সোমবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩৩ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ০৯:০১

যতীন সরকারের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

জীবনকে বোঝার জন্যে সাহিত্যের কাছে যেতেই হবে

অনলাইন ডেস্ক
জীবনকে বোঝার জন্যে সাহিত্যের কাছে যেতেই হবে

২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা গিয়েছিলাম। ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন গল্পকার মঈনুল হাসান ও মনি হায়দার। ৫ ফেব্রুয়ারি গল্পকার মেহেদী ধ্রুব, তৎকালীন জেলা কালচারাল অফিসার মো. রাসেলসহ অধ্যাপক যতীন সরকার স্যারের বাসা ‘বানপ্রস্থ’-এ যাই। আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কবি ও শিক্ষক সরোজ মোস্তফা। করোনার প্রকোপ চলছিলো। তবু স্যার দু ঘণ্টার বেশি সময় দিয়েছিলেন। সেসময় কিছুক্ষণ তাঁর সাক্ষাৎকার রেকর্ড করি। সেই কথোপকথনের কিছু অংশ প্রকাশিত হলো।

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান : অনেকেই বলেন সাহিত্য করে কী হয়? এ বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাই।

যতীন সরকার : আমার দৃষ্টিতে যাদের প্রতিভা আছে তারাই সৃষ্টিশীল সাহিত্য করে।

সংস্কৃত অনুযায়ী প্রতিভা হলো ‘অপূর্ব বস্তু নির্মাণক্ষম প্রজ্ঞা’। অপূর্ব বস্তু নির্মাণ করার ক্ষমতা-সম্পন্নের প্রজ্ঞার নাম প্রতিভা। কাজেই যারা অপূর্ব বস্তু সৃজন করতে পারেন তা সেই অপূর্ব বস্তুর দ্বারা বহু মানুষকে প্রভাবিত করেন। কিন্তু আমি নিজে সাহিত্যিক নই। কারণ প্রতিভা বলে কোনো জিনিস আমার ভেতরে নেই। এটা আমার বিনয়ের কথা। কারণ আমি নিজেকে খুব ভালো রকম চিনি। প্রতিভার বস্তুমাত্র আমার মধ্যে নাই।

তবে যেটা আছে সেটা হলো বিভিন্ন জায়গায় পড়শোনা করেছি। আমার সমাজকে আমি দেখেছি। এগুলো থেকে আমার অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করলাম আমার অভিজ্ঞতাগুলো অনেকেরই নাই। আমি গ্রামে থাকি। কখনওই ঢাকা থাকিনি। বড়জোর একমাস থেকেছি। যেহেতু আমি গ্রামে থাকি তাই গ্রামের কৃষকদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কাজেই আমার সেই ‘পাকিস্তানের জন্মদর্শন’-এ যে সমস্ত লেখেছি, কলকাতার ‘মানবমন’ পত্রিকা বলেছে এটি হলো কৃষক মনঃস্তত্ত্বের ঘনিষ্ঠ দর্পণ। তারা যথার্থই বলেছে। কারণ আমি নিজে কৃষক নই। আবার সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ বলে সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে দূরেও ছিলাম না। কিন্তু খেতের আল থেকে আমি কৃষকদেরকে দেখিছি। কাজেই কৃষককে আমি যেভাবে বুঝি এভাবে কৃষকরা নিজেদেরকে নিজেরা বুঝে না। আর যারা নাকি কৃষকের চেয়ে অনেক উপরে আছে তারা তো বোঝেই না। কৃষকদের মনস্তত্ত্বকে ধরেই আমার যত লেখা। কাজেই আমার লেখা কোনো সাহিত্য না। আগেই বলেছি অপূর্ববস্তু নির্মাণক্ষম প্রজ্ঞার প্রতিভার বাষ্পমাত্র আমার মধ্যে নাই।

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান : সাহিত্যের শক্তিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

যতীন সরকার : সাহিত্যের শক্তি তো অসাধারণ। কারণ সাহিত্যিকরা প্রতিভার দ্বারা অন্যকে প্রভাবিত করেন। সাহিত্যের শক্তি ‘সহিত’ ও ‘হিতে’র সঙ্গে বর্তমান। ‘সহিত’-এর থেকে ‘সাহিত্য’ শব্দটি এসেছে। কিন্তু যারা সাহিত্যকে শুধু সাহিত্য হিসেবেই দেখে তাদের মতের সাথে আমার মিল নেই। জীবনের সঙ্গেই সাহিত্য যুক্ত। কাজেই জীবনকে বোঝার জন্যে সাহিত্যের কাছে যেতেই হবে। কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে আমাদের দেশে বড় হয়ে গেছে ‘কবিতা’। বিপ্লবী বিপিন পালের ‘সত্তর বছর’ (১৯৫৪) বলে একটা বই আছে। এটি তাঁর আত্মজীবনী। তার মধ্যে একটি কথা আছে। কথাটি আমার খুব মনে ধরেছে। তিনি বলছেন, ‘আঠার বছর বয়সের আগে যিনি কবিতা লেখে না তিনি মানুষই না। আর আঠার বয়সের পরে যে কবিতা লেখে সে হয় পাগল, না হয় কবি।’ কিন্তু কবি কয়জন? সত্যিকার অর্থে আমাদের বাংলা ভাষায়, বাংলা সাহিত্যে কবি কয়জন? যেমন শামসুর রাহমানকে কবি বলি, নির্মলেন্দু গুণকে কবি বলি, মহাদেব সাহাকে কবি বলি আর আল মাহমুদ তাঁদেরকে কবি বলি। আর অজস্র কবিতার বই...। একজন নারী যিনি বিশটা কবিতার বই লিখেছে, এর মধ্যে আবার একটি কবিতার বই তিনি আমাকে উৎসর্গ করেছেন। সুকুমার বড়ুয়া তাঁর একটি ছড়ায় লিখেছেন, ‘এক কবিকে কাব্য লেখেন আরেক কবি বুঝেন/বাদবাকিরা খাটিয়ে মাথা মর্মবাণী খোঁজেন।/মর্মবাণী খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ যদি হন/কবি বলেন কাব্য বোঝার যোগ্য সবাই নন।’

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান : আপনি দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন এবং প্রসারিত জীবন পেয়েছেন, যেটা কর্মময় জীবন। এখন কোনো কিছু কি অপূর্ণতা রয়েছে কি না? আপনার কি মনে হয়। আপনি কী করতে চেয়েছেন জীবনে?

যতীন সরকার : সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে আমার জীবনে অপূর্ণতা ছিল না। নিজের জীবনে আমি যা চেয়েছি, তা খুব সাধারণ চাওয়া ছিল। আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন চন্দ্রনাথ স্কুলে ভর্তি হয়ে এক বছর পড়েছিলাম। আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপক সুদেন্দ্র চক্রবর্তীর বক্তৃতা শুনছিলাম। বক্তৃতায় তিনি যা বলছিলেন তা এখনও মনে আছে আমার। আমি ছেলেবেলা থেকেই ইঁচড়েপাকা ছিলাম। আমার পরিবারই আমাকে ইঁচড়ে পাকা বানিয়েছে। ছেলেবেলা থেকে পাঠ্যপুস্তকের সাথে আমার সম্পর্ক কম ছিলো। অপাঠ্য (সহপাঠক্রমিক) সব বই ছিলো আমার পড়ার আগ্রহে। ক্লাস থ্রিতে থাকাবস্থায় আমি শরৎচন্দ্রের তিন-চারটা বই পড়ে শেষ করি। ম্যাট্রিক পাস করার আগেই বঙ্কিমচন্দ্র শেষ করেছি প্রবন্ধসহ। পাঠ্যপুস্তক খুব বেশি একটা পড়তাম না। অঙ্কে খুবই কাঁচা ছিলাম। ৩৩ নম্বর পেয়েছি। তখন তো ৩০ নম্বরে পাস ছিলো। তাই আমি গর্ব করে বলতাম ৩ নম্বর বেশি পেয়েছি। এভাবেই আমি এমএ-ও পাস করি। তো ওইদিন আমি সুদেন্দ্র চক্রবর্তীর বক্তব্য শুনে মনে হলো কলেজের প্রফেসরের চেয়ে বড় আর কিছু নয়। কাজেই আমাকে প্রফেসর হতে হবে। সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম। আমি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কাজেই দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করতে পারবো না। দারিদ্র্যের সঙ্গে সহাবস্থান করেই এ জীবন চালিয়ে এসেছি। আমি কলেজের প্রফেসর হয়েছি। এর চেয়ে বড় কিছু পাওয়ার আমার স্বপ্ন ছিলো না। ‘প্রফেসর’ হিসেবে নই, আমি বলি ‘শিক্ষক’ হিসেবে আমি সার্থক। খুবই সার্থক। অন্যকিছুতে আমার সার্থকতা নেই। এই যে লেখালেখি, সত্যি কথা বলতে, আমার লেখা আমার নিজেরই পছন্দ হয় না। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে আমি সার্থক। আমি ব্যাকরণ পড়াতাম। ব্যাকরণ হলো একটি রস-কষহীন বিষয়। অনেকেই বোঝে না। কিন্তু আমার ব্যাকরণ ক্লাসে আনন্দমোহন কলেজের ছাত্ররাও এসে ক্লাস করতো। কাজেই এ ব্যাকরণটাই আমি যেভাবে পড়াতে পারতাম সেখানে আর কেউ পড়াতো পারতো না। আমি একবার দেড় বছর জেলখানায় ছিলাম। জেলখানায় বসে আমি কী করবো। আমার লেখালেখির কিছু নাই। ব্যাকরণ পড়াতাম। তখন ‘ব্যাকরণের ভয় অকারণ’ নামে একটি বই লিখি। প্রবন্ধ লিখি।

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান : পিএইচডি গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক। ভারত ও বাংলাদেশে প্রকাশিত গ্রন্থ : ৩০টি।

নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক শপথ, মুঠোফোন : ০১৮৭৫৬২৬৯৮৮ www.facebook.com/Muhammad.forid.hasan www.faridhasan.com

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়