মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৪০

শিক্ষকদের কেনো বার বার রাস্তায় নামতে হয়?

মাছুম বিল্লাহ
শিক্ষকদের কেনো বার বার রাস্তায় নামতে হয়?

মাধ্যমিকের বেসরকারি শিক্ষকরা টানা দশদিনের আন্দোলন শেষে মূল বেতনে ১৫ শতাংশ বাড়িভাড়া আদায় করে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গেলেন। এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য বার্ষিক পরীক্ষা পর্যন্ত শনিবার ক্লাস নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এটি একটি ভাল উদ্যোগ! শিক্ষকদের অবস্থা নিয়ে যাদের চিন্তা করার কথা ছিল তারা কখনোই তা করেননি। দেশের শিক্ষার বিশাল অংশই চলে বেসরকারি পর্যায়ে। অথচ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বৈষম্য চরমে।

কোন সরকারই তেমন কোন পদক্ষেপ কখনও নিতে চায়নি। যখন শিক্ষকরা সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে, ঢাকায় এসে বল প্রয়োগ করেন, তখনই সবাই একটু নড়েচড়ে বসেন। দেশে এত বছরে এত গণতন্ত্রের দাবিদার সরকার এলো গেলো, কিন্তু কেউই বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য সঠিক কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রথম সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের অভিন্ন বেতন স্কেল প্রচলন করলেন ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে। এই কাজটি আগে কেউই করার কথা চিন্তা করেননি। এরশাদ আমলে শিক্ষা প্রায় জাতীয়করণ হয় হয় অবস্থা, কিন্তু তৎকালীন শিক্ষা সচিব নাকি মানা করেছিলেন এই বলেÑএতবড় চাপ আপনার নেয়ার কি দরকার?

পরে সেটি আর হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে সাহস দেখিয়েছিলেন কিন্তু এতে সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে বহু। প্রথমত, প্রাথমিকে কয়েক ধরনের শিক্ষা রয়েছে, সবগুলোকে জাতীয়করণ করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, সব এলাকার প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করার দরকার ছিলনা। এতে শিক্ষকদের চাকরি সরকারি হয়েছে কিন্তু শিক্ষার মান তলানিতে চলে গেছে। কারণ প্রাথমিক শিক্ষার এতবড় পরিধি মানসম্পন্নভাবে সামাল দেয়ার মেকানিজম নেই।

রাষ্ট্রের পক্ষে দেখা ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না এবং হচ্ছে না। কারা প্রাথমিক শিক্ষার বিশাল বহর পরিচালনা করবে তারও কোন নির্দিষ্ট প্রেসক্রিপশন ছিলনা। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার দায়-দায়িত্ব চলে গেছে আমলাদের হাতে। সুবিধা যা হওয়ার তাদের হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষার তেমন উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হয়নি। প্রাথমিকে কোনোভাবেই মান ধরে রাখা যাচ্ছেনা। সচ্ছল অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এখানে পাঠাতে চাচ্ছেন না, পাঠাচ্ছেনও না, একান্ত ঠেকা না হলে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে গেছে একই সংসারে অনেক সময় দেখা যায় বড় বোনকে বাদ দিয়ে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বড় বোনের বিয়ের বহু সমস্যা হয়। সেটিই হয়েছে। মাধ্যমিককে জাতীয় করণ না করে শুধু প্রাথমিককে করায় এখন বহু সমস্যা দেখা দিয়েছে। গোল্লায় যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া! এমনিতেই ক্লাস হয়না, ক্লাস হয় তো যেভাবে হওয়ার তা হয়না।

শিক্ষার্থীদের যা জানার কথা তার ধারে কাছেও নেই। সেই অবস্থায় ক’দিন পর পর শিক্ষকদের সবকিছু বাদ দিয়ে ঢাকায় আসতে হয়। পুরো জাতি ও পৃথিবীর সামনে উন্মোচন করতে হয় বাংলাদেশের শিক্ষকরা কত অসহায়! আসলে শিক্ষকদের অবস্থা কোথাও ভাল নেই। উন্নত বিশ্বেও শিক্ষকদের সমস্যা আছে সেটি অন্য ধরনের। আমি নিজে দেখে এসেছি আফ্রিকার দেশগুলোতে শিক্ষকদের কি অবস্থা! একটি প্রতিষ্ঠানে একজন অধ্যক্ষ ছাড়া রাষ্ট্র থেকে কেউ কোন বেতন বা অর্থ সহায়তা পান না।

বাকিদের জিজ্ঞেস করলাম সংসার কিভাবে চলে। উত্তরে বললেন, স্কুলের পর অন্য কিছু করতে হয়। পরীক্ষার সময় বছরে এক দুইবার কিছু অর্থ আদায় হয় তখন কিছু পাওয়া যায়। নিয়মিত মাসিক কোন বেতন নেই। কারণ ঐ সরকার! তৃতীয় বিশ্বের সব সরকারই এমন। তারা পুলিশ লালন পালন করবে, প্রশাসনের লোকজন লালন পালন করবে, রাষ্ট্রের সামর্থ্য না থাকলেও বেশি সুযোগ সুবিধা দিয়ে কারণ তারা যে সরকারকে রক্ষা করবেন! কিন্তু শিক্ষকদের বেলায় সবাই নির্বিকার। বেসরকারি শিক্ষকরা বর্তমানে মূল বেতনের একশত ভাগ রাষ্ট্র থেকে পেয়ে থাকেন। এ পর্যন্ত নিয়ে আসতে তাদের রাস্তার আন্দোলনে নামতে হয়েছিল। কিন্তু এটি কেনো?

আমাদের দেশে এমন কেন হচ্ছে? এক হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে আলাদা মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছে। প্রাথমিকের পরিচালনাকারীর আমলা, মাধ্যমিকের শিক্ষকরা, তবে নিয়ন্ত্রণ বেশি থাকে আমলাদের হাতে। মাধ্যমিক কিছু (৩ শতাংশ) সরকারি আর সব বেসরকারি। এই অবস্থা সৃষ্টি করে আরও ঝামেলা বাঁধানো হয়েছে। এক পরিবারে এক ভাই সরকারি স্কুলের শিক্ষক তিনি সব সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন আর এক ভাই বেসরকারিতে। তাদের মাঝে আকাশ পাতাল ব্যবধান। তাও এখন কিছু বলা যাচ্ছে কিন্তু প্রতিবারেই শিক্ষকদের রাস্তায় নেমে এ পর্যন্ত দাবি আদায় করতে হয়েছে।

কয়েকটি স্কুল সরকারি আর সব বেসরকারি, এটি কেন? রাষ্ট্র যদি না পারে তাহলে বিশেষ ব্যবস্থায় সব বেসরকারি থাকবে, বিশেষ ব্যবস্থায় রাষ্ট্র তাদের সহায়তা করবে, সবার একই অবস্থা হবে। তাহলে কারোর তেমন কোন কথা থাকবে না। কয়েকজনকে সব সুবিধা দিয়ে বাকীদের বঞ্চিত রাখলে এ সমস্যা তো বার বার দেখা দিবেই। সরকার পারবে কিভাবে? পূর্ববতী সরকার শিক্ষক নেতাদের মধ্যে দালাল সৃষ্টি করে অবস্থা আরও বেগতিক করে ফেলেছিল। এখন সেই টাকা কে দেবে?

মন্ত্রণালয়ে এমন সব মন্ত্রীদের দায়িত্ব দেওয়া হয় যাদের বেশিরভাগের শিক্ষার সমস্যা নিয়ে কোন ধারণা থাকেনা। সবাই দলের গান গাইতে গাইতে মুখে ফেনা তোলেন, তাতে শিক্ষার কিছুই হয়না। শিক্ষার দায়িত্ব, প্রশাসন সবকিছুতেই তারা নির্ভর করেন দালাল আর মন্ত্রণালয়ে আমলাদের উপর। তাদেরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা দেশের শিক্ষার সমস্যা ও কিভাবে সমাধান করা যাবে সে সম্পর্কে ধারণা নেই কারণ তারা কেউ এসেছেন পাট মন্ত্রণালয় থেকে, কেউ এসেছেন বস্ত্র মন্ত্রণালয় থেকে, কেউবা ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে। ক’দিন পর আবার চলে যাবেন অন্য কোন মন্ত্রণালয়ে। এখানে মূল শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কিন্তু কেউ নেই।

আমাদের মতো দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তো ফিতা কাটা আর সিগনেচার করার মন্ত্রী বসলে হবেনা। পার্টির নেতা বসালে হবেনা। এখানে বসাতে হবে শিক্ষা যারা জানেন, শিক্ষা নিয়ে ভাবেন, শিক্ষা সমস্যা সমাধান করতে পারেন। যারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক। যারা বিদেশের মাটিতে নিজ দেশের গরীবের টাকা লুটে দিয়ে বাড়ি করেন, তারা এসব মন্ত্রণালয়ে বসে কি করবেন? কিছুই করবেন না।

কিন্তু এই শিক্ষা নিয়ে কত গল্প শুনেছি এবং শুনছি। ক্লাস বাদ দিয়ে শিক্ষকদের ঢাকায় এসে থালাবাটি নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়! এখানে মূল সমস্যাটি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীরা এমনিতেই ক্লাসে আসেনা, পড়েনা, পড়তে চায়না, ক্লাসে না আছে আনন্দ না আছে কোন চাপ, না আছে কোনো প্রেষণা, পরীক্ষার পাস হচ্ছে অন্যভাবে, তারা পড়বে কেনো? এর মধ্যে যখন তাদের শিক্ষকরা দিনের পর দিন দাবী দাওয়া আদায় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তখন তাদের অবস্থা কি হয় সেকথা আমরা কেউ বুঝতে চাইনা।

মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করার জন্য আন্দোলন হচ্ছে, শোরগোল হচ্ছে। এক সময় দেখা যাবে সরকার গড়পড়তা সব জাতীয়করণ করার ঘোষণা দিবে, কোন ধরনের বাছ-বিচার হয়তো করা হবেনা, যেমনটি প্রাথমিকের ক্ষেত্রে করা হয়নি। যেমন বড় বড় জেলা শহরে, জেলা শহর ছাড়াও কিছু কিছু এলাকায় ঐতিহ্যবাহি কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর পড়াশুনার মান ভাল, অর্থ সংকট নেই, শিক্ষকদের মানও ভাল। তাদেরকেও সরকারি করা হলে কি হবে? ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরেও কিছু ভাল ভাল প্রতিষ্ঠান আছে তাদের সরকারি হওয়ার দরকার নেই।

সরকারি হলে এসব প্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। কারণ, যারা প্রতিষ্ঠান দেখাশুনা করতেন তাদের তখন আর কিছু করার থাকবে না। এসব বিষয় ভাবার দরকার আছে। সরকার হয়তো ভাবছে সব জাতীয়করণ করা হলে এত বড় খরচ কিভাবে বহন করবে রাষ্ট্র? কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানই সরকারি করার দরকার হবে না। কিছু কমিউনিস্ট দেশে গ্রামে ডাক্তার বা শিক্ষক চাকরি করলে তাদেন বেতন দেয়া হয় দ্বিগুণ। এটি ভাল উদ্যোগ। আমাদের দেশেও গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি করা প্রয়োজন। তাহলে গ্রামের শিক্ষার্থীরা ভাল শিক্ষক পাবে আর শিক্ষকরা পাবেন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। এই বিষয়টি সর্বত্রই দরকার নেই। যেমন ঢাকার সরকারি প্রাইমারী স্কুল! কি দরকার ছিল? নিম্ন মধ্যবিত্তের বাচ্চারাও সেখানে পড়তে চায় না। সরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ে এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়গুলো ঢের ভালো!

এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মাচারীদের তিন দাবি ছিল -মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া ভাতা, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের চিকিৎসা ভাতা ৫০০টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০টাকা করা এবং এমপিওভুক্ত কর্মচারীদের উৎসব-ভাতা মূল বেতনের ৫০শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৫শতাংশ করা। সরকার ১৯ আক্টোবর ৫ শতাংশ বাড়িভাড়া দেয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু শিক্ষকরা তাতে সায় না দিয়ে ২৩ অক্টোবর যমুনা অভিমুখে যাত্রার হুঁশিয়ারি দেন। আমরা দেখলাম এবং এখনও দেখছি প্রাথমিক থেকে উচ্ছশিক্ষা পর্যন্ত সব শিক্ষকই কোন না কোন দাবি নিয়ে রাস্তায়, শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় সবাই হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করছেন, সবাই সরকারকে মারাত্মক ভয় দেখাচ্ছেন।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কাদের ভয় দেখাচ্ছি, কাদের হুঁশিয়ার করছি? বর্তমান সরকারে যারা আছেন তাদেরকে আমরা কেউ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করিনি। এমনও নয় যে, তাদেরকে আমাদের কাছে আবার আসতে হবে ভোটের জন্য কিংবা আবার উপদেষ্টা হওয়ার জন্য। দেশের একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তাদেরকে অনুরোধ করা হয়েছিল জুলাই গণহত্যার বিচার করা এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। কারণ বর্তমান প্রজন্মের কেউই ভোট বিষয়টির সাথে পরিচিত না। তারা বহু বছর কোন ভোট দিতে পারেনি। যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের অধিকার। এই সরকারকে সকল পেশাদার অপেশাদারদের মানুষদের সহযোগিতা করার কথা ছিল।

কিন্তু, আমরা দেখলাম কেউ কোন দিক বিবেচনা না করে সবাই প্রচন্ড চাপ প্রয়োগ করছে সরকারের উপর। যারা এই সরকারকে চাইছে না তারা তো প্রতিদিন প্রতিটি জায়গায় বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করছে, নিজেদের মধ্যে বিরোধ ও শত্রুতা তৈরি করছে যাতে মহাগন্ডগোল লেগে যায়। সবারই উচিত ছিল একটু ধৈর্য ধরা এবং নির্বাচিত সরকার যাতে আগের মতো আর না করতে পারে সে ধরনের একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে এই সরকারকে সহায়তা করা। সেটি কেউ করেনি।

সরকারকে সবাই নাস্তানুবাদ করছে। আমার বুঝতে কষ্ট হয় আমরা কেনো বুঝতে চাইনা। শিক্ষার্থীদের কিছু হলে বা না হলেও কিছু একটা বানিয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিচ্ছে। দেশের প্রতিটি সেক্টরের এত অরাজক পরিস্থিতি এই ধরনের সরকারের পক্ষে সামাল দেয়া কোনোভাবে সম্ভব নয়। কারণ তারা কেউ আমাদের দেশের যে রাজনীতি সেটি কেউ করেন নি। তারা সবাই নিরেট ভদ্রলোক। কিন্তু তাদেরকে যেন কেউ সহযোগিতা করতে চাইছেনা, সবাই সামান্য স্বার্থের কারণে রাস্তায় নেমে পড়ছে। কোথাও কোন ব্যবস্থা নিতে গেলে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিচ্ছে। দেশ কোনদিকে যাচ্ছে কেউ চিন্তা করছিনা। কিন্তু এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের চিন্তা তো করতে হবে!

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়