭ হিসেবে মেঘনাকে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশের এই বিখ্যাত নদী মেঘনা সম্পর্কে গতকাল দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ সহ দেশের অনেক গণমাধ্যমে উদ্বেগজনক খবর বেরিয়েছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার মতো মেঘনার পানিতে দূষণ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছতে চলেছে। ‘বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যালে পানি দূষণ : মতলব উত্তরে মেঘনা নদীতে আবারো ভেসে উঠছে মরা মাছ’ শিরোনামে চাঁদপুর কণ্ঠে মতলব উত্তর প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, সিনিয়র সাংবাদিক মাহবুব আলম লাভলু লিখেছেন, মতলব উত্তরে মেঘনা নদীতে আবারও ভেসে উঠছে মরা মাছ। শুক্রবার (১৬ মে ২০২৫) ভোর থেকে মতলব উত্তরের ষাটনল থেকে দশানি পর্যন্ত মেঘনা পাড়ের বিভিন্ন স্থানে এমন চিত্র দেখা গেছে। ২০২৩ সালের মার্চ ও ২০২৪ সালের আগস্ট মাসেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। এলাকাবাসী বলছেন, বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যালের কারণে পানি দূষিত হওয়ায় মরে ভেসে উঠছে দেশীয় মাছ। বিশেষ করে জাটকা, চেউয়া, বাইলা, টেংরা, পুঁটি, চাপিলাসহ অসংখ্য ছোট-বড় দেশীয় মাছ। প্রতিদিনের মতো শুক্রবার ভোরে মাছ ধরতে নদীতে নামেন স্থানীয় জেলেরা। তখনই তারা দেখতে পান পানিতে ভেসে রয়েছে অসংখ্য মরা মাছ। কী কারণে বার বার নদীতে মাছ মারা যাচ্ছে এবং পানিদূষণ হচ্ছে তার সমাধান চান এলাকাবাসী। এদিকে পচা মাছের দুর্গন্ধে নদীপাড়ের বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। দূষিত হওয়ার কারণে এখন নদীর পানি ব্যবহারও করতে পারছে না স্থানীয়রা। এভাবে ছোট আকারের জাটকা মারা পড়লে সামনে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় জেলেরা।
ষাটনলের জেলে ফুলচান বর্মন বলেন, এখন এই পানিতে মাছ তো নেই, বরং বিষ ছড়িয়ে আছে। কয়েক বছর ধরেই এমন হচ্ছে। কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। জাটকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মাছশূন্য হয়ে যাবে নদী। স্থানীয় জেলে ইমাম হোসেন বলেন, নদীতে বাচ্চারা খেলতে যায়, গোসল করে। আমরা নদীর পানি সব সময় ব্যবহার করি, কিন্তু এখন পারছি না।এখলাসপুরের মাছ ব্যবসায়ী জুয়েল রানা বলেন, আজকে যা দেখলাম, তাতে আগামী কয়েক মাস নদী থেকে মাছ পাওয়া কঠিন হবে। বাজারে মাছের দাম বেড়ে যাবে, মানুষ কষ্ট পাবে। ষাটনল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আক্কাস আলী মোল্লা বলেন, মাছ মরার ঘটনা শুধু পরিবেশের ক্ষতি নয়, মানুষের জীবিকার ওপরও আঘাত। বারবার অভিযোগ করলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। নদী বাঁচলে আমরা বাঁচবো-এটাই এখন সবার মূল দাবি ও উপলব্ধি হওয়া উচিত। মতলব উত্তর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস বলেন, এটি একটি জলজ পরিবেশগত দুর্যোগ। শীতলক্ষ্যা থেকে আসা দূষিত পানির প্রবাহ একাধিকবার এই এলাকায় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এটি প্রথম নয়, একাধিকবার ঘটেছে এমন ঘটনা । ২০২৩ সালের মার্চ ও ২০২৪ সালের আগস্ট মাসেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। তখনও মেঘনার পানি দূষিত হয়ে মাছের গণমৃত্যু হয়। তবে এবার পরিমাণ আরো বেশি দেখা যাচ্ছে।
চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, মেঘনা নদীতে মাছ মরে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে গত ৩০ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। সেখানকার রিপোর্ট অনুযায়ী নদীর পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পিএইচ ও অক্সিজেনের হার কমে গিয়েছিল। এছাড়া নদীর তলদেশ দিয়ে কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যালযুক্ত পানি বয়ে যাচ্ছে। এই রিপোর্টের প্রেক্ষিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় মেঘনার পরিস্থিতি পূর্বের বছরগুলোর চেয়ে এ বছর আরো খারাপই হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশন নামের খসম আজিজ মিসির হয়ে থাকলে ভবিষ্যতে মেঘনার পানি দূষণ পরিস্থিতি কোন্ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে সেটা ভাবতেও গা শিউরে উঠে। নদীর সম্পদের মধ্যে মাছের চেয়ে বালিকেই যে নদী রক্ষা কমিশন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটা কালেভদ্রে তাদের হাঁকডাকে মনে হয়। এই হাঁকডাকও লাগাতার নয়। যদি লাগাতার হতো, তাহলে দেশের অধিকাংশ নদীতে বালি লুটপাটের মহোৎসব হতো না। নদী রক্ষা কমিশন নদীর বালি রক্ষায় কার্যত ব্যর্থই বলা চলে। তারপর যদি মাছে-ভাতে বাঙালির সুস্বাদু আমিষ, বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ সহ নদীর অন্যান্য মাছ দূষণজনিত কারণে রক্ষা করতে না পারে, তাহলে তারচে’ বড়ো দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? এই সম্পাদকীয় নিবন্ধের প্রথম স্তবকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের যে বর্ণনা ছাপা হয়েছে, সে আলোকে এই কমিশন মেঘনাসহ সারাদেশে অন্যান্য নদীরক্ষায় কাজ করে কিনা সেটা ভেবে দেখাটাও সরকারের জন্যে অনিবার্য হয়ে পড়েছে।