প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৯
সোশ্যাল মিডিয়া কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?

সোশ্যাল মিডিয়া আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, টুইটার, ইউটিউবসহ নানা প্ল্যাটফর্মে মানুষ প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটায়। এটি যেমন যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। এই ফিচারে আমরা বিশ্লেষণ করবো কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, কোন্ কোন্ উপসর্গ দেখা যাচ্ছে এবং কীভাবে এই প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্তার ও ব্যবহার
বর্তমানে বিশ্বে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। একজন ব্যবহারকারী গড়ে প্রতিদিন দু ঘণ্টার বেশি সময় এসব প্ল্যাটফর্মে কাটায়। বাংলাদেশেও এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। তারা নিজেদের ছবি, ভিডিও, মতামত, জীবনযাপন নিয়মিতভাবে শেয়ার করে। এই প্রবণতা একদিকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ দিলেও অন্যদিকে তৈরি করছে মানসিক চাপ, আত্মবিশ্বাসের সংকট এবং একাকীত্ব।
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব
১. আত্মমূল্যায়নের সংকট
সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের সুখী জীবন, সফলতা, সৌন্দর্য, ভ্রমণ, এবং বিলাসিতার ছবি দেখে অনেকেই নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করতে শুরু করে। এতে আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং নিজেকে ছোট মনে হয়। এই তুলনামূলক মনোভাব থেকে জন্ম নেয় হতাশা ও অবসাদ।
২. ফোমো বা ঋবধৎ ড়ভ গরংংরহম ঙঁঃ
ফোমো একটি মানসিক অবস্থা যেখানে মানুষ মনে করে সে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বা আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদের পোস্ট দেখে মনে হয় সবাই আনন্দে আছে, অথচ সে একা। এই অনুভূতি দীর্ঘমেয়াদে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
৩. সাইবার বুলিং ও নেতিবাচক মন্তব্য
অনেক ব্যবহারকারী সোশ্যাল মিডিয়ায় অপমানজনক মন্তব্য, কটাক্ষ বা হুমকির শিকার হন। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা এই ধরনের বুলিংয়ের কারণে আত্মহত্যার চিন্তা পর্যন্ত করে। এটি তাদের আত্মসম্মান ও মানসিক স্থিতি ভেঙে দেয়।
৪. আসক্তি ও ঘুমের সমস্যা
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। রাত জেগে স্ক্রলিং, ভিডিও দেখা বা চ্যাট করার ফলে ঘুম কমে যায়। ঘুমের অভাব মানসিক স্বাস্থ্যকে আরও দুর্বল করে তোলে।
৫. একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা
যদিও সোশ্যাল মিডিয়া যোগাযোগের মাধ্যম, বাস্তবে এটি অনেককে একাকী করে তোলে। ভার্চুয়াল সম্পর্ক বাস্তবের মতো গভীর নয়। ফলে মানুষ বাস্তব জীবনের সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যায় এবং একাকীত্বে ভোগে।
গবেষণা ও মনোবিজ্ঞানীদের মতামত
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহারকারীদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগের হার বেশি। ভারতে ১৪ শতাংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে এবং এর একটি বড়ো কারণ সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি।
মনোবিজ্ঞানী ড. আর্চনা শুক্লা বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষের চিন্তা, আবেগ এবং আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি আত্মবিশ্বাস কমায় এবং সামাজিক দক্ষতা হ্রাস করে।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ
রাফি নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী প্রতিদিন চার ঘণ্টা ইনস্টাগ্রামে সময় কাটাতো। সে অন্যদের জীবন দেখে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করতো। ধীরে ধীরে তার মধ্যে হতাশা, একাকীত্ব এবং আত্মবিশ্বাসের সংকট দেখা দেয়। পরে সে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার কমিয়ে দেয় এবং ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে।
করণীয় ও প্রতিকার
১. সময় নিয়ন্ত্রণ
সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানোর জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন। দিনে এক ঘণ্টার বেশি না ব্যবহার করাই ভালো।
২. বাস্তব জীবনের সম্পর্ক জোরদার করুন
বন্ধু, পরিবার, সহকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বাড়ান। বাস্তব সম্পর্ক মানসিক স্থিতি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৩. মননশীলতা চর্চা
মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, এবং বই পড়ার মতো মননশীল কার্যক্রমে সময় দিন। এটি মানসিক চাপ কমায়।
৪. নেতিবাচক কনটেন্ট এড়িয়ে চলুন
যে পোস্ট বা ভিডিও আপনাকে হতাশ করে তা এড়িয়ে চলুন। পজিটিভ কনটেন্ট দেখুন যা অনুপ্রেরণা দেয়।
৫. প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন
যদি সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এর নেতিবাচক প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। এটি আত্মবিশ্বাস, সম্পর্ক, এবং মানসিক স্থিতিকে দুর্বল করে দিতে পারে। সচেতন ব্যবহার, সময় নিয়ন্ত্রণ, এবং বাস্তব জীবনের সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে এই ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আমাদের উচিত সোশ্যাল মিডিয়াকে একটি উপকারী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা, যাতে এটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে বরং সমৃদ্ধ করে।







