বুধবার, ০১ অক্টোবর, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৯

বিশ্বের দীর্ঘতম দূরপাল্লার সাঁতারে দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী মো. নুরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার

আমি আমার চাঁদপুরের সাঁতারের ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছি

আমার স্বপ্ন আছে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়া, আর বাংলাদেশ ও চাঁদপুরকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরা

ক্রীড়াকণ্ঠ প্রতিবেদক
আমি আমার চাঁদপুরের সাঁতারের ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছি

সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদপুরের ক্রীড়াঙ্গনে সুখবরের ছড়াছড়ি নেই। এখান থেকে উঠে আসা কোনো খেলোয়াড়ের জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ কৃতিত্বে উজ্জীবিত হবার মতো যখন নেই কোনো খবর, তখন হঠাৎ করেই জানা গেলো, চাঁদপুর শহরের ছেলে মো. নুরুল ইসলাম ভারতে অনুষ্ঠিত বিশ্বের দীর্ঘতম দূরপাল্লার সাঁতারে দ্বিতীয় হয়েছেন। এতে জনমনে বেশ সাড়া জাগে। আর সাঁতারে চাঁদপুরের অতীত গৌরবের কথা মনে পড়ে। সে আলোকে চাঁদপুর কণ্ঠের ‘ক্রীড়াকণ্ঠ’ বিভাগ থেকে নুরুল ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। এতে দশটি প্রশ্নের জবাব হিসেবে তিনি যেসব কথা বলেছেন, পাঠকের উদ্দেশ্যে সেসব তুলে ধরা হলো নিচে

ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনার পূর্ণ নাম কী? বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোন্ পদে কর্মরত এবং কতোদিন?

নুরুল ইসলাম : আমার নাম মো. নুরুল ইসলাম, আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে আছি এবং আমি দীর্ঘ ৭ বছর যাবত কর্মরত আছি।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনাকে অভিনন্দন জানাতে চাই এজন্যে যে, আপনি বিশ্বের দীর্ঘতম দূরপাল্লার সাঁতারে দ্বিতীয় হয়েছেন। আপনার অনুভূতি কেমন?

নুরুল ইসলাম : অনুভূতিটা আসলে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। একদিকে দীর্ঘ ৮১ কিলোমিটার, ১১ঘন্টা ১৬ মিনিট সাঁতার কাটা যে এতো কষ্টের, এটা যে না করেছে সে কখনোই বুঝবে না। তারপরও যে এতো কষ্ট করার পর আমি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছি, দুঃখ-কষ্ট ভুলে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠি এবং আমি আনন্দিত হই এটা ভেবে যে, আমি আমার চাঁদপুরের সাঁতারের ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছি।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনি ভারতের মুর্শিদাবাদে বিশ্বের দীর্ঘতম দূরপাল্লার সাঁতারে অংশগ্রহণের সুযোগটা কোন্ প্রক্রিয়ায় নিয়েছেন?Ñব্যক্তিগত উদ্যোগ, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় না সেনাবাহিনীর মাধ্যমে?

নুরুল ইসলাম নুরু : প্রথমত এই দূরপাল্লার সাঁতারে অংশগ্রহণের জন্যে বাংলাদেশে ৫ কিলোমিটার উন্মুক্ত ট্রায়াল হয় বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনে। ওইখানে আমি প্রথম হই। তারপর সুইমিং ফেডারেশন থেকে ভারতে আমার নাম পাঠানো হয়। ভারতে অংশগ্রহণ করার জন্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাকি কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়।

ক্রীড়াকণ্ঠ : দূরপাল্লার সাঁতারে এর পূর্বে কি আপনার কোনো কৃতিত্ব আছে, যেটা আপনাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে উদ্দীপ্ত করেছে?

নুরুল ইসলাম : হ্যাঁ, আমি এর পূর্বে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ২০তম জাতীয় দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতা ২০২৪, যেটা অনুষ্ঠিত হয় গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীতে এবং এই দূরপাল্লার সাঁতারটা ছিলো দীর্ঘ ১৫ কিলোমিটারের। ওই খানেও আমি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলাম। এরপর আমি উদ্যোগ নেই যে, ভারতের মুর্শিদাবাদে বিশ্বের দীর্ঘতম দূরপাল্লার সাঁতারে অংশগ্রহণ করবো।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনি সাঁতারের আরো ইভেন্ট থাকতে দূরপাল্লার সাঁতারকে বেছে নিলেন কেন?

নুরুল ইসলাম : হ্যাঁ, এটা সত্য যে, সাঁতারে আরো ইভেন্ট আছে। আমি আরো একটি ইভেন্টে ট্রাই করেছিলাম, কিন্তু তুলনামূলক কোনো সাফল্য পাইনি। এজন্যে আমি ওই ইভেন্ট ছেড়ে দূরপাল্লার সাঁতারে অংশগ্রহণ করি এবং তুলনামূলক ভালো রেজাল্ট হয়। এজন্যে আমি এই দূরপাল্লার সাঁতার কন্টিনিউ করি।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনি সাঁতারের কৌশলগত দিকগুলো কার কার কাছ থেকে শিখেছেন? চাঁদপুর শহরে আপনার বাড়ির কাছের ডাকাতিয়া নদী কি আপনার শৈশব থেকে সাঁতারে দক্ষতা অর্জনে অনেক ভূমিকা রেখেছে?

নুরুল ইসলাম : আমি যখন সাঁতারে আসি, তখন এক বড়ো ভাইয়ের পরামর্শে আসি। সাঁতার সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিলো না বা আমি কোনো কৌশল জানতাম না। তখন ছিলেন ফাতেমা ম্যাডাম, সায়মন স্যার, সেন্টু দাদা, তারপর সেলিম ভাই এবং তপন দাদা। ছানাউল্লাহ স্যারও ছিলেন। এঁরাই প্রথমত আমাকে সাঁতারের কৌশলগত দিকগুলো সম্পর্কে ধারণা দেন। এভাবে দু-তিন বছর প্রশিক্ষণ করতে থাকি এবং আস্তে আস্তে ভালো করা শুরু করি। তারপর শুরু হয় বাংলাদেশের ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম। এখানে আমি ২০১৭ সালে যোগদান করি এবং বাকি কৌশলগত দিকগুলো সেখান থেকেই শেখা হয়।

আমার বাড়ি যেহেতু ডাকাতিয়া নদীর পাশে, তো অবশ্যই শৈশবকালের অনেক স্মৃতি এই নদীকে জড়িয়ে আছে। শৈশব থেকেই এই নদীতে সাঁতার কেটে বড়ো হয়েছি এবং এই নদীতে প্রতিযোগিতাও করেছি। তাই বলা যায়, ডাকাতিয়া নদী আমার শৈশবে সাঁতারে দক্ষতা অর্জনে অবদান রেখেছে।

ক্রীড়াকণ্ঠ : অনেকদিন পর চাঁদপুরে জন্মগ্রহণকারী সাঁতারু হিসেবে আপনার সাফল্য সাঁতারে ঐতিহ্য হারানো চাঁদপুর জেলাবাসী জানতে পারলো। সাঁতারপ্রেমী মাত্রই এতে আনন্দিত। আপনি দূরপাল্লার সাঁতারে আপনার সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে কি নিয়মিত অনুশীলন করার সুযোগ পান বা অনুশীলন করেন?

নুরুল ইসলাম : যেহেতু আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছি, তাই আমার ফিটনেসের ওপর দৈনিক অনুশীলন করতে হয়, এই সাঁতারের ওপরই করতে হয় এবং অনেক কঠোর অনুশীলন করতে হয়। আমি চাই যে, পরবর্তীতে যেনো এরকম সাফল্য অর্জন করতে পারি। এ লক্ষ্যে আমি দৈনিক কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি।

ক্রীড়াকণ্ঠ : দূরপাল্লার সাঁতারে আপনি চাঁদপুরে উত্তরসূরি তৈরির কোনো পরিকল্পনা করছেন কিংবা কোনো সংগঠন বা ব্যক্তিকে তাগিদ দিতে চান?

নুরুল ইসলাম : দূরপাল্লার সাঁতারে কিংবা যে কোনো সাঁতারেই উত্তরসূরি তৈরি করা এতো সহজ নয়। সেটার জন্যে কঠোর পরিশ্রম, সুযোগ-সুবিধা দরকার হয়। আগে আমাদের চাঁদপুরের অনেক ভালো ভালো সাঁতারু ছিলো, কিন্তু এখন কোনো সাঁতারু বের হচ্ছে না। এটার মূল কারণ হচ্ছে প্রশিক্ষণ, যেটা আমাদের চাঁদপুরে এখন আর হচ্ছে না এবং ন্যাশনাল পর্যায়ে কোনো প্রতিযোগিতায় সাফল্য আসছে না আমাদের চাঁদপুর থেকে। যেহেতু আগে অনেক ভালো সাঁতারু ছিলেন আমাদের চাঁদপুর জেলার এবং রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাঁতারুও ছিলেন। যেমন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সাঁতারু অরুন কুমার নন্দী। আর ইংলিশ চ্যানেল জয়ী সাঁতারু আব্দুল মালেক। ঢাকা-চাঁদপুর অবিরাম সাঁতারে অংশগ্রহণকারী সাঁতারু বাদশা মিয়া, ছানাউল্লাহ খান ও রোকনুজ্জামান রোকন তো রয়েছেন। তাঁরা কিন্তু অনেক কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং তাঁদেরকে প্রশিক্ষণের সুযোগটাও দেওয়া হতো। যেটা আমিও পেয়েছি। কিন্তু এখন আর এই প্রশিক্ষণের সুযোগ- সুবিধাটা দেওয়া হয় না। তাই আমি বলবো, আমাদের চাঁদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থা যেনো একটা ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করে। যদি এই ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রামের প্ল্যান করে তাহলে ভবিষ্যতে ভালো ভালো সাঁতারু তৈরি হতে পারে বা পারবে। আমাদের চাঁদপুরের আরো ক্লাব আছে, তারাও যেন এই উদ্যোগটা নেয়। যদি এ রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আশা করা যায় কোনো সুফল পাওয়া যাবে।

ক্রীড়াকণ্ঠ : দূরপাল্লার সাঁতার নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী? কতোদূর এগিয়ে যেতে চান?

নুরুল ইসলাম : দূরপাল্লার সাঁতার নিয়ে আমার অনেক দূরে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। বাংলাদেশে দূরপাল্লার সাঁতার কেটেছি, ভারতে দূরপাল্লার সাঁতার করেছি। আমার স্বপ্ন আছে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া, আর বাংলাদেশ এবং চাঁদপুর জেলাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধারা।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর শহরের কোন্ জায়গায়? আপনার বাবা-মার নাম কী? বাবা-মা, ভাইবোন, স্ত্রী-সন্তানরা কে কী করেন? তারা কি আপনাকে সাঁতারে অনুপ্রেরণা দেন, সাহস জোগান?

নুরুল ইসলাম : আমার গ্রামের বাড়ি হচ্ছে চাঁদপুর শহরের ১১ নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ গুনরাজদী এলাকায়। আমার বাবার নাম আ. হামিদ শেখ, আমার মায়ের নাম খুরশিদা বেগম। আমরা ৪ ভাই ৪ বোন। ভাইদের মধ্যে আমি সবার ছোট। আমার ছোট আরো দুজন বোন আছে। আমি যখন সাঁতার শুরু করি, প্রথম থেকেই আমার বাবা-মা সাপোর্ট করতেন। সব সময় সাহস যোগাতেন যে, ভবিষ্যতে যদি ভালো কিছু করতে হয় তাহলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তাঁদের দোয়া ও ভালোবাসা আছে বলেই আজ এতোদূর পর্যন্ত আসা। আমাকে আর একজন স্যার সব সময় ভালো করার তাগিদ দিতেন, তিনি ছিলেন আমার মাদ্রাসার স্যার মো. কামাল হোসেন। আমার মাদ্রাসার নাম আনোয়ারা ইসলাম দাখিল মাদ্রাসা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়