প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৫, ০৯:১৪
চাঁদপুরের সাহিত্যচর্চা : ধ্রুপদী ধারা থেকে নবজাগরণ

বাংলা সাহিত্য যখনই ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নিজের পথ খুঁজে নিয়েছে, চাঁদপুর তখনই আপন আলোয় সেই পথে সঙ্গত দিয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়ার ত্রিমোহনীর এই জেলা শুধু নদী, মাছ আর জেলের গ্রাম নিয়ে গর্ব করে না, গর্ব করে তার সমৃদ্ধ সাহিত্যচর্চা নিয়েও। ইতিহাসের পাতায় পাতায় চাঁদপুরের সাহিত্যচর্চা ছড়িয়ে আছে গোপন স্রোতের মতোÑকখনও প্রকাশ্য, কখনও নীরব।
মধ্যযুগের শেষভাগে চাঁদপুরে সাহিত্যিক চর্চার প্রথম সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় দোনা গাজীর হাতে। তিনি রচনা করেছিলেন ‘সয়ফুলমূলক-বদিউজ্জামাল’, যা বাংলা প্রণয়কাব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। তখনকার সাহিত্যচর্চা সীমাবদ্ধ ছিল মূলত মৌখিক প্রচারে, কখনও লিপিবদ্ধ আকারে। কিন্তু এই রচনাগুলোতে ভেসে আসে মানুষের প্রেম, বেদনা, সমাজজীবনের নানা রং, যা প্রমাণ করে, সাহিত্য তখন থেকেই এ অঞ্চলের মানুষের মনের খোরাক।
ঊনিশ শতক ছিল চাঁদপুরের সাহিত্যজগতে নবজাগরণের কাল। ইংরেজি শিক্ষার প্রসার, মিশন স্কুল, প্রিন্টিং প্রেসের আবির্ভাব এ জেলার সাহিত্যচর্চাকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেয়। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকদের মধ্যে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, শান্তিদেব ঘোষ, চিত্রনিভা চৌধুরী, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাশেম খান, মনিরুল ইসলাম, শান্তনু কায়সার প্রমুখের নাম উঠে আসে। তাঁদের লেখায় সামাজিক বাস্তবতা, ব্যক্তিমানুষের অনুভূতি, জাতীয় রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটায়। চাঁদপুর তখন শুধু আঞ্চলিক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং জাতীয় সাহিত্য-চেতনার সঙ্গেও সংযুক্ত হয়ে পড়ে।
চাঁদপুরের সাহিত্যভুবনকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদার্পণ। ১৯২৬ সালে কবিগুরু চাঁদপুর সফরে আসেন। তাঁর এ সফর শুধু সাহিত্যিক গৌরবের নয়, বরং এ অঞ্চলের সাহিত্যিকদের জন্য এক গভীর প্রেরণার উৎস। এছাড়া কাজী নজরুল ইসলাম, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকরাও চাঁদপুরে এসেছিলেন। তাঁদের পদচারণা চাঁদপুরের সাহিত্যকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের পরে চাঁদপুরের সাহিত্যজগতে নতুন এক গতি আসে। স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তির স্বপ্ন এবং দেশগড়ার আকাক্সক্ষা চাঁদপুরের কবি-লেখকদের কলমে বারবার ধ্বনিত হয়। মোহলেছুর রহমান মুকুলের মতো লেখক এ সময়ের সাহিত্যচর্চায় সক্রিয় ছিলেন, যাঁর লেখায় উঠে আসে যুদ্ধ, মানুষ, স্বাধীনতা আর বেঁচে থাকার গল্প। চাঁদপুরের সাহিত্য তখন হয়ে ওঠে মানুষের মনের কথা বলার এক সাহসী মাধ্যম।
চাঁদপুরের সাহিত্যজগতে এক বিশেষ মাইলফলক হলো ১৯৮৬ সালে চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমি প্রতিষ্ঠা। প্রথমদিকে নানা প্রশাসনিক জটিলতা ও নেতৃত্বের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি সেভাবে এগোতে পারেনি। তবে ২০১৩ সালের পর জেলা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সাহিত্য একাডেমি নতুন প্রাণ ফিরে পায়। তখন থেকে নিয়মিত সাহিত্যসভা, কবিতা উৎসব, প্রবন্ধ পাঠ, প্রকাশনা উৎসব হতে থাকে। ২০১৭ সালে প্রথম জেলা সাহিত্য সম্মেলন আয়োজন করা হয়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন শিল্পী হাশেম খান এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। এই আয়োজন চাঁদপুরের সাহিত্যচর্চায় এক নতুন প্রাণসঞ্চার করে।
বর্তমানে চাঁদপুরের সাহিত্যচর্চা বহুমুখী ও গতিশীল। জেলা সদর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত লেখক-সাহিত্যিকরা তাঁদের সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন। সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদপুরের সাহিত্যাঙ্গনে যাঁরা উজ্জ্বল, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কাদের পলাশ, যিনি চাঁদপুরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক কাজ করছেন। তাঁর ‘বিস্মৃতির চাঁদপুর’ বইটি স্থানীয় ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল। এছাড়া ‘চাঁদপুরের সংস্কৃতি লোককথা ও অন্যান্য’ এবং ‘দেড়শ বছরের সাংবাদিকতা ও চাঁদপুর’ গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য গবেষণা কর্ম।
প্রবন্ধ ও গবেষণায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আরেক নাম মুহাম্মদ ফরিদ হাসান। চাঁদপুরের ইতিহাস, সাহিত্য, বরেণ্য ব্যক্তিদের সাথে চাঁদপুরের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর বেশকিছু গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
অনুবাদ ও মৌলিক সাহিত্যে সমসাময়িক কালে আরেক পরিচিত নাম মাইনুল ইসলাম মানিক। বিশ্ব সাহিত্যের অসংখ্য লেখা তিনি অনুবাদ করেছেন। এবছর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার কাব্যগ্রন্থ ‘কুরুক্ষেত্রের ঘুড়ি’।
কবিতা, গল্প, ছড়া, প্রবন্ধসহ সাহিত্যের মোটামুটি সব শাখায় যার বিচরণ তিনি পীযূষ কান্তি বড়ুয়া। প্রায় দুই দশক ধরে চাঁদপুরের সাহিত্যাঙ্গন ও জাতীয় পর্যায়ে আলো ছড়িয়ে পথ চলছেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য একজন কবি জাহিদ নয়ন, যিনি তুলনামূলকভাবে তরুণ হলেও চাঁদপুরের কবিতাঙ্গনে ইতিমধ্যেই নিজের স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছেন। এবারের একুশের বইমেলায় তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘আততায়ী অন্ধকার’ প্রকাশিত হয়েছে, যা শুধু একগুচ্ছ কবিতার সংকলন নয়, বরং সমকালীন সময়ের চিত্রায়ণে এক নির্মম কাব্যিক দলিল। মানব সভ্যতার পঙ্কিলতা, যুদ্ধ-সংঘাত, ক্ষমতার নিষ্ঠুরতা এবং নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে কবির সংবেদনশীল হৃদয়ের এক শৈল্পিক প্রতিবাদ এই গ্রন্থের মূল সুর। জাহিদ নয়ন কবিতার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রবন্ধ ও কলাম লিখেন নিয়মিত।
মঈনুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর কবিতায় তুলে ধরছেন সমকালীন মানুষের মানসিক দোলাচল। আরিফ চৌধুরী শুভ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লিখছেন কবিতা। শাহীন মাহমুদ গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতায় নিজের স্বতন্ত্র কণ্ঠ তৈরি করছেন। মিতালী শারমিন নারীজীবন ও সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা বলেন তাঁর লেখায়।
কবিতা ও গল্পে সমানতালে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন আরেক উল্লেখযোগ্য কবি ও গল্পকার নুরুন্নাহার মুন্নী। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা দুইটি। এবছর একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘গণতন্ত্রে পুরুষতন্ত্র’।
চাঁদপুরের সাম্প্রতিক কবি-লেখকদের মধ্যে কবির হোসেন মিজি ছড়া, কবিতা এবং রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখে নিজের আলাদা পরিচিতি গড়ে তুলেছেন। তিনি একাধারে কবি, লেখক এবং গণমাধ্যমকর্মী। এবারের একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লাল রঙের নামতা’, যা কেবল কবিতার সংকলন নয়, বরং জীবনের ক্ষরণ থেকে উঠে আসা অনুভূতির এক প্রগাঢ় প্রতিচিত্র।
অন্যদিকে, সাহিত্য, সাংবাদিকতা এবং সাংগঠনিক পরিসরে এক অনন্য সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে উঠে এসেছেন আশিক বিন রহিম। চাঁদপুরের সাহিত্যচর্চার যে ধারা বহুদিন ধরে জ্যোতির্ময় হয়ে আছে, তার ভেতরে কিছু মানুষ আছেন, যারা উচ্চকণ্ঠ নন, কিন্তু নিঃশব্দ পদচারণায় আমাদের সাহিত্যভুবনকে ঋদ্ধ করে চলেছেন। তেমন একজন মানুষ আশিক বিন রহিম।
সাংবাদিকতার জগতে তিনি সমানভাবে সক্রিয়। পাক্ষিক চাঁদনগর-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং দৈনিক চাঁদপুর সময়-এর বার্তা সম্পাদক হিসেবে তিনি সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের মধ্যে এক সেতুবন্ধন রচনা করছেন, যা চাঁদপুরের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক পরিসরকে সমৃদ্ধ করছে।
ইতিমধ্যেই আশিক বিন রহিমের পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যা তাঁর একক শ্রম ও মননশীলতার উজ্জ্বল প্রমাণ। তাঁর লেখায় সমাজ, ইতিহাস, এবং মানুষের অন্তর্লোকের কথা যেমন উঠে আসে, তেমনি মেলে ধরে চাঁদপুরের সাহিত্যিক সম্ভাবনার দিগন্ত। এমন একজন সাহিত্যকর্মী চাঁদপুরের সাহিত্যচর্চাকে শুধু নতুন প্রাণই দিচ্ছেন না, বরং এক গভীর দায়িত্ববোধের সঙ্গেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে তরুনদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে যারা সাহিত্য চর্চায় সক্রিয় আছেন তারা হলেন সঞ্জয় দেওয়ান, ম. নূরে আলম পাটওয়ারী, দন্ত্যন ইসলাম, শাদমান শরীফ, নুরুল ইসলাম ফরহাদ, মাইনুল হক তোহাসহ অনেকেই। এদের মধ্যে অনেকেই গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ও নাটক লিখছেন, আবার কেউ কেউ ছড়া বা শিশু সাহিত্যেও অবদান রাখছেন।
তবে চাঁদপুরের সাহিত্যজগতে এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রাচীন কবিদের যেমন দোনা গাজীর রচনা সংরক্ষণ বা বিশ্লেষণমূলক গবেষণার অভাব লক্ষণীয়। জেলা পর্যায়ে সাহিত্য আর্কাইভ গঠন, লেখক-সাহিত্যিকদের জীবনী প্রণয়ন, আর্থিক সহযোগিতা এবং সাহিত্য চর্চার পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ আরও জরুরি। তা না হলে অনেক মূল্যবান সাহিত্যকীর্তি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
তবু সব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও চাঁদপুরের সাহিত্যচর্চা বহমান, নদীর মতোই কখনও শান্ত, কখনও উচ্ছ্বাসে ফেনায়িত। অতীতের গৌরব, বর্তমানের সৃষ্টিশীলতা, আর ভবিষ্যতের সীমাহীন সম্ভাবনা মিলে চাঁদপুরের সাহিত্যচর্চা এখন শুধু এই জেলার গর্ব নয়, বরং বাংলাদেশের সাহিত্য-ঐতিহ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে। সাহিত্য এখানে নিছক শব্দের কারুকাজ নয়, বরং মানুষের জীবনের গল্প, ইতিহাসের দলিল, আর এক উজ্জ্বল স্বপ্ন।
লেখক : কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও পেশাদার বাচিকশিল্পী।