প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৫, ০০:১৫
হৃদয়বতী

পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তিন.
জীবন--একেকজনের কাছে একেকটা অনুভূতির পরিণাম। রেলস্টেশনে বসে বসে ভাবছে ইরফান। এই অনুভূতি একেকজনের ভিন্নমাত্রায় আসে পরীক্ষা হিসেবে। যখন একজন মানুষ একা অন্ধকারে হঁাটে, তার যে অনুভূতি পক্ষান্তরে যে মানুষটি ঝড়ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সাগরে নৌযান থেকে যখন তলিয়ে যায়, তখন তার অন্য এক অনুভূতি। যে মানুষটি হাজার কোটি টাকার মালিক, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে, প্রেমিকা নিয়ে আলাদা এক জগতে বসবাস করছে তার অনুভূতি ভিন্ন। আর যে মানুষটি সারাটি জীবন কাউকে প্রাণপণে ভালোবেসে তাকে সংসার জীবনে পেলো না তারও আরেক অনুভূতি।
ইরফান কখনোই চায় না তার বর্তমান এমন বিরূপ অনুভূতি, যা সে কখনোই সহ্য করতে পারবে না। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার এই ১৫ দিনের ছুটির সময় ভবঘুরে অনুভূতি নিয়ে কাটাবে।
আর ভাবছে, কখনও বিয়ে-শাদী করবে না, তবে ছুটির ফঁাকে পৃথিবীর সব প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে মানুষের সুন্দর-অসুন্দর অনুভূতিগুলো দেখে দেখে কাটাবে। সে চেক করে দেখেছে তার একাউন্টে অনেক টাকা জমা হয়েছে। বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসার টাকাগুলো তারই নামে ব্যাংকে পড়ে আছে বহুদিন ধরে। ক্রেডিট কার্ড আছে, যখন যেখানে মনে চায় খরচ করতে পারে। কিন্তু তার কেনো এমন হলো, এতো অর্থ থাকার পরও কেনো সে যা চেয়েছে তা পায়নি। এটা কীভাবে সম্ভব যে, যে মানুষটিকে সে ভালোবেসেছিলো সেই মানুষটি নিরুদ্দেশ। অনেক খুঁজেও তার হদিস সে পায়নি ক’দিন ধরে। মনে মনে ভাবে, ঠিক আছে। তুমি যখন আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারছো, তাহলে আমি তোমাকে রেখেই চলে যাচ্ছি বহুদূরে। গন্তব্য অজানা। দেখি পথ আমাকে কোথায় নিয়ে যায়। পথের সাথে সন্ধি আমার, পথের মাঝে বন্দি--এই জনমে পথে পথে তোমায় পাবার ফন্দি।
ভাবতে ভাবতে সময় গড়ায়, এক সময় ট্রেন চলে আসে। ভাবনা কেটে যায় তার। সে ধীরে ধীরে ট্রেনের কামরায় উঠে নিজের সিট খুঁজে বসে পড়ে। ধীরে ধীরে ট্রেন চলছে কক্সবাজারের পথে। সে উঠেছে ঢাকা থেকে। সুন্দর আসন। হেলান দিয়ে বসে বসে ভাবছে কক্সবাজার গিয়ে সে কী করবে, কতোবারই তো সে সেখানে গিয়েছে। তখন সঙ্গী-সাথী বন্ধু-বান্ধব তুষার আহমেদ ও অনির্বাণ ছিলো, ছিলো একরাশ আনন্দ। কিন্তু আজ সে একা, একা জীবনে কি আনন্দ আছে?
হঠাৎ করেই তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। আরে আমি তো একা নই। আমার মনটাই তো একা। এই কামরায় তো কতো মানুষ আছে, তাদের সাথে ভাব জমিয়ে নিলেই তো সে সঙ্গী খুঁজে পেতে পারে।
ট্রেন চলছে। ঢাকা শহর ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে এসেছে। এখন শুধু চারদিকে গাছপালা আর ক্ষেত দেখা যাচ্ছে। আসলে শহুরে জীবন ছেড়ে মানুষ যখন গ্রামের পথে গাছপালা দেখতে দেখতে ছুটতে থাকে, তখন গাছের সাথে মানুষের মিতালী এক অপার্থিব আনন্দের ঢেউ তোলে, যা অর্থ সম্পদ দিয়ে কেনা যায় না।
ইরফান উঠে পড়ে। এই কামরায় প্রায় পঞ্চাশ জনের মতো মানুষ আছে। ট্রেনটি রাতের বেলায় ছেড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষই ঘুমে কাতর। ট্রেন দুলছে আর মানুষগুলো ঘুমের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। সে এগুচ্ছে কামরার মাঝপথ দিয়ে। এ সময় দেখলো পাশাপাশি দুটি ডাবল সিটে তিন তরুণী বসে আছে আর কথা বলছে। তাদেরকে দেখেই তার কেমন যেনো আপনজন মনে হলো। এদের বয়স প্রায় বিশ-একুশ-বাইশ হবে। হয়তো সবেমাত্র কলেজের ইন্টারমিডিয়েট বা গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। তবে মেয়েগুলো বেশ মিষ্টি। আরো ভালো করে তাদের দিকে তাকালো ইরফান-- চেহারায় প্রায় একই, তিনজন বান্ধবী, নাকি বোন? ইরফানকে পাশ দিয়ে যেতে দেখেই তারা কেমন যেনো চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। একজন তো ফিক করে হেসেই ফেললো। তারপর অন্যজনের কানে কানে কী যেনো বললো।
ইরফান হঠাৎ তাদের পাশে গিয়ে দঁাড়ালো। তারপর বললো, ‘টিকেট আছে?’ মেয়েরা ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেলো। কেউ কোনো কথা বলছে না। ইরফান আবার বললো, ‘টিকেট আছে?’
ওরা না-সূচক মাথা নাড়ালো। তারপর একজন বললো, ‘আপনি কি টিকেট চেকার? টিটিই? ইরফান হাসলো। তারপর তার প্রশ্নের উত্তরে বললো, ‘না। আমি টিটিই নই, তবে আপনাদেরকে দেখে মনে হলো যেনো বাড়ি ছেড়ে পালানো মেয়ে। ঠিক না? বাড়ি ছেড়ে পালানো মেয়েদের টিকেট থাকে না!’
মেয়েরা তো নির্বাক। তারা যেনো ভয় পেলো। এবার একজন মেয়ে কথা বললো। সে বললো, ‘যেহেতু আপনি টিটিই না। তাহলে আমাদেরকে প্রশ্ন করলেন কেন? টিকিটের টাকা দিয়ে দিবেন?’
এবার সত্যিই মজা পেলো ইরফান। সে নিজকে একা ভেবেছিলো, আসলেই তো বুদ্ধি থাকলে একাকিত্ব কাটানো যায়। এবার এই মেয়েরাই তার একাকিত্ব ঘুচাবে। সে প্রশ্ন করলো, ‘কী নাম আপনার?’
‘আমি অনন্যা, ওরা দুজন আমার বোন রুবিনা ও তাসফিয়া।’ উত্তর দিলো অনন্যা।
‘ভালোই হলো আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে। ঠিক আছে। টিটিই আসলে ওই সিটে আমি আছি। আমাকে দেখিয়ে দিবেন। আমি টিটিটের টাকাটা সলভ করে নিবো।’
ইরফান একথা বলে চলে যাচ্ছিলো, আবার ফিরে আসলো। তারপর অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ওহ, সরি। আমার নাম ইরফান। বলতে পারেন মি. ভবঘুরে। আনাচে-কানাচে, পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোই আমার স্বভাব। অর্থ কোনো সমস্যা না, তবে জানেন তো, অর্থই অনর্থের মূল!’
তিন মেয়েই ইরফানের ব্যতিক্রমী কথায় হেসে উঠলো। তাসফিয়া তো হাসি থামাতেই পারছে না। সে ভাবলো, এমন মজার মানুষও হয়?
ইরফান সব কামরা ঘুরেফিরে আবার অনন্যাদের কাছাকাছি দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। এমন সময় অনন্যা ডাক দিলো, ‘এই যে এখানে বসুন। আমাদের পাশে একটা সিট খালি আছে। এখানে কেউ আসেনি।’
ইরফান ইতস্তত না করেই বসে পড়লো। তারপর বললো, ‘আপনারা যাচ্ছেন কোথায়?’
তাসফিয়া ফিক করে হেসে ফেললো, তারপর উত্তর দিলো--‘এই ট্রেনটি যেখানে গিয়ে শেষ মাথায় থামবে ঠিক সেখানেই আমরা যাবো।’
‘ভালো।’ উত্তর দিলো ইরফান। তাহলে ‘আমাদের চারজনেরই গন্তব্য একই।’
তাসফিয়া প্রায় হাততালি দিতে যাচ্ছিলো। কিন্তু কামরার মানুষজন ঘুম ভেঙ্গে তাদের দিকে অন্য চোখে তাকাবে, সেই ভয়ে হাততালি দিলো না। তবে খুব খুশি হয়ে বললো, ‘ভালোই হলো ইরফান ভাইয়া। মনে হয় আমাদের সবারই নসিবটা একই পথে বঁাধা।’
‘কী করে বুঝলে তুমি?’ ইরফান হাসলো।
উত্তর দিলো অনন্যা। সে বললো, ‘ও আমাদের ছোট বোন তো। ক’ বললেই কলকাতা বুঝে ফেলে।’
‘ঠিক তাই।’ হাসলো রুবিনা। ‘আমার বোনটা ছোট হলেও জ্যোতিষ শাস্ত্রে এক্সপার্ট।’
ইরফানের মনে হলো আর কি চাই, নিঃসঙ্গতা তো আর নেইরে ভাই। এদের কথায় তার মনটা ভরে গেলো। মনে হলো আজ সে অমানিশার অঁাধারের সুড়ঙ্গ থেকে আলোর একঝঁাক ঝলকানি খুঁজে পাচ্ছে। সে মনে মনে আরও ভাবলো, আর কিছু চাওয়ার নেই। হঠাৎ করেই এক অচেনা ট্রেনকামরায় হৃদয় যেনো খুঁজে পেল পরিচিততার ছায়া--অনন্যা, রুবিনা, তাসফিয়া...তিনটি নাম নয়, যেনো তিনটি দিগন্ত, তিনটি মানবিক ব্যঞ্জনা, যারা নীরব শব্দে বলছে, ‘তুমি একা নও, আমরা আছি এই পথেই, গন্তব্যের আগেই’।
ইরফান জানে না ঠিক কোথায় নামবে, তবে আজ তার মন আর ভবঘুরে নয়, সে যেনো কোনো অদৃশ্য বঁাশির সুরে পরিচয়ের নতুন ছকে বঁাধা পড়েছে।
সমুদ্র তখনও ঘুম ভেঙে জেগে উঠেনি ঠিকভাবে, কিন্তু বাতাসে লবণের গন্ধ স্পষ্ট। ভোরের আলো ধীরে ধীরে গায়ে মেখে নিচ্ছে চারপাশ। স্টেশনের কোলাহল ভুলে ইরফান, অনন্যা, রুবিনা ও তাসফিয়া একটা রিকশায় উঠে পেঁৗছে গেছে কক্সবাজারের সেই পুরোনো হোটেলে, যেখানে জীবনের অনিশ্চয়তা যেন দেয়ালে অঁাকা একটি ছবি, আর জানালার ওপাশে দঁাড়িয়ে প্রতীক্ষা করে সময়।
অনন্যা চুপচাপ ব্যালকনিতে দঁাড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। ঢেউগুলো যেমন আসে, আবার ফিরে যায়, তেমনই কিছু সম্পর্ক আসে, চলে যায়। কিন্তু কিছু সম্পর্ক থেকে যায়, শুধু অনুভবের মতো।
ইরফান পাশে এসে দঁাড়ায়। বলে না কিছু, শুধু তার হাতে এক কাপ ধেঁায়া ওঠা কফি এগিয়ে দেয়।
অনন্যা একটুও তাকায় না। শুধু বলে, ‘আজ সমুদ্রটাকে কেমন যেন বোবা মনে হচ্ছে। অথচ আমার ভেতরে এত কিছু বলার আছে।’ ইরফান মৃদু হাসে, উত্তর দেয় না।
বাতাসে ওড়ে কিছু চুল, কিছু অনুচ্চ উচ্চারণ। সেখানে গল্প তৈরি হয় নীরবতায়, চোখের চাহনিতে, কাচ ভাঙ্গা আলোর মতো কিছু দুর্বোধ্য অভিব্যক্তিতে।
ভোরের আলো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েছে কক্সবাজারের আকাশে। হোটেলের ব্যালকনিতে দঁাড়িয়ে অনন্যা চুপচাপ। ইরফান তার পাশে এসে দঁাড়ায়, বলে, ‘তোমার চোখে একটা গল্প আছে, কিন্তু তুমি বলো না কেন?’
অনন্যা ধীরে ঘুরে তাকায়। ‘সব গল্প বলা যায় না, কিছু গল্প শুধু অনুভব করা যায়।’
ঠিক তখনই ইরফানের ফোনে আসে একটি ম্যাসেজ, “তুষার আহমেদের খুনের তদন্তে নতুন মোড়।সন্দেহভাজন : একজন নারী, নাম অনন্যা।”
ম্যাসেজটি দেখে ইরফান ভড়কে যায়। ভাবে, এটা কী করে সম্ভব? এমন একটা সুন্দরী মেয়ে, যার কথায়, চলনে বলনে কোনো প্রকার সন্দেহের ছাপ নেই। সে-ই কিনা একজন সন্দেহভাজন?’ (চলবে)