মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫  |   ৩৩ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে নেতাকর্মীদের ঢল

প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৫, ০৮:১৭

শিক্ষার্থীদের জন্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স

ফয়সাল আহম্মেদ ফরাজী
শিক্ষার্থীদের জন্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আজ মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলছে। এই প্রযুক্তির ছোঁয়া এখন আর কেবল গবেষণাগার কিংবা উন্নত দেশেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং গ্রাম থেকে শহর সবখানে এর প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষ করে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য AI এখন এক বিশাল সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করছে। তাদের শেখার পদ্ধতি, তথ্য অনুসন্ধান, দক্ষতা অর্জন এবং ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে AI এক অনন্য সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে কারণ এটি তাদের শেখার প্রক্রিয়াকে করে তুলছে সহজ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও গতিশীল। একজন শিক্ষার্থী নিজের মতো করে একটি বিষয় শেখার সুযোগ পাচ্ছে, যেটি AI নির্ভর ভার্চুয়াল টিউটর কিংবা চ্যাটবটের মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা কঠিন বা জটিল বিষয়ে শিক্ষক না পেয়ে হতাশ হয়, সেখানে অও নির্ভর সিস্টেম তাৎক্ষণিকভাবে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে, ব্যাখ্যা দিয়ে অথবা নমুনা সমাধান দেখিয়ে সহায়তা করতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীর শেখার আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।

এই প্রযুক্তি ব্যবহারে শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে একাধিক সুবিধা। তারা সহজেই বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে, গবেষণামূলক কাজ বা প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে পারছে, এমনকি নিজের লেখা ইংরেজি অনুচ্ছেদ অও দিয়ে সংশোধন করেও নিচ্ছে। প্রোগ্রামিং শেখা, ডেটা বিশ্লেষণ কিংবা কনটেন্ট তৈরি সবই এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স নির্ভর টুল দিয়ে দ্রুত ও সহজভাবে করা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জন্য এটি সময় সাশ্রয়ী এবং দক্ষতা উন্নয়নের দারুণ একটি উপায়।

বিশ্বব্যাপী অও প্রযুক্তির প্রভাব ইতিমধ্যেই সুস্পষ্ট। চিকিৎসা খাতে রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত, কৃষিতে বৃষ্টির পূর্বাভাস থেকে ফলন বাড়ানোর কৌশল নির্ধারণে, শিল্পকারখানায় উৎপাদন স্বয়ংক্রিয়করণে কিংবা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে AI গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ChatGPT, Google Bard, Grammarly, Canva, Midjourney ইত্যাদি টুলগুলো বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন ব্যবহার করছে। এই বাস্তবতা আমাদের শিক্ষার্থীদের এই প্রযুক্তির সাথে পরিচিত এবং দক্ষ করে তুলতে উৎসাহিত করছে।

বর্তমান কর্মক্ষেত্রেও AI-এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। অনেক প্রতিষ্ঠানে রুটিন কাজ এখন সম্পূর্ণভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ফলে কিছু চাকরি বিলুপ্ত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কাজের ক্ষেত্র, যেখানে মানুষের বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অপরিহার্য। AI-ভিত্তিক পেশাগুলোর মধ্যে রয়েছে ডেটা সায়েন্টিস্ট, মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ার, অটোমেশন স্পেশালিস্ট ইত্যাদি। এ কারণে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গঠনে অও শেখা এখন সময়ের দাবি।

বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ইতোমধ্যে AI একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে পড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশেও জাতীয় পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় সুযোগ, যা তাদের ভবিষ্যৎকে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখবে।

গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নেও অও হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তারা যদি ইন্টারনেট সুবিধা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে খুব সহজেই ChatGPT, Google Translate, Grammarly, Canva ইত্যাদি টুল ব্যবহার করে লেখালেখি, অনুবাদ, ডিজাইন ও কনটেন্ট তৈরি করতে পারে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা নিজের দক্ষতা বাড়াতে পারে এবং অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয়ও করতে পারে। বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থীই ইউটিউবে ভিডিও তৈরি, ডিজিটাল মার্কেটিং বা ব্লগিং-এর মাধ্যমে আয় করছে, যেখানে অও প্রযুক্তি তাদের কার্যক্ষমতা বাড়াচ্ছে।

AI প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যেসব টুল সহজে ব্যবহার করতে পারে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ChatGPT, যেটি লেখালেখি, প্রশ্নোত্তর ও আইডিয়া জেনারেশনের জন্য চমৎকার একটি মাধ্যম। Canva -এর মাধ্যমে তারা প্রেজেন্টেশন, পোস্টার কিংবা ডিজাইন তৈরি করতে পারে, Grammarly দিয়ে লেখার ভুল ধরতে পারে এবং Google Bard দিয়ে যে কোনো বিষয়ের গভীর বিশ্লেষণ ও তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। অও ভিত্তিক সফটওয়্যার যেমন Scratch ev Code.org প্রাথমিক পর্যায়ে প্রোগ্রামিং শেখার জন্য বিশেষভাবে সহায়ক।

এইসব টুল ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আয় করার সুযোগও পাচ্ছে। তারা ডিজাইন, কনটেন্ট লেখা, ভিডিও এডিটিং, ব্লগিং, ইউটিউব ভিডিও তৈরি এবং অনলাইন কোর্স নির্মাণের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনে সক্ষম হচ্ছে। এমনকি অনেকেই ফাইভার, আপওয়ার্ক বা ফেসবুক মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং করছে। অর্থাৎ অও এখন শুধু শেখার ক্ষেত্রেই নয়, বরং জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবেও কার্যকর হচ্ছে।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই অও সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। অন্যথায় তারা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। অও সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে ভবিষ্যতের চাকরির বাজার, গবেষণা কার্যক্রম কিংবা প্রযুক্তি নির্ভর উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

ভবিষ্যতে অও প্রযুক্তি চিকিৎসা, কৃষি, শিক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসন এমনকি গণমাধ্যমে আরও গভীর প্রভাব ফেলবে। রোগ নির্ণয়, ভার্চুয়াল শিক্ষকতা, স্মার্ট চাষাবাদ, অপরাধ পূর্বাভাস, ডিজিটাল আদালতÑএসব ক্ষেত্রেই অও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

তবে এর সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জও। যদি শিক্ষার্থীরা এর উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাহলে তাদের সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণী দক্ষতা হ্রাস পেতে পারে। ভুল বা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে যেমন পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন, তথ্য বিকৃতি বা নকল কনটেন্ট তৈরি হতে পারে, যা তাদের শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই অও ব্যবহারে নৈতিকতা ও সচেতনতার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি।

সার্বিকভাবে বলা যায়, অও এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং সময়োপযোগী প্রয়োজন। কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি যেমন শেখার একটি আধুনিক মাধ্যম, তেমনি দক্ষতা ও আত্মনির্ভরশীলতার পথে এক বিশাল সহায়ক শক্তি। এই প্রযুক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের জীবনের পাশাপাশি দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নেও অবদান রাখতে পারবে।

রোটারিয়ান মো. ফয়সাল আহম্মেদ ফরাজী : সহকারী অধ্যাপক, আইসিটি ও সহকারী উপাধ্যক্ষ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়