সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ

প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৪১

আমাদের কন্যা শিশু, তাদের বেড়ে উঠা ও সোশ্যাল মিডিয়া

নাদিয়া রওশন
আমাদের কন্যা শিশু, তাদের বেড়ে উঠা ও সোশ্যাল মিডিয়া

আমাদের কন্যা শিশু মানে আমাদের চারপাশে যত কন্যা শিশু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবাই। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী আঠারো বছর বয়সের নিচের সব মানুষই শিশু। আঠারো বছর বয়স কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি কালজয়ী কবিতা যেখানে আঠারো বছর বয়সকে অদম্য বয়স হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যে বয়স বয়ঃসন্ধিকালে পদার্পনের বয়স, যে বয়স কোন বাঁধা মানে না, যে বয়স কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণের বয়স, আবেগে উচ্ছাসে জীবনের ঝুঁকি নেবার বয়স। তারমানে যে বয়সটাকে আমরা শিশু বয়সে ফেলছি, কবি সে বয়সের কাছাকাছি বয়সটাকেই বলছেন খুব ভয়ঙ্কর। ইংরেজিতে যাকে আমরা টিনেজ বয়স বলি। তেরো থেকে উনিশের এই সময়টাতে আমাদের কন্যা শিশুদের আগলে রাখার মতো কঠিন দায়িত্ব আজ আমাদের কাঁধে।

বর্তমান অস্থির সময়ে কি শিশু, কি বৃদ্ধ সকলেই যখন মোবাইল, ইন্টারনেট, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখছি তখন কন্যা শিশুর মেধা ও মনন কতটুকু ঠিকঠাক বিকশিত হচ্ছে সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন?

বর্তমানে ধনী, দরিদ্র, সরকারি, বেসরকারি চাকুরীজীবি, প্রবাসী, রিকশাচালক থেকে দিনমজুর এমনকি অনেক ভিখারির হাতেও স্মার্টফোন আছে। কিন্তু কজন ব্যক্তি সঠিকভাবে স্মার্টফোন পরিচালনা করতে পারেন?

তারচেয়ে ও ভয়াবহ হলো টিকটক,লাইকি, ইমু, ইউটিউব, ফেসবুকের মাধ্যমে আয় করা। একশ্রেনীর মানুষ টাকার নেশায় এতোটাই মত্ত যে একটা শিশু কিংবা টিনেজার মেয়েকেও লাইক, কমেন্টের ধাধায় জড়িয়ে ফেলছে। প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেই, কোন গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট নেই, শুধুমাত্র ভিনদেশী কিছু বিকৃত গান নাচের মাধ্যমে আয় করছেন তারা। তাদের এই বিকৃত কন্টেন্ট দেখছে ছেলে বুড়ো থেকে সব ধরনের মানুষ। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ভালোমন্দ যাচাই বাছাই করে ভালোটা গ্রহণ করতে পারলে ও একজন কম বয়সী শিশুর মনে খারাপ প্রভাবটাই বেশ পড়ে।

করোনাকালীন ও করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের পড়াশোনা থেকে জীবন যাপন সবকিছুতেই স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে ব্যাপকহারে। সেই সুযোগে আমাদের শিশুরা এখন স্মার্টফোন নির্ভর হয়ে গিয়েছে। আমরা মা বাবারা শিশুদের আবদার মেটাতে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি নিজস্ব স্মার্টফোন।

আমরা অভিভাবকরাই অনেক সময় জানিনা ইউটিউব কিংবা ফেসবুকে কিভাবে আপত্তিকর ভিডিওতে রিপোর্ট করতে হবে, কোন অপশনে গিয়ে এডাল্ট ভিডিও অপশন বন্ধ করতে হবে?

প্রথম যখন এদেশে মোবাইল ফোন সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে এলো, অধিকাংশ অভিভাবক নম্বর ডায়াল করে কথা বলা ছাড়া অন্যান্য অপশনে যেতে পারতেন না। অথচ তাদের সন্তানেরা মোবাইলের খুঁটিনাটি সব জানতো।

ঠিক তেমনি এ যুগের অধিকাংশ অভিভাবক স্মার্টফোনের সঠিক ব্যবহার জানে না, আর তাদের সেই না জানার সুযোগ নিচ্ছে তাদের সন্তানেরা।

অনেক বাবা-মা জানেনই না তাদের সন্তানদের টিকটক, লাইকি, ফেসবুক আইডি আছে, যেখানে তাড়া অশ্লীল গান নাচের ভিডিও আপলোড করছেন।

বিশেষ করে এক শ্রেণীর শিক্ষাহীন মানুষ যারা হয়তো দিন রাত কঠোর পরিশ্রম করে প্রবাসে থেকে টাকা পাঠাচ্ছেন। তাদের পরিবার, সন্তানের হাতে হাতে স্মার্টফোন। কিছু পরিবারে বাবা-মা পড়াশোনা জানেন না, সন্তানকে পড়াচ্ছেন, সন্তান পড়ার দোহাই দিয়ে স্মার্টফোনে কি করছে অভিভাবক জানছেন না।

ফেসবুক, ইউটিউবে এখন শুধু কন্টেন্টের ছড়াছড়ি, ডলার আয়ের ছড়াছড়ি। একশ্রেণী বানাচ্ছে, তো অন্য শ্রেণী দেখছে। এই শিশুদের মননে ও মগজে ক্রিয়েটিভিটি, পড়াশোনার চেয়ে এখন ভাইরাল হবার নেশা। কে, কতটা উলঙ্গ হয়ে ভিডিও বানাতে পারে তার প্রতিযোগিতা।

কোথাও কোথাও অভিভাবক নিজেই উৎসাহী হয়ে সন্তানকে নিয়ে ভিডিও করছেন। আজকাল কোথাও ঘুরতে গেলে দেখা যায় তেরো, চৌদ্দ, পনেরো বছরের এই মেয়ে শিশুরা টিকটক ভিডিও করছে। তাদের মন মস্তিষ্কের কুঠুরিগুলোতে পড়াশোনার চেয়ে সেলিব্রিটি হবার তীব্র বাসনা,যে বাসনা তাদের অনেক সময় বিপথে নিয়ে যাচ্ছে।

আমরা তাদের শিশু ভাবলেও তাদের ভেতর থাকে বড় হবার তীব্র বাসনা। এ যুগে একটা ফোর ফাইভের কন্যা শিশু ও জানে তার একজন বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু প্রয়োজন,প্রয়োজন একান্ত সময় কাটানোর।

স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে এসব কন্যা শিশুরা নিজেদের উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত শৈশবটাকেই করে তুলছে ভয়ঙ্কর। এ জাল থেকে কেউ সরাসরি বৈবাহিক জীবনে প্রবেশ করছে কেউ বা পড়াশোনা চালালেও তা আগের মতো আর নিরবিচ্ছিন্ন হচ্ছে না।

আমাদের এ শিশুদের মনে মানুষ হবার, আকাশ সমান স্বপ্ন জয়ের চিন্তা শুধুমাত্র সেলিব্রিটি হয়েই। জ্ঞানের বিশাল পরিধি, আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার হাতিয়ার তাদের হাতে থাকলেও সেটার অপব্যবহার হচ্ছে।

আমাদের কন্যা শিশুরা তাদের পরিবেশ, তাদের খাদ্যাভ্যাস, তাদের জীবনাচরনের দারুন শরীরের রজঃচক্রিয়ায় আগেই পৌঁছে যাচ্ছে। তাদের মানসিক বয়স না বাড়লে ও শরীর তাদের বড় করে দিচ্ছে।

তাদের চাল চলন বড়দের মতো হয়ে যায় কিন্তু মনে ও মননে তো তারা ছোট মানুষটিই তো রয়ে যায়। আমাদের শিশুদের বেড়ে উঠাতে এমনিতেই নানা প্রতিবন্ধকতা। আজকের আমাদের শিশুরা যেন বন্দী খাঁচায় বড় হচ্ছে। নেই সেই দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠে দৌড়ে বেড়ানো, পুকুর, দীঘির স্বচ্ছ জলে সাঁতার কাঁটা, রাতে জোনাকি পোকা ধরবার প্রতিযোগিতা।

আমাদের কন্যা শিশুগুলো জেলখানার কারাগারে বড় হচ্ছে, শহুরে একক পরিবারে বেড়ে উঠা এসব শিশু পাশের বাসাতে এমনকি নিজের বাসাতেও আজ নিরাপদ নয়। তাদের আনন্দময় শৈশব আজ ইটপাথরের চারদেয়ালের মাঝে গুমড়ে মরছে। আজ তাই আমাদের কন্যা শিশুরা শিশু বয়স থেকেই স্হূলকায় হয়ে বেড়ে উঠছে। মোবাইল, কম্পিউটার আর টিভি স্ক্রিনই তাদের বন্ধু।

একটা সময় কন্যা শিশুরা ও একা একা স্কুলে যেতো, স্কুলের আগে পরে খেলতো। আজকের স্কুলগুলোতে নেই খেলার মাঠ। মা বাবার হাত ধরে তাদের সময়ের সাথে মিল করেই আজকের শিশুরা স্কুলে যায়, তাদের শৈশব ওই পড়াশোনাতেই তাই বন্দী।

আমাদের স্কুল, আমাদের পরিবার কোথাও সেভাবে আমাদের কন্যাদের মানুষ হিসেবে বড় করবার প্রক্রিয়া নেই। তাদের মননে কেবলমাত্র একটাই স্বপ্ন, পড়তে হবে,চাকরি করতে হবে। কিন্তু ঠিক কতজন মেয়ে তার সেই স্বপ্ন সঠিকভাবে পূরণ করতে পারছে।

আমাদের কন্যাদের নিজের নাম বানাতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এই শিক্ষার চেয়ে ও আগে যে শিক্ষা দিতে হবে তা হলো আত্নবিশ্বাসী হতে হবে। তুমি পারবে ঘুরে দাঁড়াতে যতই বাঁধা আসুক না কেন জীবনে, কেননা তুমি পানির মতো, তোমাকে যেকোনো পাত্রে রেখেই সকলেই পরীক্ষা করবে।

তোমাকে খাপ খাওয়াতে হবে সকল প্রতিকূলতার সাথে কেননা তুমি নিজেও জানোনা কয়েক বছর পর তোমার গন্তব্য কোন ঘরের কোন মানুষগুলোর সাথে হবে। তোমার জীবনের একটি বড় সময় কাটাতে হবে একদম অপরিচিত কিছু মানুষের সাথে।

তোমাকে মানুষ চেনার মত কঠিন কাজে পারদর্শী হতে হবে, কেননা তুমি নিজ জীবনের সিদ্ধান্ত যদি নিজেই নিতে চাও তোমাকে সবার আগে সঠিক মানুষটিকে চিনতে হবে। নচেৎ তোমার একটি ভুল সিদ্ধান্ত তোমার সারাজীবনের কান্না হবে।

আমাদের অভিভাবকদের প্রজন্ম কনজারভেটিভ ছিল, কিছু বিষয় মেয়েদের সাথে আলোচনা করাও যেন তারা লজ্জা পেতো। অথচ আমাদের মেয়ে শিশুদের শারীরিক এই সময়ের পরিবর্তনের সাথে তাদের মানসিক পরিবর্তন ও যুক্ত।

আমরা তাদের শিশু বললেও তাদের শরীরে, তাদের মনে থাকে বিপরীত লিঙ্গের মানুষটির প্রতি আকর্ষণ। তাদের মনে থাকে কেন হলো , কি হলোর মতো হাজারো প্রশ্ন। তাদের এসব প্রশ্নের উত্তর যখন তারা পাবে না অভিভাবকদের কাছ থেকে তখন তারা ঝুঁকে পড়বে বন্ধু বান্ধব, ইন্টারনেট কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার উপর।

আমাদের কন্যা শিশুদের এই নয় দশ বছর বয়স থেকেই একটু একটু করে সব বলতে হবে, জীবন, শরীর,মন, পরিবর্তন সব কিছুর সাথেই তাদের পরিচিত করে তুলতে হবে। তাদের যেমন এই শিক্ষা দিতে হবে, তাদের নিজেদের আত্নপরিচয় লাগবে, পাশাপাশি তাদের এটাও বোঝাতে হবে তাদের ও একদিন স্বামী ,সংসার, সন্তান হবে। সে জীবনে সে কি করে মানিয়ে নিবে, কি করে একটা দীর্ঘ জীবন বিশ্বস্ততা, স্যাক্রিফাইস আর কম্প্রোমাইজ করে কাটাতে হবে, কি করে সে জীবনে ব্যালেন্স করবে।

জরুরী নয় আমাদের সব কন্যা শিশু ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার,পাইলট,ব্যবসায়ি হবে, আমাদের কিছু কন্যা শিশু হয়তো একটি সুন্দর সংসার করার স্বপ্ন দেখবে, তবে সে যেন সঠিকভাবে সেই সংসারটাকেই চালায়।

আমাদের কন্যা শিশুকে শেখাতে হবে আত্নরক্ষার কৌশল, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাঁটা, শারীরিক ব্যায়ামের মতো বিষয়গুলো সেই সাথে রান্না, হোম ম্যানেজমেন্ট ,মানি ম্যানেজমেন্ট, সফট স্কিল, কম্পিউটার চালানো, বই পড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আমাদের কন্যা শিশুকে শেখাতে হবে জীবন যুদ্ধক্ষেত্র, এখানে টিকে থাকতে হলে সংগ্রাম করতে হবে আজীবন। সে যেন পরিবারের অন্য সদস্যদের ভালোলাগা আর ভালোবাসার বেড়াজালে নিজেকে ভালোবাসার কথা ভুলে না যায়।

পরিবারের সদস্যদের ভালো খাবার খেতে দিয়ে সে যেন বাসি , উচ্ছিষ্ট খাবার না খায়, তার শরীরের যত্ন যেন সে নিজেই নেয়, তার মনের ভালোলাগার জন্য সে যেন সবসময় তার পছন্দের কাজ গুলো করে।

শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করে নয়, সত্যিকার অর্থেই মাঠে কাজ করে এমন একটা জেনারেশন তৈরি করা উচিত যাতে আমাদের এ প্রজন্মের মেয়ে শিশুরা মেয়ে হয়ে নয় মানুষ হয়ে বেড়ে উঠে, যারা নিজেদের শরীর নয় মেধাকে পুঁজি করে আত্নবিশ্বাসী হবে।

আর এর শুরুটা এখনই করতে হবে, নতুবা বড্ড দেরী হয়ে যাবে, আমাদের কন্যা শিশুদের রক্ষা করার দায়িত্ব যে আমাদেরই।

লেখক : নাদিয়া রওশন, উদ্যোক্তা, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়