বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:৫৬

অবসরের পর শিক্ষকের কান্না : হাইকোর্টের রায় কি আনবে সুদিন?

অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন
অবসরের পর শিক্ষকের কান্না : হাইকোর্টের রায় কি আনবে সুদিন?
1756927041686

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা। তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই শিক্ষকেরাই পড়েন সবচে' বড়ো অনিশ্চয়তায়। অবসরের পর যখন শান্তি ও স্বস্তিতে কাটানোর কথা, তখন তাঁদের বারবার দৌড়াতে হয় বিভিন্ন দপ্তরে শুধু অবসর ভাতা পাওয়ার জন্যে। এই অমানবিক ভোগান্তির অবসান ঘটাতে হাইকোর্ট সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন—এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরকালীন সুবিধা অবসরের ছয় মাসের মধ্যে দিতে হবে।

চাঁদপুরের এক শিক্ষক বহু বছর জেলার একটি নামকরা মাদ্রাসায় কর্মরত ছিলেন। অবসরের পর তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে ভুগলেন। প্রাপ্য ভাতা পেতে তিনি আবেদন করলেন, দরজায় দরজায় ঘুরলেন। স্থানীয় সংবাদপত্র দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে তাঁর দুরবস্থা নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল। তবু শেষ পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় তিনি ভাতা পাননি। মৃত্যুশয্যায় তাঁর সন্তানের আর্তনাদ ছিলো—“আমার বাবার অবসর ভাতা কি তিনি জীবিত অবস্থায় পাবেন না?” এ ঘটনা কেবল একজন শিক্ষকের নয়, দেশের হাজারো অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের করুণ বাস্তবতা।

হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আদালত বলেছেন, বেসরকারি স্কুল-কলেজের একজন শিক্ষক সীমিত বেতন পান। অবসরের পর তাঁকে বছরের পর বছর অবসর ভাতার জন্যে দৌড়াতে হবে—এটি অমানবিক। তাই ছয় মাসের মধ্যে সুবিধা প্রদান বাধ্যতামূলক করতে হবে। দেশে বর্তমানে ২২ হাজার ১৭৪টি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। প্রতিবছর তাঁদের অনেকেই অবসরে যাচ্ছেন। তাঁদের জীবনের শেষ প্রহরে ভাতা নিশ্চিত করা মানে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

অবসর সুবিধা প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতা নতুন কিছু নয়। ফাইলপত্রের জট, বরাদ্দের সীমাবদ্ধতা আর আমলাতান্ত্রিক ধীরগতি মিলে শিক্ষকরা বছরের পর বছর নাজেহাল হন। সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরের সঙ্গে সঙ্গেই সুবিধা পান, অথচ শিক্ষাব্যবস্থার বাহক বেসরকারি শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হন। এই বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যেই আদালতের নির্দেশনা।

এখন প্রশ্ন—সরকার কি এই রায় বাস্তবায়নে আন্তরিক হবে? বাজেটীয় দিক থেকে এটি সরকারের জন্যে একটি চ্যালেঞ্জ, তবে তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যদি বর্তমান সরকারের আমলেই এই রায় কার্যকর না হয়, তবে ভবিষ্যতে কোনো সরকারই তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবে না—এমন আশঙ্কা প্রবল। তাই এটি কার্যকর করার দায়িত্ব এখনকার সরকারের ওপরই বর্তায়।

অবসর সুবিধা ছয় মাসে প্রদানের বিধান বাস্তবায়ন করা গেলে শিক্ষক সমাজ নিশ্চিন্ত হবেন, পরিবার আর্থিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাবে, তরুণ প্রজন্ম শিক্ষকতায় আগ্রহী হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, রাষ্ট্র শিক্ষকদের মর্যাদা দেবে, যা সমগ্র জাতির জন্যে ইতিবাচক বার্তা বহন করবে।

শিক্ষক সমাজ, সুশীল সমাজ ও সংবাদমাধ্যমকে এই রায়ের বাস্তবায়নে সোচ্চার হতে হবে। চাঁদপুর কণ্ঠ অতীতে যেমন শিক্ষকদের দুর্দশা তুলে ধরেছে, তেমনি ভবিষ্যতেও গণসচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। কারণ এটি শুধু একজন শিক্ষকের অধিকার নয়, বরং জাতির প্রতি দায়িত্বের প্রতিফলন।

হাইকোর্টের রায় আশার আলো জ্বালিয়েছে। কিন্তু আলো জ্বালানোই যথেষ্ট নয়, সেটিকে টিকিয়ে রাখাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। যদি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে আরও অনেক শিক্ষক হয়তো প্রাপ্য ভাতা না পেয়েই মৃত্যুবরণ করবেন। এটি কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

লেখক : অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি চাঁদপুর জেলা।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়