রবিবার, ০৪ মে, ২০২৫  |   ২৬ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৫, ১৪:০২

পে-অর্ডার আপু

ফরিদুল ইসলাম নির্জন
পে-অর্ডার আপু

রাফিয়ার ফোন। রিসিভ করতেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, ‘শুভ, আমি ঘুমের ওষুধ খেয়েছি। আমি বঁাচতে চাই। এ নির্মল পৃথিবী থেকে চলে যেতে চাই না।’ এরপর সে নীরব হয়ে যায়। মোহনার বহমান স্রোত থমকে যায়, বসন্তের কোকিলের প্রস্থান। বারবার ফোন দিয়ে চলেছি কিন্তু রিসিভ করছে না। তার পরিবারের কেউ ফোন ধরছে না। অস্থিরতায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আমি যেন অক্সিজেনবিহীন পৃথিবী গ্রহ থেকে দূরে কোথাও আছি। হৃদয়ের আগ্নেয়গিরি নেভাতে বাইরে বেরিয়ে ছুটে চলেছি তার বাসার দিকে। কিছুক্ষণ পর রাফিয়ার মায়ের ফোন। রিসিভ করতেই হাউমাউ করে আর্তনাদ। জানা গেল ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। বঁাচার আশা ক্ষীণ। কথাটি শোনার পর চোখমুখ আষাঢ়ে। একসঙ্গে পড়াশোনা। কোনো ভাই না থাকায় বোনের মতো সম্পর্ক দুজনের। তার হাসিমাখা মুখ মনের ক্যানভাসে জলছবি হয়ে ভাসছে।

তড়িঘড়ি পেঁৗছে দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে। আমাকে দেখেই রাফিয়ার মা আর বাবা জড়িয়ে ধরে কান্না। আমি সান্ত্বনা দিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটে যাই। তার কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। এক পর্যায়ে ডাক্তার জানালেন, বিপদ কেটে গেছে। তারপর হাসপাতাল থেকে তাকে নিয়ে বাসায় ফিরি সবাই।

চারপাশ ঘিরে ধরেছে তাকে। সে যেনো ভিন্ন জগতের কেউ। অথবা সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন ছুড়তে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমার চোখ রাফিয়ার দিকে পড়তেই, রকস্টারের মতো চিৎকার দেয়। মনের আকাশে কালো মেঘের জমাট ভেঙে যায়। হৃদয়ে জমানো সব দুঃখের বাণী সে বলতে থাকে। তারপর জানা যায় মূল কাহিনীর চিত্রপট। শফিক তাকে ফঁাকি দিয়ে অন্য কারও সঙ্গে ঘর বেঁধেছে। এ যুগে কেউ এমন হয়! যদিও আমিও একসময় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পাথরের মতো কঠিন মানুষ হয়েছি। আবেগ ইরেজারে মুছে ফেলেছি। বাস্তবতা বন্দি করেছি জীবনপথে। নিজে কঠিন, তাই বলে অন্যকে কঠিন ভাবা উচিত নয়। সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কী আছে?

রাফিয়ার চোখের জল যেন ঝরনার মতো ঝরছে। যে-কেউ এ করুণ পরিস্থিতি দেখে নিজেক ধরে রাখতে পারবে না। সবাই নীরব। কথার বাহার নেই। এবার নিজেকে প্রবন্ধকারের মতো উপস্থাপন। বললাম, ‘সবার প্রতি অনুরোধ, মনের আগুনে জলের বদলে কেউ পেট্রল ছুড়ে মারবেন না। সে মানসিকভাবে ভীষণ অসুস্থ। ভাই হিসেবে কথা দিলাম। কাল থেকে ওর চিকিৎসা আমি করাব। খুব শিগগির চাকরির ব্যবস্থার সুযোগ করে দেব। দুজন মিলে খুব পড়াশোনা করব।’ কেউ তেমন কথা বলেনি।

পরদিন থেকে রাফিয়ার সঙ্গে আমার চাকরির পড়াশোনার প্রতিযোগিতা চলে। প্রেম আর ভালোবাসা আমাদের বইয়ে বন্দি করে ফেলে। কয়েক দিন যেতেই সে বুঝতে পারে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। ভালোবাসার মানুষ অন্যজনকে বিয়ে করেছে, তাহলে সে কীভাবে ভালোবাসার মানুষ থাকে! তার জন্য জীবনের বলিদান হঠকারী সিদ্ধান্ত।

সরকারি চাকরির জন্য পে-অর্ডার দরকার। আমি তথ্য নিয়ে ব্যাংকে যাই। দীর্ঘ লাইন পে-অর্ডারের। ভেতরে যিনি পে-অর্ডার ইস্যু করছেন, তিনি ফোনে কথা বলছেন। কাস্টমারদের লাইনে রেখে এমন আচরণে হৃদয়ে প্রতিবাদী চেতনা জেগে ওঠে। মনকে বলি, ধৈর্য ধরো। কী কথা বলছে, বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ফোনে অনর্গল কথা বলছেন দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে যায়। মনের ভেতর জবাই করা মুরগির মতো ছটফট করতে থাকে। একসময় মুখ থেকে আওয়াজ চলে যায় উচ্চৈঃস্বরে, ‘দয়া করে ফোন রাখুন। একটুও কি দরদ নেই, মায়া নেই? এতগুলো মানুষকে লাইনে দঁাড়িয়ে রেখে, ফোনে কথা বলছেন। লজ্জা করে না আপু।’ আমার এ কথায় লাইনে থাকা কয়েকজন বেশ উৎসাহ পান। তারা শুরু করেন হরেকরকমের কথা। কিন্তু আজব ব্যাপার, মেয়েটি তবু ফোন রাখেন না। মেজাজ অনেক বিগড়ে যায়। বয়সে হয়তো বড়, জ্ঞানবুদ্ধিতে এগিয়ে থাকা উচিত ছিল। হঠাৎ মেয়েটি কেঁদে উঠে বললেন, ‘ও বাবারে, আমি এতিম হয়ে গেলাম।’

জানা গেল মেয়েটির বাবা মারা গেলেন। এতক্ষণ হাসপাতালে ছিলেন, তাই হয়তো ফোনে যুক্ত। এবার আমার মনের ভেতর বেশ অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে। এভাবে আপুটিকে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে না-ও পারতাম। মানুষকে না জেনে তার সম্পর্কে নেগেটিভ ভাবা উচিত নয়। আমি তো কখনও কারও সঙ্গে এভাবে কথা বলি না। তাহলে এ আপুর সঙ্গে কেন বললাম! রাতে ঘুম আসে না। সেই পে-অর্ডার আপুর কান্নাজড়িত মুখ চোখের সামনে ভাসে। নিজেকে তখন সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত মানুষ মনে হয়। ধিক্কার দেওয়ার ভাষা জানা নেই। নিজের ওপর এত তিক্ত আর বিরক্ত হইনি কখনও। এদিক-সেদিক ফিরি, কিন্তু চোখে ঘুম নেই। মুখজুড়ে ক্লান্তির ছাপ। এমন অস্থিরতা প্রেমিকা চলে যাওয়ার পরও হয়নি।

নানান চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুমিয়ে যাই। কখন বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে বুঝতে পারিনি। ঘুম থেকে উঠেই সেই ব্যাংকে চলে যাই। পে-অর্ডারের সেখানে দেখি অন্যজন বসেছেন। তার কাছে জানতে চাই গতকালের পে-অর্ডার আপুর বিষয়ে। জানালেন তার বাবা মারা গেছেন। ফিরতে দেরি হবে। কথাটি শোনার পর মনের ভেতর কথামালার প্রতিধ্বনি হচ্ছেÑ ‘তুই অপরাধী।’ খেতে পারি না, চলতে পারি না। কেমন এক অপরাধ। গলায় পাথর বেঁধে দিয়েছে কেউ। ক্ষমা চাইলে সে পাথর নেমে যাবে। এ বেদনার কথা কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারি না। রাফিয়াকে বলি, সে হেসেই উড়িয়ে দেয়। কয়েক দিন পর সেই পে-অর্ডার আপু আসেন। আমি এগিয়ে গিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘আপু, আমাকে ক্ষমা করুন।’

পে-অর্ডার আপু আমাকে চিনতে পারেননি। কী কারণে ক্ষমা, বুঝতে পারেননি। তারপর আমি কাহিনীর বিবরণ দিয়ে আবারও ক্ষমা চাই। তিনি ভীষণ লজ্জিত হন। এটা কোনো সমস্যা নয় বলে আমাকে সান্ত্বনা দেন। তখন যেন আমার বুকের ওপর বেঁধে যাওয়া পাথর নেমে যায়। শান্তি নিয়ে বাসায় ফিরি। আবার কিছুদিন পর পে-অর্ডার করতে যাই। টুকটাক কথা হয়। চাকরির আবেদনের জন্য পে-অর্ডার করতেই থাকি। রাফিয়া আরও কয়েকজনকে অ্যাড করেছে। তাদের পে-অর্ডার আমি নিজেই করে থাকি। এভাবে ধীরে ধীরে আন্তরিকতা বেড়ে যায়। আমার পে-অর্ডার না থাকলেও সেই ব্যাংকে গিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগা শুরু করে। মাঝেমধ্যে ফঁাকা থাকলে তার সামনে গিয়ে বলে আসি, ‘আপু আজ কোনো পে-অর্ডার নেই। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছি।’ তিনি মিষ্টি করে হাসেন। কাউন্টার ফঁাকা থাকলে তার সঙ্গে কথা বলি। কেন জানি পে-অর্ডার আপুকে দেখতে বা তার সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ ভালো লাগা শুরু হয়।

একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ ফোন পাই পে-অর্ডার আপুর। তার এবি পজিটিভ রক্ত জরুরি। আমার নিজের রক্তের গ্রুপ এবি পজিটিভ। তিনি ভীষণ খুশি হন। আমি ঠিকানা নিয়ে চলে যাই। পিজি হাসপাতালে গিয়ে রক্ত দিই। পকেটে জোর করে টাকা গুঁজে দেন। চাকরির পর পরিশোধ করতে বলেন। এক পর্যায়ে পে-অর্ডার আপুর সঙ্গে সখ্য আরও বেড়ে যায়।

সন্ধ্যার পর কোনো দিন ফোন দিয়ে বলেন, ‘শুভ আপনি কোথায়। ধানমন্ডির দিকে আসেন। রেস্টুরেন্টে বসে দুজন একসঙ্গে ডিনার করব।’ কোনো শুক্রবারে ফোন দিয়ে বলেন, ‘শুভ, আজ দুজন মুভি দেখব। অমুক জায়গায় আসেন।’ আরেক দিন বলেন, ‘শুভ, কাউন্টার ফঁাকা। আসেন একটু গল্প করি।’ আরেক দিন বলেন, ‘শুভ আপনার জন্য পায়েস রান্না করেছি। ব্যাংক থেকে এসে নিয়ে যাবেন।’ কোনো দিন বলেন, ‘শুভ, চলেন শপিং মলে। আপনার বয়সের একজনের জন্য কিছু পোশাক কিনতে হবে।’ সব কেনাকাটার পর আমার হাতে শপিংব্যাগ তুলে দেন। আর বলেন, এটা আপনার জন্য। আসলে এটা কোনো প্রেম ছিল না। মায়ার শেকল ছিল। তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড়। আমি পে-অর্ডার আপু বলেই ডাকতাম। এ নামেই নম্বরটি সেভ করে রাখতাম। তিনি বিবাহিত। তবে স্বামীর সঙ্গে বেশ দূরত্ব। বিশ্বাস আর ভরসার কাছে প্রতারিত হয়েছেন। একাধিক নারীতে আসক্ত স্বামী। কয়েকবার কথা দিয়েও ফিরে আসতে পারেননি। যার জন্য তিনি ভিন্নভাবে জীবনযাপনের পথে। নিঃসঙ্গ নক্ষত্রের মতো।

এদিকে রাফিয়ার জব হয়ে যায়। ভালো ঘরে বিয়ে হয়। আমার জবটাই হচ্ছে না। পে-অর্ডার আপুও চেষ্টা করছেন। আমার চাকরি না হওয়ার হতাশার জীবন কিছুটা সুখময়ী করে রাখতেন পে-অর্ডার আপু। একদিন ফোন দিয়ে বললেন, ‘শুভ, আজ কয়েক মাস পর আপনার ভাইয়া ফোন দিয়েছেন। সে সব ভুলে আবার একসঙ্গে থাকতে চায়। আর জীবনে কারও সঙ্গে জড়াবে না।’ আসলে সত্যিকারভাবে পে-অর্ডার আপুও চান তার সঙ্গে থাকতে। তবে শর্ত দিয়েছেন চাকরি স্থানান্তর করে সেই ভাইয়ার কাছে নিয়ে যেতে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, নতুন সিম নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে। সেও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। সবকিছু নতুনভাবে শুরু করবে। পে-অর্ডার আপু তাতেও রাজি।

কথাটি শোনার পর আমার মনের ভেতর কেন জানি বেদনার বাতাস বইতে থাকে। কেন জানি মনে হয় একটা শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রেম নেই, বড় আপু হন, তার পরও এটা কিসের টান! তাকে অবশ্য কোনো মায়ার টানে আটকানোর সাধ্য নেই আমার। তবে আমার বেদনা আড়াল করে সেখানে যাওয়ার পরামর্শ দিই। যুক্ত করে বলি, ‘আমার সঙ্গে আর কখনও কথা হবে না।’

তিনি জানান, ‘অবশ্যই কথা হবে। নতুন নম্বর দিয়েও কথা হবে।’ এভাবে পে-অর্ডার আপু চলে যান। যেদিন যান অনেক কিছু কিনে দেন। চাকরি না হওয়া পর্যন্ত তিনি মাসে মাসে টাকা পাঠাবেন, সেটাও আমাকে বলে যান। ঠিকঠাকমতো যেন খাওয়াদাওয়া করি, শরীরের যত্ন নিই। আরও কত ধরনের পরামর্শ।

পে-অর্ডার আপু যাওয়ার পর ফোন বন্ধ। অনেক চেষ্টা করেও ফোন খোলা পাই না। বেশ অস্থির হয়ে যাই তার খেঁাজ পাওয়ার জন্য। কিন্তু কোনো উপায় নেই। আমার ভেতর-বাইরের অবস্থা খুব শোচনীয় হতে থাকে। এর মাঝে আনন্দের খবর আসে আমার সরকারি চাকরির। নতুন চাকরিতে যোগদানে বেশ ব্যস্ত হয়ে যাই। ভুলে যেতে থাকি পে-অর্ডার আপুর কথা। বিয়ে করে সংসারী হই। কয়েক বছর পর মেয়ের বাবা হই। ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে দেখি, ললিতা হত্যায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড! ললিতার ছবি দেখে চেনা চেনা লাগে। তিনি তো আমার পে-অর্ডার আপু। খবরের ভেতরের অংশ পড়ে শিওর হই। তিনিতো অনেক আগেই দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। আমার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করবেন? তার পাষণ্ড স্বামী নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলেছেন। অথচ আমি এসবের কিছুই জানি না!

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়