প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১০:৫৭
দূরপাল্লার কৃতী সাঁতারু একেএম বাদশা মিয়া
ঢাকা-চাঁদপুর সাঁতারে রয়েছে তাঁর অবিস্মরণীয় কৃতিত্ব

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী আব্দুল মালেক বাংলাদেশের গর্ব। তাঁরই ছোটভাই একেএম বাদশা মিয়াও সাঁতারে এক পরিচিত নাম। বড়ো ভাইয়ের পথ অনুসরণ করেই তিনি জড়িয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনে। তবে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, খেলোয়াড়দের মূল্যায়ন নেই, তাই সন্তানদের খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করেননি। একজন ক্রীড়াবিদ হতে হলে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। সেখানে যদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও ক্রীড়া সংস্থার সাপোর্ট থাকে, তাহলে ভালো ক্রীড়াবিদ তৈরি কোনো কঠিন বিষয় নয়। আজ দেশে তরুণ প্রজন্ম মাদকাসক্ত হচ্ছে। কারণ বিভিন্ন ক্রীড়ার চর্চা নেই। অবসরে মোবাইল আসক্ত হয়ে পড়ছে। এসব থেকে দূরে রাখতে হলে সকল খেলাধুলার প্রতি তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
সাঁতারু একেএম বাদশা মিয়ার জীবনের সবচে’ বড়ো সাফল্য হচ্ছে, তিনি ১৯৯৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে ঢাকার মেরী আন্ডারসন নামক ভাসমান রেস্তোরাঁ সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদী থেকে দূরপাল্লার সাঁতার শুরু করে পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে চাঁদপুর মোলহেডের নিকটে মেঘনার তীর স্পর্শ করেন। তিনি তিনজন সাঁতারুর মধ্যে প্রথম হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। সম্প্রতি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ক্রীড়াকণ্ঠ বিভাগ থেকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। প্রশ্নোত্তর আকারে সেটি নিম্নে পত্রস্থ করা হলো।
ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনার বড়ো ভাই ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী আব্দুল মালেককে অনুসরণ করেই কি আপনি সাঁতারু হয়েছেন?
একেএম বাদশা মিয়া : হ্যাঁ, আমার বড়ো ভাই আব্দুল মালেক আমাদের পরিবারের, এলাকার এবং দেশের একজন গর্বিত সন্তান। ছোটবেলা থেকেই তাঁকে দেখে সাঁতারের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। তাঁর সাফল্য আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে নিয়মিত চর্চা ও প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। তবে ছোটবেলা থেকেই আমরা বাড়ির পুকুরে সাঁতার কাটতাম। আর ওদিকে ভাই বিভিন্ন জায়গায় সাঁতারে বিজয়ী হতেন, পুরস্কার পেতেন। এসবে সত্যিই দারুণ আনন্দ পেতাম। বিশেষ করে ভাই যখন আন্তর্জাতিক ইংলিশ চ্যানেলে বিজয়ী হয়েছেন, সেটি আমাকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করেছে।
ক্রীড়াকণ্ঠ : সাঁতারে আপনার উল্লেখযোগ্য অর্জন কী কী?
একেএম বাদশা মিয়া : জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও দাতব্য পর্যায়ের সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কৃত হয়েছি। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হলো : ঢাকা-চাঁদপুর দূরপাল্লার সাঁতার উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা মঞ্চে আমাকে সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদক প্রদান। তবে আমি সরকারি প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় সন্তানদের খেলোয়াড় হতে উদ্বুদ্ধ করিনি। খেলোয়াড়দের মাঠে একটি খরচ আছে। এটিতে কেউ একজন সাপোর্ট দিতে হয়। বাবার টাকা-পয়সা খরচ করেই সাঁতার নিয়ে সুনাম অর্জন করেছি।
ক্রীড়াকণ্ঠ : চারপাশে নদীনালা, খালবিল, পুকুর-দিঘি থাকলেই কি সাঁতারু হওয়া যায়, না সাঁতার শেখার জন্যে ব্যক্তিগত আগ্রহ কিংবা একাগ্রতা থাকতে হয়?
একেএম বাদশা মিয়া : শুধু জলাশয় থাকলেই হবে না। ব্যক্তিগত আগ্রহ, অনুশীলন এবং অধ্যবসায় ছাড়া ভালো সাঁতারু হওয়া সম্ভব নয়। পরিবেশ সহায়ক হতে পারে, কিন্তু মানসিক প্রস্তুতি এবং শৃঙ্খলা জরুরি। আমাদের বাড়িতে এখনও পুকুর আছে। আমি প্রতিদিনই সাঁতারের মাধ্যমে শারীরিক কসরত করি। মানুষ এখন সুযোগ পেলেই পুকুর, খাল-বিল ভরাট করে ফেলে। যার দরুণ ছোট থেকেই ছেলে-মেয়ে সাঁতার কাটার সুযোগ পায় না। এ নিয়ে সমাজপতি ও পরিবেশ অধিদপ্তর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনার দৃষ্টিতে চাঁদপুরে সাঁতারের সুদিন ছিলো কোন্ সময়টায়? সেটা কি কোনো সুযোগ-সুবিধা, পৃষ্ঠপোষকতা/প্রণোদনা না অন্য কারণে?
একেএম বাদশা মিয়া : ১৯৮০ ও ৯০-এর দশককে আমি চাঁদপুরে সাঁতারের সোনালী সময় বলবো। তখন সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রতিযোগিতা হতো, কোচদের উপস্থিতি ছিলো এবং খেলোয়াড়দের জন্যে প্রণোদনা ও উৎসাহ ছিলো। এখন সেটা অনেকটাই কমে গেছে। তৎকালীন প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার লাগোয়া পুকুর বা লেক ছিলো। আমি চাঁদপুর সরকারি কলেজে পড়াশোনা করাবস্থায় বর্তমান কলেজের লেকে সাঁতার কাটতাম। এখন তো সে লেকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্যে সাঁতার শেখার সুযোগ বা প্র্যাকটিস করার সুযোগ তো রাখা হয়নি। আমি মনে করি, কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ অনেক আন্তরিক। তিনি কর্তৃপক্ষকে নিয়ে এমন সুযোগ রাখবেন। সেখানে বিভিন্ন খেলার অনুশীলনের মাঠ আছে। তাহলে সাঁতারের জন্যে সুযোগ না থাকার কারণ তো হতে পারে না।
ক্রীড়াকণ্ঠ : চাঁদপুরে একটি সুইমিংপুল আছে। কিন্তু সেটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না কী কী কারণে?
একেএম বাদশা মিয়া : একাধিক কারণ আছে। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, প্রশিক্ষক সংকট, অনিয়মিত সময়সূচি, আর খেলোয়াড়দের উৎসাহ না থাকাটাই মূল বাধা। স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকে সাঁতারকে বাধ্যতামূলক না করলে সাঁতারে আগ্রহ বাড়বে না। চাঁদপুর জেলার ক্রীড়া সংস্থা সাঁতার বিষয়ে নীরব ছিলো এবং যারা কমিটিতে আছেন তাদের আন্তরিকতার অভাব ছিলো। আরেকটি বিষয় সুইমিংপুলে নিয়মিত পানি ঢোকানো, পানি বের করানো গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ না থাকায় এ বিষয়টি অবহেলায় পড়ে থাকে। আমার মনে আছে, সুইমিং পুলটি যেদিন উদ্বোধন হলো, সেদিন সাঁতার কেটেছি আমি, সানাউল্লাহ্ ও নুরু ভাই। এছাড়া চাঁদপুরের কৃতী সাঁতারুরাও উপস্থিত ছিলেন। এখন বিভিন্ন স্কুল কলেজের নির্দিষ্ট পুকুরগুলো ভরাট হয়ে গেছে। সুইমিং পুল ব্যবহার করে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সাঁতার শেখার সুযোগ করে দেওয়া উচিত ক্রীড়া সংস্থার।
ক্রীড়াকণ্ঠ : চাঁদপুরে সাঁতারের সুদিন ফিরিয়ে আনতে হলে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার বলে আপনি মনে করেন?
একেএম বাদশা মিয়া : ১. নিয়মিত সাঁতার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা; ২. স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পর্যায়ে সাঁতার প্রতিযোগিতা চালু; ৩. দক্ষ কোচ নিয়োগ; ৪. পুরস্কার, সনদ ও মিডিয়া কাভারেজ নিশ্চিত করা; ৫. জেলা ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা।
ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনি কি এখনও সাঁতার কাটেন? সাঁতার কাটার উপকারিতা আপনার শরীরে কেমন বোধ করেন?
একেএম বাদশা মিয়া : এখনও আমি নিয়মিত সাঁতার কাটার চেষ্টা করি। এটি আমার দেহ ও মনকে সুস্থ রাখে, স্ট্রেস কমায় এবং হার্ট ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। এটি আমার জীবনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
ক্রীড়াকণ্ঠ : উপরোল্লিখিত প্রশ্নমালার বাইরে আপনি কি আর কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন?
একেএম বাদশা মিয়া : আমি চাই নতুন প্রজন্ম যেন মোবাইলে আসক্তি ছেড়ে মাঠে আসে। সাঁতার জীবন বাঁচায়, স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং মানসিক দৃঢ়তা তৈরি করে—এটা বোঝাতে হবে পরিবার ও সমাজকে।
একেএম বাদশা মিয়ার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
পূর্ণ নাম : একেএম বাদশা মিয়া। পিতা : মৃত আবদুল জলিল মিয়া।
মাতা : মৃত রাহিলা বেগম
জন্মতারিখ : ১ জুলাই ১৯৪৭। পেশাগত পরিচয় : সমাজসেবা অধিদফতরের সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ।
বর্তমান ঠিকানা : বিষ্ণুদী রোড, পশ্চিম তরপুরচণ্ডী, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।
স্ত্রী : ফেরদৌসী বেগম। তিনি তরপুরচণ্ডী মালেক স্মৃতি একাডেমিতে অধ্যক্ষর দায়িত্ব পালন করছেন। সন্তান : ৩ কন্যা ও ১ পুত্র । মেয়েদের বিবাহ হয়েছে। তারা হলেন : বড়ো মেয়ে লিনিয়া ফেরদৌসী মৌসুমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনোমিক্সে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়। দ্বিতীয় মেয়ে জান্নাত ফেরদৌসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করে বর্তমানে রালদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। তৃতীয় মেয়ে জারিন তাসনিম শ্রাবণী। আর ১ ছেলে রিফাত শাহরিয়ার শাকিল সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বর্তমানে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করছেন।