রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫  |   ২৬ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৫, ২১:৫৪

ফরিদগঞ্জে হাসানের মৃত্যুরহস্য ক্রমেই জট বাঁধছে

আমার স্বামীকে যারা মেরেছে, তাদের বিচার চাই : সদ্য বিধবা স্ত্রী

প্রবীর চক্রবর্তী
আমার স্বামীকে যারা মেরেছে, তাদের বিচার চাই : সদ্য বিধবা স্ত্রী

ফরিদগঞ্জে হাসানুর রহমান হাসানের মৃত্যুরহস্য ক্রমেই জট বাঁধছে। হাসানের মৃতদেহে আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও তার হাতের কোণে ও আঙ্গুলে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের জখমের চিহ্ন রয়েছে। কিন্তু মৃতদেহ প্রাপ্তির স্থানে বিদ্যুতের কোনো লাইন বা সংযোগ পাওয়া যায়নি। তাহলে এই মৃতদেহ কীভাবে এখানে আসলো--এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে পুলিশ ও এলাকাবাসীর কাছে। রহস্য উদঘাটনে পুলিশের একাধিক টিম এলাকায় সাদা পোশাকে কাজ করছে।

মরদেহ উদ্ধারের পর থেকেই হাসানের মৃত্যু রহস্য নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে। কীভাবে তার মৃত্যু হলো, কে তাকে মারলো? নাকি এমনিতে মৃত্যু হলো? লাশ কীভাবে বাগানে আসলো? এমন সব প্রশ্নের জবাব খুঁজছে জনগণ।

শনিবার (১২ জুলাই ২০২৫) পৌর এলাকার নোয়াগাঁও গ্রামের রনমিজি বাড়িতে গেলে দেখা যায়, পুত্র শোকে কাতর হাসানের মা পেয়ারা বেগম বিলাপ করছেন। তার ছেলেকে খুন করা হয়েছে এমন কথা অনবরত কান্নার মধ্যে তিনি বলেই চলছেন।

ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশের খাতায় হাসানের নামে ৭টি মামলা থাকলেও পরিবার ও এলাকাবাসীর দাবি, গত এক/দেড় বছর পূর্বে হাসান চুরিসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসে। তখন থেকেই তার সংসারে লাগে অভাবের ঢেউ, যা এখনো চলছে।

শনিবার (১২ জুলাই ২০২৫) বিকেলে জানাজা শেষে হাসানের মরদেহ দাফনের পর সকলেই নিজ নিজ ঘরে চলে গেলেও তার তিন সন্তান ও সদ্য বিধবা হওয়া স্ত্রীর লিপি বেগমের মুখে ফুটে উঠেছে কালো মেঘের ছায়া। দু মাস বয়সী তানহাকে হয়ত বুকের দুধ দিয়ে ক্ষুধা মেটাবে। কিন্তু ১৪ বছর বয়সী তানজিলা ও ৫ বছর বয়সী তামিমের ক্ষুধা নিবারণের খাবারটুকুও যে তার ঘরে নেই। হয়তবা দু-একদিন আশপাশের পরিবারের সদস্যরা আপাতত খাবার দিলেও এরপর কী হবে তা কেউ জানেন না।

হাসানের ঘরের দুঃখের কথা জানালেন তার প্রতিবেশী কামরুল ইসলাম ফারুক। তিনি জানান, হাসান চুরি করতো একসময়ে, এটা ঠিক। গত দেড় বছর পূর্বে একদিন হাসান আমার পায়ে ধরে বলেন, ভাই আমার মেয়ে বড় হচ্ছে। এই কাজ করলে মেয়ে বিয়ে দেবো কীভাবে? আমি ভালো হতে চাই, আপনি সহযোগিতা করেন। তখন আমি ফরিদগঞ্জ থানার এক দারোগার সাথে কথা বলি। তিনি সহযোগিতা করেন। তখন থেকে সে দিনমজুর হিসেবে কাজ করেই সংসার চালাতো। রাতে মাছ শিকার করতো। তবে তার সংসারে এতো যে অভাব আমিও তা জানতাম না। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ ওঠার পর লোকজন তাৎক্ষণিক এসে তাকে বাড়িতেই পেয়েছে। এসব প্রেক্ষিতে হাসান আমার কাছে দুঃখ করে বলেছিলো, চুরি ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু দুর্নাম পিছু ছাড়ছে না। তারা কেনো বুঝে না, চুরি করে একটি সোনার হার আনলে দু লাখ টাকা পেতাম। তাহলে তো আমার সন্তানরা না খেয়ে দিন কাটাতো না। তার কথার সত্যতা তার মৃত্যুর পর মানুষের মুখে শুনেছি। আশপাশের বাড়ির লোকজন তাকে চাল ও টাকা দিয়ে সহায়তা করেছে।

দাফন করতে আসা ওই বাড়ির বাসিন্দা বকুল হোসেন জানান, হাসানের দাফনের সমস্ত খরচ তিনি বহন করেছেন। এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো উচিত। হাসান তার পিতার হিস্যা অনুযায়ী সর্বোচ্চ এক শতক জায়গা পাবে। ফলে তার স্ত্রী-সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

পাশের বাড়ির মনির হোসেন জানান, হাসানের মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যরা কী করবে, কোথায় যাবে, কীভাবে সংসার চলবে তা ভাববার বিষয়। আশা করছি সমাজহিতৈষীরা এগিয়ে আসবেন এই পরিবারটিকে বেঁচে থাকার আশ্রয়স্থল ও খাবারের ব্যবস্থা করার জন্যে।

নিহত হাসানের সদ্য বিধবা স্ত্রী ঝুপড়ি ঘর থেকে নিয়মের বেড়াজাল ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে বলেন, এক বছর পূর্বে আমার জেঠী শাশুড়ির রান্না ঘর তথা ঝুপড়ি ঘরেই আমরা থাকা শুরু করেছি। ছোট্ট পাখির বাসার মতো আমাদের সংসার কষ্টেই চলতো। আমার অনুরোধে আমার স্বামী পূর্বের সকল কিছু ছেড়ে দিয়ে দিনমজুর হিসেবে কাজ করেই আমাদের দুই বেলা খাওয়াতো। খেয়ে না খেয়ে জীবন পার করছিলাম। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ ছিলো না। কেনো আমার স্বামীকে এভাবে মেরে ফেলা হলো! আমি তিন সন্তান নিয়ে এখন কোথায় যাবো? কীভাবে চলবে আমার সংসার? আমার স্বামীকে যারা মেরেছে, তাদের বিচার চাই।

মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী তানজিলা তার বাবা নেই, তা মানতে পারছে না। সে তার বাবার হত্যার বিচার চায়।

এদিকে নিহত হাসানের লাশ পোস্টমর্টেম শেষে বাড়িতে আনার পর আশপাশের মানুষ ছুটে আসে হাসানের ঝুপড়ি ঘরের সামনে। সকলেই সান্ত্বনা দিয়ে গেলেও কীভাবে হাসানের স্ত্রী সন্তানরা বেঁচে থাকবে সে বিষয়টি কেউ ভাবেন নি। বাদ আসর জানাজা শেষে রনমিজি বাড়ির কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। যারা হাসানকে গোসল করিয়েছেন এমন একজন জানান, হাসানের মুখ পুরো কালো হয়ে গিয়েছিল। তাদের দেখতে কষ্ট হয়েছে।

নিহতের বোন কুলছুমা বেগম বলেন, এখন আমার ভাইয়ের পরিবারকে কে দেখবে? আপনারা যদি একটু লেখেন, তাহলে পরিবারটি বাঁচতে পারবে।

হাসানের ভাই শরীফ হোসেন তার মৃত ভাইয়ের ঝুপড়ি ঘরটি দেখিয়ে বলেন, সকলেই আমার ভাইকে নিয়ে নানা কথা বলে। আমি এখনো বলছি, তাকে হত্যা করা হয়েছে। ইতঃপূর্বে তাকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। আমি আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই। আশা করি পুলিশ এর রহস্য উদঘাটন করতে পারবে।

ফরিদগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ শাহ আলম জানান, শুক্রবার লাশ উদ্ধার করে পোস্টমর্টেমের জন্যে পাঠানো হয়। পরে শনিবার পোস্টমর্টেম শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। লিখিত অভিযোগের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।

উল্লেখ্য, শুক্রবার (১১ জুলাই ২০২৫) ফরিদগঞ্জ পৌর এলাকার ৩নং ওয়ার্ডের নোয়াগাঁও গ্রামের তপাদার বাড়ির শাহ আলমের পোল্ট্রি খামারের পাশে সাত্তার মিয়ার মালিকানাধীন সুপারির বাগান থেকে মাটিতে শোয়ানো অবস্থায় হাসানুর রহমানের মরদেহটি উদ্ধার করা হয়।

নিহত হাসানুর রহমান পৌর এলাকার ৩নং ওয়ার্ডের নোয়াগাঁও গ্রামের রনমিজি বাড়ির খোকন মিজির ছেলে। তিনি ১ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক ছিলেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়