প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:১৯
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

(ছেচল্লিশতম পর্ব)
|আরো খবর
চেনা মানুষের মুদ্রাদোষ : মুদ্রাদোষ কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু কখনও কখনও তা বিরক্তি উৎপাদন করে। মুদ্রাদোষ দিয়ে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সহজ হয়। কোনো আচরণ যদি ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘন ঘন প্রতিপাদন করে তবে তা ঐ ব্যক্তির মুদ্রাদোষ বলে পরিগণিত হয়। অনেক বিখ্যাত মানুষও মুদ্রাদোষে আক্রান্ত ছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লেখার সময় প্রশান্ত মুখে বারে বারে তাঁর ডান উরুতে হাত ঘষতেন। এটাই তাঁর মুদ্রাদোষ ছিলো। নজরুলের মুদ্রাদোষ বলতে হৈ হুল্লোড় ও অস্থিরতা। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য শান্তিদেব ঘোষ মুদ্রেদোষে বার বার মাথা চুলকাতেন। আর সৈয়দ মুজতবা আলী খালি আঙুলে চুল প্যাঁচাতেন। এগুলো অন্যের জন্যে ক্ষতিকর না হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দ্রষ্টব্যবাচক বিশেষত্ব হিসেবে পরিগণিত হয়। আমার জীবনে দেখা এমন অনেক মানুষের কিছু কিছু মুদ্রাদোষ মনে রাখার মতো।
আমাদের বাবার সহকারী ছিলেন একজন, যিনি ভাত খাওয়ার সময় বেশ আওয়াজ করে খেতেন। অনেকটা দূর থেকে ভাতের গ্রাস মুখের কাছে আনার আগ পর্যন্ত তিনি হাওয়া টানতেন মুখে। এতে তার মুখ হেলিকপ্টারের মতো আওয়াজ করতো। একবার তার সাথে খেতে বসে আমি এ আওয়াজে বিব্রত হই। বলতে বাধ্য হই এক পর্যায়ে, দাদা, খাবারের সাথে মশামাছি ঢুকলে কিন্তু সর্বনাশ। তিনি এরপর কিছুটা শোধরানোর চেষ্টা করেছিলেন। আমার তুতো ভগ্নিপতিদের একজন ছিলেন যিনি খেতে গেলে এমন আওয়াজ করতেন যেন গরম আলু গিলে খাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে তাকে শুনতে হতো বন্ধু-বান্ধবের কথা, ভাই! গরম খাবার না খেলেই তো হয়। তিনি এ কথা বুঝতে পারলেও মুচকি হেসে মেনে নিতেন। সবার সাথে খেতে বসলেও জাকির ভাই খাওয়া শেষে এমনভাবে আঙুল চুষতেন, মনে হতো তিনি আঙুলের হাড় থেকে মাংস ছাড়াচ্ছেন৷ এ প্রসঙ্গে চিত্রশিল্পী মুর্তাজা বশীরের স্মৃতিকথা মনে পড়ে যায়। তিনি বলেছেন, খেতে বসলে তারা ভাইবোনদের কারও খাবার যদি কোনো আঙুলের দুই করের ওপরে উঠে যেতো তবে তার কপালে শনি ছিলো। কারণ মা তাতে কাঠি দিয়ে আঙুলে বাড়ি দিতেন। তিনি বলতেন, খাবার আঙুলের দুই করের ওপরে উঠে ছোটলোকের। তুই কি ছোটলোক? মুর্তাজা বশীর হলেন জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে। অনেকটা এ রকম ঘটনা আমাদের ঘরেও ঘটতো। আমার বড়দাসহ অনেকেরই ভাতের গ্রাস ধরার সময় ডান হাতের তর্জনী সিধা হয়ে যেত। মা এবং মেজদি অনেকবার কাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে আঙুল ঠিক করাতেন। মেজমামা-ছোটমামার অভ্যাস ছিলো ভিন্নরকম। তারা একা থাকলে ডান হাতের তর্জনি দিয়ে হাওয়ায় লিখতেন কিংবা আঁকতেন। তাদের এই মুদ্রাদোষ কারও জন্যে হানিকর ছিলো না বরং ওনারা হাওয়ায় হাত হাঁটিয়ে কী লিখছেন তা জানার কৌতূহল থাকতো। আমার ছোটবোনকে যিনি হাতেখড়ি দেন, তিনি খন্ড-ত-কে বলতেন পান্ডি-য়-ত। কেন বলতেন তা আমাদের মাথায় আসতো না। অনেক কষ্টে ছোটবোনের এই পান্ডি-য়-ত-কে খন্ড-ত করতে হয়েছিলো। ছোটবেলায় শিখা টিচার ছিলেন, যিনি কোনো ঘামওয়ালা মানুষ দেখলেই নাকে কাপড় দিতেন। ওইসব ঘামওয়ালা শরীর থেকে উগ্র কোনো ঘ্রাণ না এলেও। মামাবাড়িতে একজন লোক ছিলেন যিনি চা সবসময় সাথে দেওয়া পিরিচে ঢেলে পান করতেন। প্রথমে হাল্কা একটু চা ঢেলে পিরিচ পরিষ্কার করতেন। এরপর দুদফায় পিরিচে চা ঢেলে চা পান করতেন। পরে এরকম মুদ্রাদোষের আরও অনেককেই দেখেছি।
আমাদের গ্রামে বিপুলদা ছিলেন, যার কাজ ছিলো পথ দিয়ে যাওয়া শিশুদের ডেকে ডেকে দাঁত পরীক্ষা করা। কোনো দাঁত নড়লে তিনি আপনাআপনি ফেলে দিতেন। আমাদের স্কুলবন্ধু শিব শঙ্কর সবসময় নাকে আঙুল ঢুকিয়ে ময়লা বের করতো। ময়লা থাক বা না থাক। কথা বলতে বলতে সে বেশ কয়েকবার নাকের ছিদ্রে আঙুল ঢুকিয়ে দিতো মুদ্রাদোষবশত। আমাদের এক স্যার ছিলেন যিনি কথায় কথায় হাতকে প্যান্টের বিশেষ জায়গায় নিয়ে চুলকাতেন। এটা একবার-দুবার নয়, অনেকবার ছেলেরা পরখ করে নিশ্চিত হয়েছে। এটা আসলে চুলকাতো না। এটা ছিলো তার মুদ্রাদোষ। সোফায় বসে ঝিমুতে দেখেছি অনেককেই। বসলেই ঝিমায়। আবার ডাক দিলেই সজাগ। এ এক আশ্চর্য জাদু যেন। মহিমকাকা ছিলেন, কোথাও বসলেও পা নাচাতেন। অথচ অন্যদের ত্রুটি ধরতেন পা নাচানোর জন্যে। কিন্তু তার পা ঠিকই নাচাতেন। পাশের বাড়ির এক প্রতিবেশী বয়স্কা নারী ছিলেন যিনি ট্যাপের পানি ব্যবহার করার সময় আগে পানি দিয়ে ট্যাপের ওপরের অংশ ধুয়ে ফেলতেন। তিনি যতবার ট্যাপ খুলতেন ততবারই এ কাজটা করতেন।
মেডিকেল কলেজে এক ছাত্রনেতাকে পাই যিনি মিনিটে মিনিটে চোখ টিপতেন। প্রথম প্রথম মেয়েরা খারাপভাবে নিতো। পরে জানতো যে, এটা তার মুদ্রাদোষ। আমার এক দূর সম্পর্কের মামা ছিলেন, যিনি বেশ ঘন ঘন চোখ পিট পিট করতেন। এটাই তার স্বভাব ছিলো। গ্রামের কাকা তার চাকরির প্রথম মাস শহরে আমাদের বাসায় ছিলেন। তাকে তখন কাছ থেকে দেখেছি। ভাত খাওয়ার আগে তিনি দুয়েক দানা লবণ জিভে দিতেন। তারপর মুখে ভাত দিতেন।
জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা প্রমিত বাংলায় কথা বললেও ‘প্রথম’ শব্দটি উচ্চারণ করতে গেলে তিনি সবসময় ‘পোরথম’ বলতেন। একজন সাংবাদিক বড়ো ভাই আছেন যিনি ‘উপবিষ্ট’ শব্দটিকে ‘উবিষ্ট’ বলেই উচ্চারণ করতেন। এটা তার ঘাটতি নয়, এটা আসলে ছিলো মুদ্রাদোষ।
আমার পিসতুতো ভাই উৎপল সবসময় পকেটে চিরুণি রাখতো। একটু পর পর সে মাথায় চিরুণি চালাতো। চুল ঠিক থাকলেও চালাতো। এজন্যে তাকে সবাই ‘সুরুত আলী’ নামেও ডাকতো। কারণ তখন টেলিভিশনে কোনো একটা নাটকে এরকম একজন সুরুত আলী ছিলো যার কাজই হলো চুলে ফ্যাশন বজায় রাখার জন্যে ঘন ঘন চিরুণি চালানো। গ্রামে এক কাকা আছেন যিনি রাগ হলে বলতেন, একদম কাঁচা মরিচের মতো চিবিয়ে খেয়ে ফেলবো। এরপর থেকে তাকে দেখলেই তার নাতি সম্পর্কের ছেলেরা বলতো, দাদু, কাঁচা মরিচের মতো খেয়ে ফেলবো। তিনি হেসে দিতেন। আমার এক দুলাভাই ছিলেন, যিনি ছেলেমেয়েকে শাসন করতে গেলে বলতেন, মেরে একদম হাড়ে ট্যাপ ফেলে দিবো। এটা পরে তার মুদ্রাদোষে পরিণত হয়। আরেক সাংবাদিক ভাই আছেন আমার এলাকায়। তিনি কথায় কথায় সবাইকে মামলার ভয় দেখান। পরে সবার ধারণা পাকা হয়ে গেলো, এটা তার মুদ্রাদোষ।
প্রয়াত একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক ছিলেন যিনি সমাজকর্মে নানা অবদান রেখেছেন। তিনি প্রতিটা কথা দুবার বলতেন। তার এই রিপিটেশন পরিচিতজনদের কাছে মুদ্রাদোষ হিসেবেই পরিগণিত হয়। দেখা যায়, তাঁর পাঁচ মিনিটের বক্তব্যে আসলে তিন মিনিটের সারমর্ম আছে, বাকিটা পুনরুক্তি। আমার শিক্ষাচার্য, কিংবদন্তি চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী স্যারের একটা মুদ্রাদোষ ছিলো। তিনি রোস্ট্রামে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে বড়শিতে আটকানো কই মাছের মতো একটা ঊর্ধ্বমুখী ধাক্কা দিতেন। তাঁর এই অভ্যেসটা আমাদের সবার একটা প্রিয় দৃশ্যে পরিণত হয়ে গেলো। স্যারকে বক্তব্য দিতে দেখলে এবং এ দৃশ্য না দেখতে পেলে আমাদের মনে অতৃপ্তি থেকে যেতো। স্যারের এই মুদ্রাদোষ কলেজের সম্পদে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো একসময়। আমাদের কমিউনিটি মেডিসিনের শিক্ষক হারুণ স্যার প্রায়ই বলতেন, আজ আর পড়াবো না। আমার বল পড়ে গেছে। এটাই ছিলো স্যারের এক বিখ্যাত মুদ্রা দোষ। কলেজিয়েট স্কুলের স্যার দীপু নন্দী ছাত্রদের মারতে হলে বলতেন, আয় মেরামত করি। তার এই মেরামত সবার মনে ভীতি আনতো। পরে এই মেরামতই স্যারের মুদ্রাদোষে পরিণত হয়। আরেক স্যার রাগলেই কথায় কথায় বলতেন, বেশি বাড় বেড়ো না। টিসি দিয়ে দিবো। ক্ষুদ্র অপরাধেও স্যার এ ভয় দেখাতেন। বুঝতে আর তখন বাকি থাকে না, এটা তার মুদ্রাদোষে পরিণত হয়ে গেছে। সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুলের টিচার নিরুপমা পাড়ে রেগে গেলে বলতেন, কান টেনে লম্বা করে দেবো। তার আর কোনো কথা ছিলো না। শুধু কান টেনে লম্বা করে দেওয়ার কথা বলতেন। মিসেস এমবি রয় টিচারের মুদ্রাদোষ ছিলো, তিনি কথায় কথায় বলতেন, অ্যাই ছেলে, ম্যালা কাবিল হয়ে গেছো? এটাই তিনি ঘন ঘন বলতেন বিরক্ত হলে কারও প্রতি। রেমন্ড দাস স্যার বোর্ডে একটা কিছু লিখে শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে বলতেন, কে আছো সেই বীর যে এটা সমাধান করতে পারে? এটাই ছিলো তার মুদ্রাদোষের বাণী। ফিজিওলজির টিচার শাহ আলম স্যার টিউটোরিয়ালে বলতেন, কথা হইলো ইউ হ্যাভ টু বুঝতে হবে। এটাই তার মুদ্রাদোষ। কলেজিয়েট স্কুলের জহিরুল হক স্যারেরও মুদ্রাদোষ ছিলো। ছাত্ররা কোনো গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে স্যারকে চেক করে দিতে বললে স্যার দেখে বলতেন, হইছে তবে জিরো পাইবা। এটাই ছিলো স্যারের মুদ্রাদোষ। ক্লাসে পন্ডিত স্যার পড়াতে গেলে কারও অমনোযোগিতা ধরা পড়লে তার দিকে চকের ছোট টুকরো ছুঁড়ে দিতেন। এতে ঐ ছাত্র আঘাত পেতো না, কিন্তু সচকিত হতো। এটা পন্ডিত স্যার প্রায়ই করতেন। আমাদের হেড স্যার ‘আজকে’ শব্দটা প্রমিত ভাষায় উচ্চারণ করতে পারতেন না। তিনি অপিনিহিতি জনিত প্রমাদে বলতেন, ‘আইজকা’। এটাই তার মুদ্রাদোষ।
আমাদের পাড়ায় যিশু নামের একটা ছেলে ছিলো। সাদাসিধা। তাকে তার মা কেন যেন ধলা পাঁঠা বলে ডাকতো। কোনো কথা নেই, একটু পান থেকে চুন খসলেই তিনি বলতেন, এই ধলা পাঁডা; ইবা কী গরলি? বিমল স্যারের ছোট ছেলে নাচের গুরু। তিনি হাঁটতে গেলেও নৃত্যমুদ্রা ফুটে উঠে। মানুষ তাকে তার হাঁটার ভঙ্গিতেই চিনে নেয়। এটাই তার সুবিদিত মুদ্রা দোষ।
জীবনে চলার পথে এ রকম নানা পদের মানুষের সংযোগ ঘটেছে। সবারই কিছু না কিছু মুদ্রাদোষ আছে। কিছু কিছু মুদ্রাদোষ হানিকারক। কিছু কিছু মুদ্রাদোষ সহনীয়। আর কিছু কিছু মুদ্রাদোষ এতোই নান্দনিক যে, তা অন্যের জন্যে অনুকরণের উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। মুদ্রাদোষের ঝাঁপি নিয়ে বসলে মহাভারতের পুঁথি হয়ে যেতে পারে। তাই এ পর্বে এতোটুকুতেই থেমে যেতে হলো। পরবর্তী পর্বে নূতন কোনো বিষয় নিয়ে অখণ্ডতায় এগিয়ে যাবো আশা করি। (চলবে)







