প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫, ০৫:৫৫
বগুড়া কাঁপছে অর্থ কেলেঙ্কারিতে!
সাবেক শিবির নেতা পিন্টুর 'রেইনবো' এখন প্রতারণার প্রতীক, ২০০ কোটির হদিস নেই!

বগুড়ায় শরিয়াহভিত্তিক অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা আমিরুজ্জামান পিন্টু। তার প্রতিষ্ঠিত ‘রেইনবো মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ ও একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই প্রতারণা সংঘটিত হয়েছে।
|আরো খবর
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বগুড়া শহরের মালগ্রাম মধ্যপাড়ার খন্দকারপাড়ার বাসিন্দা আমিরুজ্জামান পিন্টু একসময় ফারইস্ট ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। পরে চাকরি ছেড়ে ২০১৩ সালে ‘রেইনবো মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ গঠন করেন তিনি। সাবেক শিবির নেতা হওয়ায় জামায়াত কর্মীদের মধ্যে তার প্রতি একধরনের আস্থা তৈরি হয়। এই আস্থাকে কাজে লাগিয়ে তিনি শরিয়াহভিত্তিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেন।
শুরুতে নিয়মিত মুনাফা প্রদান করায় বিনিয়োগকারীরা আরও উৎসাহী হয়ে বড় অঙ্কের টাকা জমা দিতে থাকেন। কিন্তু ২০২৪ সাল থেকে মুনাফা পরিশোধ বন্ধ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে বিনিয়োগকারীরা তাদের মূল টাকা ফেরতের জন্য চাপ দিলে পিন্টু একাধিকবার আশ্বাস দেন, কিন্তু পরে আর দেখা মেলেনি তার। গত ২ জুন পাওনাদাররা তার বাসা ও হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিলেও তাকে কোথাও পাওয়া যায়নি।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতারণার শিকার অনেকেই প্রবাসফেরত শ্রমিক, কেউ বা শিক্ষক কিংবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কেউ কেউ তাদের পেনশনের পুরো টাকাই পিন্টুর প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছিলেন।
বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক ফজলুর রহমান বলেন, তিনি পিন্টুর সাবেক ছাত্র হওয়ায় আস্থায় পড়ে বিভিন্ন দফায় ৯০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। এর মধ্যে মাত্র ৭ লাখ টাকা ফেরত পেয়েছেন। তিনি আরও জানান, তার স্ত্রীর গয়না বিক্রি, ছেলের সঞ্চয় ও জমি বিক্রির টাকাও এই প্রতিষ্ঠানে দিয়েছেন। এখন সব হারিয়ে চরম হতাশায় ভুগছেন।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আব্দুল হাকিম বলেন, তিনি ৩০ বছরের চাকরি জীবনের সমস্ত সঞ্চয়ই রেইনবোতে দিয়েছেন। এখন সব শেষ। তার বক্তব্য, “এত বড় প্রতারণা হয়েছে, অথচ প্রশাসনের কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।”
এদিকে বগুড়া শহর জামায়াতের আমির আবিদুর রহমান সেহেল বলেন, আমিরুজ্জামান পিন্টু নব্বইয়ের দশকে ছাত্রশিবিরের কর্মী ছিলেন। বর্তমানে তার সাথে জামায়াতের কোনো সাংগঠনিক সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, “আমরা বহুবার দলীয়ভাবে বলেছি, এ ধরনের কো-অপারেটিভে বিনিয়োগ না করতে। এখন যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে বিনিয়োগ করেছেন।”
বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান বাসির বলেন, “বিষয়টি সম্পর্কে আমরা শুনেছি। কেউ লিখিত অভিযোগ করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে মঙ্গলবার (৪ জুন) পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ জমা পড়েনি বলেও জানান তিনি।
ভুক্তভোগীদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, তারা একাধিকবার থানায় গিয়েও কোনো কার্যকর সহযোগিতা পাননি। কেউ কেউ জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শরিয়াহভিত্তিক অর্থ বিনিয়োগের নামে বিভিন্ন সময়ে যেসব প্রতারণা হয়েছে, তার একটি বড় উদাহরণ হয়ে উঠেছে এই ঘটনা। প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, নিবন্ধন ও তদারকির অভাব এবং ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে প্রতারণার এই প্রবণতা সমাজে বিপজ্জনক সংস্কৃতি সৃষ্টি করছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকার চাইলে এসব প্রতিষ্ঠানের লেনদেন, হিসাবপত্র ও কার্যক্রম সহজেই যাচাই করে প্রতারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রভাবের কারণে অনেক সময় এসব প্রতারক আইনের আওতার বাইরে থেকে যায়।
ভুক্তভোগীরা দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ও আইনগত ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি তারা তাদের হারানো অর্থ ফিরে পাওয়ার আশায় শেষবারের মতো সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকাও প্রত্যাশা করছেন।
ডিসিকে/এমজেডএইচ