প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৪১
হৃদয়বতী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পনেরো.
সাগর পাড়ের কুটিরে শুয়ে আছে ইমতিয়াজ। পাশে ঘুমিয়ে আছে অনন্যা। গভীর ঘুমে। ধীরে ধীরে ইমতিয়াজও ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়। এ সময় সে স্বপ্ন দেখতে থাকে। তিনজন মানুষ তার শিয়রে এসে দাঁড়িয়ে আছে। বেশভূষায় সুফি সুফি ভাব। একজন বললো, ‘হে ঘুমন্ত পরলোকের বাসিন্দা। তোমার বিবেককে জাগ্রত করো।’
ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো, ‘কে তোমরা?’
প্রথমজন বললো, ‘আমার নাম শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ। আমি একজন শাসক ও দরবেশ ছিলাম। আমার সৌন্দর্যের জন্যে আমার ভাইয়েরা ঈর্ষান্বিত হয়ে আমাকে দাস হিসেবে বুখারায় হাজী বুখারীর কাছে বিক্রয় করে। কয়েক হাত বদল হয়ে আমি দিল্লীর সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেকের সান্নিধ্য লাভ করি। আমার সততা, শিক্ষাদীক্ষা ও যোগ্যতায় সুলতান আমাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন। সততা, সাহসিকতা, বীরত্বের কারণে আমি আমীর পদে নিয়োগ পাই। পরে ঘোড়া থেকে পড়ে কুতুবুদ্দিন আইবেক মারা গেলে আমি দিল্লীর সুলতান হয়েছিলাম। কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিলো সত্যের প্রচার। আর সেই সত্যটা হচ্ছে আমাদের স্রষ্টাকে চেনা ও মানুষকে জানানো। পুত্র আমার, তুমি কী করছো? তুমি কি সত্যটাকে চিনতে পেরেছো? সত্যটাকে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছো?’
‘আর আপনি?’ পাশের সুফি সাধককে প্রশ্ন করলো ইমতিয়াজ।
‘আমার নাম মখদুম শাহ্দৌলা শহীদ ইয়েমেনী। আমি ছিলাম ইয়েমেনের রাজার পুত্র। নবীর সাহাবীদের বংশধর। বাংলার শাহজাদপুরে ইসলাম প্রচার করতে এসে এক পর্যায়ে নামাজরত অবস্থায় মুশরিকদের দ্বারা শহীদ হই। আমার কাটা মাথা নিয়ে যায় বিহারে। আর লাশটা দাফন করা হয় উল্লাপাড়ার শাহজাদপুরে। ৪০ দিন পর যখন বিহারের রাজার কাছে মাথাটা পৌঁছায় তখন আমার মুখ থেকে বের হচ্ছিল ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা, সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা’। আমার মাথাটাও আল্লাহর নির্দেশে সত্যটাকে মানুষের কাছে তুলে ধরেছিলো। কিন্তু তুমিও তো আল্লাহর একজন বান্দা। পাপের সাগরে ডুবে আছো। তুমি কি সত্যটাকে চিনতে না, প্রচার করবে না?’
‘আর আপনি?’ তৃতীয়জনকে প্রশ্ন করলো ইমতিয়াজ।
‘আমি খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি। আজমীর শরীফের খানকায় আমি ঘুমিয়ে আছি। পাশে আছে মোঘল বাদশাহদের নানা স্থাপনা। মোঘল বাদশাহ আকবর এখানে বিশাল মসজিদ ও মাদ্রাসা তৈরি করে দিয়েছিলেন। আমি পারস্যের সিস্তানের গজনর পল্লিতে জন্মগ্রহণ করেও অবিভক্ত ভারতে এসে মানুষের মাঝে সত্যটা প্রচারে সারাটা জীবন ব্যয় করেছি। আমি ১৫ বছর বয়সে বাবা মাকে হারাই। বাবার অনেক সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও সব গরিব দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে সংসারের মায়া ত্যাগ করে উজবেকিস্তানের বুখারায় গিয়ে জ্ঞান অর্জন করি। গরিবদের সব সময় সহযোগিতা করতাম বলে আমাকে ‘গরিবেনেওয়াজ’ও বলা হয়। বুখারার পর ইরানে গিয়ে ২০ বছর আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করি। আবদুল কাদের জিলানীর কাছেও জ্ঞান অর্জন করি। এরপর মক্কায় হজ্ব করে মদীনায় গিয়ে স্বপ্নে নবীজীর নির্দেশ পাই, ভারতে গিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্যে। আমি লাহোর, দিল্লী হয়ে আজমীর গিয়ে ইসলাম প্রচারে সারাজীবন কাটাই। তখনকার আজমীর ছিলো বিরান ভূমি। আমি সেখানে বসতি স্থাপন করি। এরপর আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ কেরামতির কারণে সেখানে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। সারা ভারতে আমার সুঘ্রাণে মানুষ মাতোয়ারা হয়ে সত্যটা জানার জন্যে আমার কাছে ছুটে আসে। আমি জীবনের শেষ পর্যন্ত মানুষের মাঝে সত্যটা পৌঁছে দিতে থাকি। হে মানব সন্তান, তুমি কি করছো? একটা সুন্দরী মেয়ের মোহে নিজের জীবনটাকেও উৎসর্গ করতে চাইছো! একজন আল্লাহর বান্দা আল্লাহকে ছাড়া নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পারে না। তুমি ভুল পথে আছো। সত্যের সন্ধানে বের হও, দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তির পথ তালাশ করো।’
কথাগুলো বলেই ধীরে ধীরে তিন সুফি সাধক অদৃশ্য হন। ইমতিয়াজের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে ধীরে ধীরে উঠে বসে, এক গ্লাস জলপান করে। তারপর ধীরে ধীরে স্বপ্নের কথাগুলো ভাবতে থাকে।
সে ভাবে, সারাজীবন মানুষের ক্ষতিই সে করেছে। কিন্তু মানুষের উপকার করার চিন্তাও মনে আসেনি। তাহলে কী হলো তার? স্বপ্নে কেনো এভাবে তাকে সাবধান করে দেওয়া হলো? নিশ্চয়ই দয়াবান আল্লাহ তাকে সত্যের পথে চালিত করবেন, গুনাহর জীবন থেকে আলোর পথ দান করবেন, তাই তার প্রতি দয়া করা হয়েছে, যাতে সে সত্যটাকে খুঁজে নিতে পারে।
এখন তার মনে হলো, এই মাফিয়া জীবন শেষে তার কী হবে? যখন সে নিরূপায় হয়ে যাবে, জামশেদ তাকে মাত্র একটা গুলি খরচ করে জীবনখেলা সাঙ্গ করে দেবে। তার চেয়ে সত্যের পথে গিয়ে মৃত্যুকে বেছে নিলে কেমন হয়?
ঠিক সেই সময়েই মুঠোফোন বেজে উঠলো। ইমতিয়াজ মুঠোফোন হাতে নিতেই জামশেদের ছবি ভেসে উঠলো। রিসিভ করতেই জামশেদ বলে উঠলো, ‘ইমতিয়াজ আমার সেকেন্ড ইন কমান্ড, জেগে আছো?’
‘হ্যাঁ, বস। জেগে আছি। বলুন কী করতে হবে?’
কানাডায় তোমার বাসায় রেখে আসা চিরকুট ইরফানদের হাতে পৌঁছেছে। নিয়াজ আমাকে ইনফরমেশন দিয়েছে। তারা মরিশাশে আসছে। তুমি প্রস্তুত থেকো।’
ইমতিয়াজ মনে মনে হাসলো। তারপর বললো, ‘ঠিক আছে বস। আমি আমার কাজ চালিয়ে যাবো চিন্তা করবেন না’।
‘খুবই প্রীত হলাম। তুমি আমার একান্ত বিশ্বস্ত ডানহাত। তোমার ওপর যে কোনো দায়িত্ব দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে পারি। শুভ রাত্রি।’ (চলবে)








